যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের দিকে সবার দৃষ্টি

নতুন ব্রেক্সিট চুক্তি নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে সমঝোতার পর এখন আবারও দৃশ্যপটে ব্রিটিশ রাজনীতি। যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার কারণে জলে গেছে আগের চুক্তি। কিন্তু ব্রেক্সিট নিয়ে বিভক্ত ব্রিটিশ আইনসভা কি এবার নতুন এই চুক্তিতে সমর্থন দেবে? এমন প্রশ্নের জবাব জানা যাবে কাল শনিবার।

সমঝোতার মাধ্যমে ইইউর সঙ্গে যুক্তরাজ্যের বিচ্ছেদ কার্যকরে গতকাল বৃহস্পতিবার নতুন চুক্তিতে সম্মত হয় উভয় পক্ষ। সম্পাদিত এই চুক্তি অনুমোদন প্রশ্নে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে বিশেষ অধিবেশন ডাকা হয়েছে। চলতি শতকে ছুটির দিনে অধিবেশন ডাকার এটিই প্রথম ঘটনা।

ব্রেক্সিটবিরোধীদের উদ্যোগে পাস হওয়া এক আইনে (বেন অ্যাক্ট নামে পরিচিত) বলা আছে, ১৯ অক্টোবরের (শনিবার) মধ্যে কোনো চুক্তির পক্ষে বা চুক্তি ছাড়াই ব্রেক্সিট কার্যকরে পার্লামেন্টের অনুমোদন নিতে ব্যর্থ হলে সরকারকে অবশ্যই বিচ্ছেদের দিনক্ষণ ২০২০ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত পিছিয়ে দেওয়ার আবেদন করতে হবে। কিন্তু কট্টর ব্রেক্সিটপন্থী প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন যেকোনো মূল্যে ৩১ অক্টোবর ব্রেক্সিট কার্যকর করতে চান।

বিরোধী দলগুলো এই চুক্তির বিরোধিতায় সরব। তারা চায় চুক্তিটি প্রত্যাখ্যান করে বিচ্ছেদের দিনক্ষণ পেছাতে সরকারকে বাধ্য করতে। সরকারের অংশীদার নর্দান আয়ারল্যান্ডের ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়নিস্ট পার্টিও (ডিইউপি) জানিয়ে দিয়েছে, তারা এই চুক্তিতে সমর্থন দেবে না। পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য ডিইউপির ১০ জন আইনপ্রণেতার সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল সরকার। অন্যদিকে ব্রেক্সিট নিয়ে বিরোধের জের ধরে দুই আইনপ্রণেতার দলত্যাগ এবং ২১ জনকে বহিষ্কার করার কারণে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ধারে–কাছেও নেই ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভরা।

তবে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের দাবি, চুক্তিটি পার্লামেন্টে পাস হওয়ার ব্যাপারে তিনি বেশ আত্মবিশ্বাসী। শনিবার অধিবেশনের আগে চুক্তির পক্ষে আইনপ্রণেতাদের সমর্থন আদায়ে মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালায় সরকার। মন্ত্রীরা একের পর এক গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়ে চুক্তির পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন।

নতুন চুক্তি কতটা নতুন
ব্রেক্সিটের নতুন চুক্তির ৯৫ ভাগ সাবেক প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে সম্পাদিত চুক্তির মতোই। পরিবর্তন ঘটেছে কেবল আয়ারল্যান্ড সীমান্ত ব্যবস্থাপনা বিষয়ে। নর্দান আয়ারল্যান্ড যুক্তরাজ্যের অংশ। আর স্বাধীন আয়ারল্যান্ড ইইউর সদস্য। স্বাধীনতাকামী আইরিশদের দীর্ঘ সশস্ত্র লড়াই থামাতে দুই আয়ারল্যান্ডের মধ্যকার সীমান্ত উন্মুক্ত রাখার পাশাপাশি উভয় অংশের মধ্যে মুক্ত যাতায়াতে চুক্তিবদ্ধ যুক্তরাজ্য। তাই ব্রেক্সিটের পর আয়ারল্যান্ড সীমান্তে যেকোনো ধরনের তল্লাশিচৌকি স্থাপন হবে ওই চুক্তির লঙ্ঘন এবং আবারও ওই অঞ্চলে অশান্তির কারণ।

এই সীমান্ত উন্মুক্ত রাখার কৌশল হিসেবে থেরেসা মে সম্পাদিত চুক্তিতে নর্দান আয়ারল্যান্ডকে পুরোপুরি ইইউ আইনের অধীনে রাখার কথা বলা হয়েছিল। নর্দান আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে পণ্যের আদান-প্রদানের জন্য যুক্তরাজ্যের বাকি অংশকেও ইইউর শুল্ক আইনসহ বেশ কিছু নিয়ম মেনে চলার বাধ্যবাধকতা যুক্ত ছিল। সীমান্ত উন্মুক্ত রাখার গ্রহণযোগ্য বিকল্প না পাওয়ার আগ পর্যন্ত এসব নিয়ম মানার শর্ত ছিল। চুক্তির এ অনুচ্ছেদটি ‘ব্যাকস্টপ’ নামে পরিচিত। এই ‘ব্যাকস্টপ’ ব্যবস্থাকে যুক্তরাজ্যের স্বার্বভৌমত্বের বিরোধী বলে আখ্যায়িত করেন ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির কট্টর ব্রেক্সিটপন্থীরা। এ বিষয়ে গ্রহণযোগ্য পরিবর্তন করা হলে তবে চুক্তিতে সমর্থন দেবেন বলে তাঁরা জানান।

কিন্তু সাবেক প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে বারবার চেষ্টা করলেও ‘ব্যাকস্টপ’ ব্যবস্থার পরিবর্তনে রাজি হয়নি ইইউ। চুক্তি ছাড়াই ব্রেক্সিট কার্যকর করার জোরালো প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন বরিস জনসন। নতুন চুক্তিতে তিনি ঠিকই ব্যাকস্টপ ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়েছেন। নতুন চুক্তিতে ইইউর একক বাজার ও শুল্ক জোটের সব নিয়ম থেকে বেরিয়ে আসবে যুক্তরাজ্য। নর্দান আয়ারল্যান্ড সীমান্তও মুক্ত থাকবে। তবে কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে নর্দান আয়ারল্যান্ডকে ইইউ আইন মানতে হবে। একই কারণে যুক্তরাজ্যের বাকি অংশ থেকে নর্দান আয়ারল্যন্ডে কিছু পণ্যের আদান-প্রদানে তল্লাশির প্রয়োজন হবে। তবে এসব তল্লাশি করবেন ব্রিটিশ কর্মকর্তারা। এ ছাড়া ইইউ আইন মেনে চলবে কি না, সে বিষয়ে চার বছর পরপর সিদ্ধান্ত দিতে পারবে নর্দান আয়ারল্যান্ড।

ইইউ বলেছিল, তারা চুক্তির পরিবর্তনে রাজি নয়। কিন্তু বরিস ব্যাকস্টপের অবসান ঘটিয়ে যেসব ছাড় আদায় করে নিয়েছেন, সেটি ব্রেক্সিটপন্থীদের কাছে বেশ বাহবাই পাচ্ছে।

যে কারণে কট্টর ব্রেক্সিটপন্থীরা এই চুক্তিতে সমর্থন দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। বর্তমানে স্বতন্ত্র হিসেবে পরিচিত কনজারভেটিভ পার্টির সাবেক ২৩ আইনপ্রণেতার মধ্যে অন্তত ১৮ জন চুক্তিতে সমর্থন দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ছাড়া লেবার পার্টির ব্রেক্সিটপন্থী সাত আইনপ্রণেতা থেরেসা মের চুক্তিতে সমর্থন দিয়েছিলেন। এই চুক্তিতে আরও বেশি লেবার আইনপ্রণেতার সমর্থন প্রত্যাশা করছে সরকার।