বিশ্বের বৃহত্তম ফেস রিকগনিশন ডেটাবেইস বানাবে ভারত

বিশ্বের সর্ববৃহৎ চেহারা শনাক্তকরণ ডেটাবেইস তৈরির প্রকল্প হাতে নিয়েছে ভারত। ছবি: রয়টার্স
বিশ্বের সর্ববৃহৎ চেহারা শনাক্তকরণ ডেটাবেইস তৈরির প্রকল্প হাতে নিয়েছে ভারত। ছবি: রয়টার্স

ভারতীয় একটি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) ‘বাচপান বাঁচাও আন্দোলন’ হয়ে কাজ করেন ভুবন রিভু। ১৫ মাস আগে প্রথম একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প হাতে নেন তিনি। পুলিশের ডেটাবেইসে থাকা হারিয়ে যাওয়া শিশুদের তালিকার সঙ্গে দেশের বিভিন্ন জায়গার পরিচয়হীন শিশুদের দেখভালকারী প্রতিষ্ঠানে থাকা শিশুদের চেহারা মিলিয়ে দেখতে শুরু করে তাঁর প্রতিষ্ঠান। ফলাফলটাও পেলেন হাতেনাতে, হারিয়ে যাওয়া প্রায় সাড়ে ১০ হাজার শিশুর পরিচয় উদ্ধার করেন তিনি।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ভুবন রিভু বলেছেন তাঁর সেই প্রকল্পের কথা। রিভু বলেছেন, ‘হারিয়ে যাওয়া ১০ হাজার ৫৬১ শিশুর পরিচয় নিশ্চিত হতে পেরেছি আমরা। তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। বেশির ভাগ শিশুই পাচারের শিকার। কেউ পোশাক কারখানায় কাজ করত, আবার কাউকে পতিতালয়ে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল।’

রিভুর এই উদ্যোগ সফল হওয়ার পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে নয়াদিল্লি পুলিশের ব্যবহার করা নতুন একটি প্রযুক্তি। প্রযুক্তিটির নাম ‘ফেস রিকগনিশন টেকনোলজি’, বাংলায় যাকে বলা যায় ‘চেহারা শনাক্তকরণ প্রযুক্তি।’ রিভু বলছেন, ‘ভারতে প্রায় ৩ লাখ হারিয়ে যাওয়া শিশু আছে। তাদের মধ্যে প্রায় ১ লাখ শিশু বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আওতায় আছে। প্রযুক্তির সহায়তা ছাড়া হয়তো এই উদ্যোগ সফল হতো না।’

সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিশু পাচার ভারতের অন্যতম বড় মাথাব্যথার কারণ। প্রতি ১ লাখ নাগরিকের জন্য ভারতে পুলিশ কর্মকর্তা আছেন মাত্র ১৪৪ জন। লোকবলের এই সংকট কাটিয়ে উঠতে তাই প্রযুক্তির দ্বারস্থ হচ্ছে ভারত। এরই মধ্যে অন্ধ্রপ্রদেশ ও পাঞ্জাব রাজ্যে অপরাধী শনাক্তকরণের জন্য এই প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু করেছে স্থানীয় প্রশাসন। ২০১৮ সালে ভারতে নয়াদিল্লির পুলিশের প্রথম এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা শুরু করে। এই প্রযুক্তির ব্যবহার এবার সম্পূর্ণ অন্য মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছে ভারত। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও কার্যকর ফেস রিকগনিশন ডেটাবেইস তৈরির প্রকল্প হাতে নিয়েছে দেশটি। বলা হচ্ছে, দেশটির ২৯টি রাজ্যের পুলিশ একযোগে এই ডেটাবেইসে ঢুকতে পারবে এবং কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির চেহারা শনাক্ত করতে পারবে।

প্রকল্পটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছে ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো। ১৭২ পৃষ্ঠার এক প্রতিবেদনে সংস্থাটি জানিয়েছে, দেশজুড়ে লাগানো অসংখ্য সিসিটিভি ক্যামেরা থেকে ডেটাবেইসের জন্য অপরাধীদের চেহারা সংগ্রহ করা হবে। এ ছাড়া সংবাদপত্র, সাধারণ মানুষের পাঠানো ছবি এবং নারী ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের ডেটাবেইসে থাকা ছবিও এই ডেটাবেইসে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

এই প্রকল্পের আওতায় সব পুলিশ সদস্যকে একটি বিশেষ মোবাইল ফোন দেওয়া হবে, যেখানে একটি অ্যাপ ইনস্টল করা থাকবে। ডেটাবেইসে থাকা চেহারার সঙ্গে কোনো অপরাধীর চেহারা মিলে গেলে ওই অ্যাপে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বার্তা পাঠানো হবে। এ ছাড়া অপরাধের ধরন শনাক্ত করতে এবং অপরাধপ্রবণতা কমিয়ে আনতেও সহায়তা করবে এই ডেটাবেইস, এমনটাও প্রত্যাশা করছে ভারত সরকার।

তবে অল্প সময়ের মধ্যে বিশাল এই প্রকল্পকে বাস্তবায়ন করাকে ‘প্রযুক্তিগতভাবে কঠিন’ বলে মনে করছেন প্রকল্পটির সঙ্গে যুক্ত শিবরাম কৃষ্ণান। বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের পর আট মাসের মধ্যে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চাইছে ভারত। তবে কৃষ্ণান বলছেন, বাস্তবসম্মতভাবে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে ১২ থেকে ১৮ মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।

ভারতজুড়ে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানোকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মানছেন বিশেষজ্ঞরা। ছবি: এএফপি
ভারতজুড়ে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানোকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মানছেন বিশেষজ্ঞরা। ছবি: এএফপি

কেন্দ্রীয় একটি ডেটাবেইস তৈরির কাজকে বড় চ্যালেঞ্জ মনে করছেন না কৃষ্ণান। বরং সিসিটিভি ব্যবস্থার সঙ্গে এই ডেটাবেইসের সমন্বয় করাটাই বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন তিনি। অপরাধীদের ছবিসংবলিত একটি কেন্দ্রীয় ডেটাবেইস আগে থেকেই ভারতের আছে। রাষ্ট্রের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো নিয়মিতই এই ডেটাবেইস আপডেট করে থাকে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো দেশজুড়ে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো ও সেগুলোর সঙ্গে কেন্দ্রীয় ডেটাবেইসের সংযোগ সাধন।

ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে প্রতি এক হাজার জনের জন্য মাত্র ১০টি সিসিটিভি ক্যামেরা রয়েছে। চীনের সাংহাই ও যুক্তরাজ্যের লন্ডনে এই হার যথাক্রমে ১১৩ ও ৬৮। ভারতের অনেক গ্রামে এখনো সিসিটিভি ক্যামেরাই পৌঁছায়নি। দ্রুততম সময়ের মধ্যে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো তাই প্রশাসনের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি বেঙ্গালুরুর বিমানবন্দরে এই চেহারা শনাক্তকরণ প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু হয়েছে। নয়াদিল্লি ও হায়দরাবাদ বিমানবন্দরেও পরীক্ষামূলকভাবে এই কার্যক্রম চালানো হয়েছে।

তবে এই প্রযুক্তির সঙ্গে নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি জড়িত আছে বলেও মনে করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। অপার গুপ্ত নামের এক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ভারতে কোনো তথ্য সুরক্ষা আইন নেই। নতুন এই প্রযুক্তির জন্য কোনো আইনি কাঠামো তৈরির প্রক্রিয়াও এখনো শুরু হয়নি। অর্থাৎ এই প্রকল্পে নিরাপত্তা ঝুঁকির সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।