কুর্দি হটাতে তুরস্কের সঙ্গে জোট রাশিয়ার

সিরিয়ার সীমান্ত থেকে কুর্দি বাহিনীকে হটাতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর। ছবি: রয়টার্স
সিরিয়ার সীমান্ত থেকে কুর্দি বাহিনীকে হটাতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর। ছবি: রয়টার্স

সিরিয়ার সীমান্ত থেকে কুর্দি বাহিনীকে হটাতে তুরস্কের সঙ্গে চুক্তি করেছে রাশিয়া। দুই দেশ এই চুক্তিকে ‘ঐতিহাসিক’ বলে আখ্যায়িত করেছে। চুক্তি অনুসারে, সিরিয়ার সীমান্ত এলাকা থেকে কুর্দিদের সরাতে তুর্কি সেনাদের সঙ্গে একজোট হয়ে টহল দেবে রুশ সেনারা।

আজ বুধবার বিবিসি ও সিএনএন অনলাইনের খবরে বলা হয়, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের বৈঠকের পর চুক্তির ঘোষণা আসে। রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে রিসোর্ট শহর সোচিতে আজ দুই নেতার বৈঠক হয়। বৈঠকে দুই নেতার মধ্যে ১০ দফার সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়।

এই চুক্তির জন্য সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ প্রেসিডেন্ট পুতিনকে ধন্যবাদ জানান এবং এ ব্যাপারে তাঁর পূর্ণ সমর্থন তুলে ধরেন।

মাত্র সাত দিন আগে রাশিয়া তুরস্ককে হুঁশিয়ার করে, তারা সিরিয়ায় হামলা সহ্য করবে না। রাশিয়ার মধ্যস্থতায় শর্তের বিনিময়ে কুর্দিদের সহায়তা করতেও সম্মত হয়েছিল সিরিয়ার সরকারি বাহিনী। যদিও কুর্দি নেতা বলেছিলেন, রাশিয়া ও সিরিয়ার আসাদ বাহিনীর ওপর চরম অবিশ্বাস ও অনাস্থা রেখেই নিজেদের লোকদের প্রাণ বাঁচাতে তাঁরা চুক্তি করতে সম্মত হয়েছেন।

এ মাসে সিরিয়া থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দেওয়ার পরপরই কুর্দি নেতৃত্বাধীন সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সকে (এসডিএফ) লক্ষ্য করে হামলা শুরু করে তুর্কি সেনারা। ওই অঞ্চল থেকে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) নির্মূলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান শক্তি হিসেবে কাজ করে এসডিএফ। তবে তুরস্ক উল্টো এসডিএফকে জঙ্গি সংগঠন বলে মনে করে। তুরস্ক সীমান্ত থেকে ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত ‘নিরাপদ অঞ্চল’ গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়ে সেখানে তুরস্কে অবস্থান নেওয়া সিরিয়ার শরণার্থীদের প্রায় ২০ লাখকে সরিয়ে নেওয়ার কথা বলছে। তবে শরণার্থীদের অনেকেই কুর্দি না হওয়ায় তুরস্কের এই পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হলে কুর্দিরা জাতিগত নিধনের শিকার হতে পারে বলে সতর্ক করছেন সমালোচকেরা। এ ছাড়া মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণার মধ্য দিয়ে ওই অঞ্চলে তুরস্ক ও রাশিয়ার অবস্থান শক্ত হলো বলেও মনে করা হচ্ছে।

রাশিয়া সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের প্রধান মিত্র। ২০১৫ সাল থেকে রুশ সেনা মোতায়েন রয়েছে সিরিয়ায়।

বলা হচ্ছে, রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে এই চুক্তির ফলে তুরস্ক কুর্দিদের দখল নেওয়া এলাকাগুলো পুনরায় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেবে। আর রাশিয়া সিরিয়ার বাহিনীর সঙ্গে বাকি এলাকাগুলোয় নজরদারি রাখবে।

তাল আবিয়াদ শহর দখলে নিয়েছে তুর্কি সমর্থিত সিরিয়ার বিদ্রোহীরা। ছবি: রয়টার্স
তাল আবিয়াদ শহর দখলে নিয়েছে তুর্কি সমর্থিত সিরিয়ার বিদ্রোহীরা। ছবি: রয়টার্স

চুক্তিটি ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পর তুরস্ক বলেছে, আবার হামলার প্রয়োজন নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুরস্কের চুক্তি অনুসারে সেখানে এখন যুদ্ধবিরতি চলছে। কুর্দি যোদ্ধাদের ‘নিরাপদ অঞ্চল’ ছেড়ে চলে যাওয়ার শর্তে ওই চুক্তিতে সম্মত হয়েছিল তুরস্ক।
তুরস্ক ইতিমধ্যে রাস আল-আইন ও তাল আবিয়াদ দুটি শহরের মধ্যের ১২০ কিলোমিটার অঞ্চল দখল করেছে।

নতুন চুক্তি অনুসারে, তুর্কি-কুর্দি দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাত এড়াতে রাশিয়া তুর্কি অভিযানে সম্মত হয়েছে।
চুক্তির বিষয়ে রাশিয়া ও তুরস্কের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, কুর্দি বাহিনীকে মানবিজ এবং তাল রিফাত শহর থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে। এই দুটি শহরই অভিযান এলাকার বাইরে অবস্থিত। কুর্দি বাহিনীরা যেন আর সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে তুরস্ক ও সিরিয়ার সীমান্তে ফিরতে না পারে, সে লক্ষ্যে তুর্কি বাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে ওই অঞ্চল টহল দেবে রাশিয়া।

তবে এসব দাবি মেনে নেবে কি না, এ ব্যাপারে কুর্দি মিলিশিয়ারা কোনো আভাস দেয়নি।

এক সপ্তাহ আগে সিরিয়ায় মস্কোর বিশেষ দূত আলেকজান্দ্রার লাভ্রেনতেভ বলেন, সিরিয়ায় তুরস্কের হামলা অগ্রহণযোগ্য, রাশিয়া এটা মেনে নেবে না। তিনি বলেন, কুর্দি ও সিরিয়া সরকারের মধ্যে চুক্তির ব্যাপারে রাশিয়া মধ্যস্থতা করেছে। চুক্তি অনুসারে কুর্দি নেতৃত্বাধীন বাহিনী সিরিয়ার সেনাদের কাছ থেকে সামরিক সহায়তা পাওয়ার বিনিময়ে তাদের (কুর্দি) নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল দেশটির কাছে সমর্পণ করবে।

তবে সিরিয়া সরকারের সঙ্গে করা চুক্তির ব্যাপারে শুরুতেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন কুর্দি নেতা। ‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক নিবন্ধে এসডিএফের প্রধান মাজলুম আবদি স্বীকার করেন, আসাদ সরকার ও এর রাশিয়া জোটের সঙ্গে এই চুক্তিটি তাঁদের জন্য ‘বেদনাদায়ক সমঝোতা’ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তিনি বলেন, ‘আমরা তাদের প্রতিশ্রুতির ওপর আস্থা রাখতে পারি না। কার ওপর ভরসা করতে হবে, তা জানাও কঠিন হয়ে পড়েছে। কিন্তু যদি আমাদের সমঝোতা ও আমাদের মানুষের গণহত্যার মধ্যে কোনো একটিকে বেছে নিতে হয়, তাহলে অবশ্যই আমরা আমাদের মানুষদের বেঁচে থাকার বিষয়টিকেই বেছে নেব।’

জাতিসংঘের তথ্য অনুসারে, গত দুই সপ্তাহে তুরস্কের অভিযানে উত্তর-পূর্ব সিরিয়া থেকে ৮০ হাজার শিশুসহ ১ লাখ ৭৬ হাজার মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে। সেখানে ৩০ লাখের বসবাস রয়েছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক পর্যবেক্ষণ গ্রুপ সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটসের তথ্য অনুসারে, এ যুদ্ধে ১২০ জন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হয়েছে। এ ছাড়া ২৫৯ জন কুর্দি যোদ্ধা এবং তুর্কি সমর্থিত ১৯৬ জন সিরিয়ার বিদ্রোহী ও ৭ জন তুর্কি সেনা নিহত হয়েছে।