হীরা ও হাতির ওপর নির্ভর যে নির্বাচন

ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের শুষ্ক এক দেশের নাম বতসোয়ানা। দেশটির মধ্য ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে রয়েছে কালাহারি মরুভূমি। কৃষিকাজে অনুপযোগী দেশটির অর্থনীতি টিকে আছে হীরার ওপর। আর সে অর্থনীতির টিকে থাকা নির্ভর করছে হাতির অত্যাচার দমন করার ওপর। আজ বুধবার বতসোয়ানার সাধারণ নির্বাচনে কে জিতবে, তা হীরা আর হাতির ওপরই অনেকটা নির্ভর করছে।

১৯৬৬ সালে স্বাধীনতার পর থেকে বতসোয়ানার প্রতিটি নির্বাচনে জয়ী হয়েছে ক্ষমতাসীন বতসোয়ানা ডেমোক্রেটিক পার্টি (বিডিপি)। তবে চলতি বছর গদি পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে। বিরোধী তিনটি দল আমব্রেলা ফর ডেমোক্রেটিক চেঞ্জের (ইউডিসি) অধীনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।

বিরোধী দলের ইশতেহারে এক লাখ মানুষকে চাকরি দেওয়ার অঙ্গীকারকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। বতসোয়ানা এমন একটি দেশ, যার ২০ শতাংশেরও বেশি মানুষ বেকার। আয় নিয়ে ক্রমেই দেশটিতে উদ্বেগ বাড়ছে। এমন সময় নিঃসন্দেহে এটি একটি আকর্ষণীয় প্রস্তাব।

ইউডিসির সহসভাপতি ডুমেলাং সেলসান্দো বিবিসি অনলাইনকে বলেন, ‘এ দেশের অর্থনীতি নাগরিকদের বাদ দিয়েই এগিয়ে চলেছে। আপনি যদি নির্মাণ শিল্পের দিকে তাকান, সেটি চীনা অধ্যুষিত খাত। খুচরা ব্যবসার দিকে তাকান, এটি এশীয় অধ্যুষিত। এই দেশে ঘরোয়া শিল্প ছাড়া আর কোথাও বতসোয়ানার আধিপত্য নেই।’

হীরার ওপর টিকে থাকা একটি দেশের গল্প
বতসোয়ানা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম হীরা উৎপাদনকারী দেশ। একে আফ্রিকার সাফল্যের গল্প হিসেবে অভিহিত করা হয়। প্রতিবেশী কিছু দেশের মতো রক্তক্ষয় না করেই বতসোয়ানার স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল। দেশটিতে কখনো গৃহযুদ্ধ হয়নি। এখানকার নির্বাচনে সাধারণত সহিংসতার কোনো ঘটনা ঘটে না।

বতসোয়ানার সৌভাগ্য অনেকটাই হীরার ওপর নির্ভর করে। দেশজুড়ে চারটি খনি থেকে বিশ্বের সবচেয়ে ভালো মানের হীরা উত্তোলন করা হয়। রাশিয়া সামগ্রিকভাবে আরও বেশি হীরা উৎপাদন করলেও মানের দিক থেকে বতসোয়ানা সেরা। ‘বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় হীরক সংস্থা’ বলে দাবি করা ডি বিয়ার্স কোম্পানির সঙ্গে একচেটিয়া ভার্চ্যুয়াল আধাআধি শেয়ারে ব্যবসা করছে দেশটি।

কোম্পানিটির সঙ্গে চুক্তির জেরে গত বছর দেশটির সরকারি আয়ে সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার যোগ হয়। এ বাণিজ্য দেশের মোট অর্থনীতির প্রায় ৪০ শতাংশের সমান।

এই অর্থ রাস্তাঘাট, স্কুল ও হাসপাতাল তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে ৫০ বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে যাওয়ায় জনগণের মনে বিশ্বাস জন্মেছে, তাদের ভাগ্যে আরও বেশি কিছু জোটা উচিত। এই বছর দুর্নীতির গুজব জনগণের সঙ্গে সরকারের সম্পর্কে টানাপোড়েন সৃষ্টি করতে ভূমিকা রেখেছে।

২০২০ সালে ডি বিয়ার্সের সঙ্গে অংশীদারত্ব নবায়নের সময় হয়ে যাচ্ছে। এটি নির্বাচনে একটি বড় ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। বিবিসি আয়োজিত এক বিতর্কে প্রথম প্রশ্নটিই করা হয় এই চুক্তি নিয়ে। আরও ভালো চুক্তি করা যেত কি না, বিতর্কে তা জানতে চাওয়া হয়।

দেশটির পরিবহন ও যোগাযোগমন্ত্রী ডরকাস মাকগাটো চুক্তির বিষয়ে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘হীরা আমাদের ভবিষ্যৎ। বিশ্বে হীরা উৎপাদনে আমরা সবচেয়ে এগিয়ে আছি। তাই হীরাকে তার যোগ্য সম্মান এবং ভালোবাসা না দিলে তা আমাদের জন্যই আত্মঘাতী হবে।’ তবে চুক্তিটি গোপন রাখতে হয়েছিল বলে জানান তিনি।

মাকগাটোর সঙ্গে সেলসান্দো একমত নন। তিনি বলেন, ‘এখানকার পঁচানব্বই ভাগ মানুষ হীরা চোখে দেখেনি। প্রকৃতপক্ষে, বতসোয়ানা হীরাকে পুঁজি করে বিদেশে ভালো বেতনের চাকরির ক্ষেত্র তৈরি হয়। আমরা কেবল গর্তই খুঁড়ছি।’

বিশ্ব ব্যাংকের মতে, হীরার প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও আয় বৈষম্যের হারের দিক থেকে বতসোয়ানা বেশ এগিয়ে রয়েছে। দেশের জনগণ এখন এ নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।

বতসোয়ানা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম হিরা উৎপাদনকারী দেশ। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
বতসোয়ানা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম হিরা উৎপাদনকারী দেশ। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

ভাগ্যনির্ধারক হাতি
বতসোয়ানা নিঃসন্দেহে বিশ্বের একমাত্র দেশ, যেখানে হাতি একটি ওজনদার নির্বাচনী ইস্যু।

অল্পসংখ্যক মানুষের দেশটি আফ্রিকার অন্যতম বিশাল পশু পালন ক্ষেত্র। মানব প্রাণীর সংঘাত দেশটির নিত্যদিনের দুশ্চিন্তার কারণ। সাবেক প্রেসিডেন্ট আয়ান খামার অধীনে বতসোয়ানা প্রাণী সংরক্ষণের এক অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। এই সুযোগে স্মার্ট হাতিরা অভিবাসী হয়ে পাড়ি জমিয়েছে বতসোয়ানায়। তবে এর জন্য দেশটিকে চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে।

প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার হাতি পুরো পরিবেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে। প্রায়ই হাতির পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। খেতের পর খেত এক দিনে উজাড় হয়ে যাচ্ছে। পর্যটকদের কাছে ব্যাপারটিকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে সরকারকে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে।

প্রেসিডেন্ট মকগেওয়েসি মাসিসি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কী মনে করবে, সে বিষয়ে তাঁর পূর্বসূরির চেয়ে কম উদ্বিগ্ন। তিনি বলেছেন, ব্রিটিশরা যখন হাতি এতই পছন্দ করে, বতসোয়ানার হাতির সঙ্গে তবে তারাই থাকুক না। বন্য প্রাণী শিকারের ওপর পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্টের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তিনি প্রত্যাহার করেছেন।

এ সিদ্ধান্তটি বিতর্কিত কি না জানতে চাইলে আলবার্ট লেবালা বলেন, ‘হাতি এবং মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে। তারা মানুষকে হত্যা করছে। সুতরাং আমি মনে করি, হাতিদের হত্যা করা একটি ভালো উদ্যোগ।’

কেওরপেটেস এমপোলোকাং তার সঙ্গে একমত হয়ে বলেন, ওরা ফসলের অনেক ক্ষতি করেছে।

প্রেসিডেন্ট মাসিসি আর খামার মধ্যে হাতি একটি দ্বন্দ্বের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। খামা দেশের প্রতিষ্ঠাতা এবং বতসোয়ানার কেন্দ্রস্থলের এক গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক নেতা। কাজেই তিনি দল থেকে বের হয়ে বতসোয়ানা প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্ট (বিপিএফ) গঠন করলে দেশটির জন্য তা বড় একটি সংবাদ। আয়ান খামার ভাই শিখেকি খামা মাসিসির মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করে ভাইয়ের দলে যোগ দিয়ে বিডিপির বিরুদ্ধে মাঠে নামছেন।

বতসোয়ানায় সত্যিকার অর্থে তেমন কোনো ভোট গ্রহণ প্রথা নেই। তবে জনগণ মন্তব্য করছেন, এবার সরকার পরিবর্তনের জোরদার সম্ভাবনা রয়েছে।

তবে অপরাজিত বিডিপি নির্বাচনে জয়ী হওয়ার মেশিনে পরিণত হয়েছে। জনগণ জিম্বাবুয়ের দিকে তাকিয়ে উপলব্ধি করতে পারে, পার্শ্ববর্তী অনেক দেশের তুলনায় তারা বেশ ভালোই আছে।

ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মালিক ম্যানি বলেন, বিডিপি নিশ্চয়ই ভালো দল। তবে নিজেদের গণ্ডির বাইরে গিয়ে তারা কিছুই করতে পারে না। তবে অন্য কোনো দলের ক্ষমতায় থাকার অভিজ্ঞতা না থাকায় তারা ক্ষমতায় এলে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন রাজনীতিবিদেরা।

একনজরে বতসোয়ানার নির্বাচন

বিডিপি-স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিবারের নির্বাচনে মকগেওয়েসি মাসিসির নেতৃত্বে জয়ী হয়েছে

ইউডিসি-ডুমা বোকোর নেতৃত্বে ২০১২ সালে জোট গঠিত হয়েছে

বিপিএফ-সাবেক প্রেসিডেন্ট আয়ান খামার প্রতিষ্ঠিত দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিগি বুটেল