পিছিয়ে যাচ্ছে ব্রেক্সিট, সরকারের পরিকল্পনা রুখে দিল পার্লামেন্ট

‘বাঁচি আর মরি, ৩১ অক্টোবর ব্রেক্সিট কার্যকর হবে’—এমন জোরালো প্রতিশ্রুতি দিয়ে দায়িত্ব নিয়েছিলেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। এখন তিনি সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের দ্বারপ্রান্তে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে যুক্তরাজ্যের বিচ্ছেদ ‘ব্রেক্সিট’ নামে পরিচিত, যা ‘ব্রিটেন এক্সিট’–এর সংক্ষিপ্ত রূপ।

পার্লামেন্ট সরকারের চুক্তিবিহীন বিচ্ছেদের পরিকল্পনা আটকে দিয়েছে আগেই। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী বরিস মাত্র তিন দিনে ব্রেক্সিট বিল পাস করিয়ে নেওয়ার যে পরিকল্পনা করেছিলেন, সেটিও গত মঙ্গলবার প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছেন আইনপ্রণেতারা। ফলে, ৩১ অক্টোবর ব্রেক্সিট কার্যকর করার কোনো ক্ষমতা আর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর হাতে রইল না। সেই সঙ্গে ব্রেক্সিট নিয়ে চলমান অচলাবস্থা আরও দীর্ঘায়িত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল হলো।

মঙ্গলবার যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ভোটাভুটি হয়। প্রথম ভোটাভুটি ছিল ইইউর সঙ্গে সম্পাদিত ব্রেক্সিট চুক্তির বিলের (উইথড্রোয়াল অ্যাগ্রিমেন্ট বিল) ওপর। বিলের পক্ষে ভোট পড়ে ৩২৯। আর বিপক্ষে ২৯৯টি। ব্রেক্সিট বিল পার্লামেন্টের সমর্থন পাওয়ার এটি প্রথম কোনো ঘটনা। তবে এটি সংসদে আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ, যা ‘সেকেন্ড রিডিং’ নামে পরিচিত। পরের ধাপ ‘কমিটি স্টেজ’। এ ধাপে বিলের ওপর নানা সংশোধনী প্রস্তাব আনতে পারেন আইনপ্রণেতারা। আর ব্রেক্সিট বিলে যে বিরোধীদের তরফ থেকে নানা সংশোধনী প্রস্তাব আসবে এবং ওই সব প্রস্তাব নিয়ে বিতর্কের জন্য ব্যাপক সময়ক্ষেপণ হবে, তা সহজেই অনুমেয়।

এ কারণেই অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় ভোটাভুটি। যাতে সরকারের পক্ষ থেকে তিন দিনের মধ্যে ব্রেক্সিট বিল নিয়ে বিতর্ক সম্পন্ন করার প্রস্তাব করা হয়। এ প্রস্তাবে ৩২২ বনাম ৩০৮ ভোটে হেরে যায় সরকার। বিরোধীরা মনে করে, ব্রেক্সিট বিল যাচাই-বাছাইয়ের জন্য তিন দিন যথেষ্ট নয়।

প্রতিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন তাঁর ব্রেক্সিট বিলে সমর্থন দেওয়ার জন্য আইনপ্রণেতাদের ধন্যবাদ জানান। তবে বিলটি পাসে প্রস্তাবিত সময়সূচি প্রত্যাখ্যান করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, আগে হোক পরে হোক, এই বিলের ভিত্তিতেই ব্রেক্সিট কার্যকর হবে। বরিস বলেন, পার্লামেন্টের চাওয়া পূরণে ব্রেক্সিট পিছিয়ে দেওয়ার আবেদন করা হয়েছে। এখন ইইউকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা ব্রেক্সিটের দিনক্ষণ পেছাবে কি না।

বরিস আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন, প্রস্তাবিত সময়সূচি অনুমোদন না করলে তিনি বিলের কার্যক্রম স্থগিত করবেন এবং সাধারণ নির্বাচনের পথ বেছে নেবেন। ঘোষণামতো তিনি বিলের কার্যক্রম স্থগিত করেন।

বিরোধী দলগুলো বিলের কার্যক্রম স্থগিত করাকে শিশুসুলভ আচরণ বলে আখ্যায়িত করে। ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভদলীয় প্রবীণ আইনপ্রণেতা কেনেথ ক্লেয়ার্ক প্রধানমন্ত্রীকে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, পার্লামেন্ট তাঁর বিলে সমর্থন দিয়েছে। এখন যাচাই-বাছাইয়ের জন্য একটু বাড়তি সময় চায়। বিল পাশের স্বার্থে বিচ্ছেদের দিনক্ষণ কিছুদিন পেছালে ক্ষতির কিছু নেই বলে তাঁর মন্তব্য।

লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন বিতর্কের জন্য উপযুক্ত সময় নির্ধারণে সরকারের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দেন। সর্বশেষ আজ বুধবার অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে সময়সূচি নিয়ে সমঝোতার জন্য আলোচনায় বসেন বরিস ও করবিন। এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বৈঠকের সিদ্ধান্ত জানা যায়নি।

ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভোটাভুটির এমন ফলাফলের প্রতিক্রিয়ায় ইইউ কমিশনের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাস্ক বলেছেন, ব্রেক্সিটের দিনক্ষণ পিছিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি সদস্যদেশগুলোকে পরামর্শ দেবেন।

চুক্তিবিহীন বিচ্ছেদ ঠেকাতে যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে প্রণীত আইন অনুযায়ী, ইইউতে পাঠানো চিঠিতে ব্রেক্সিটের দিনক্ষণ ২০২০ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত পিছিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে। এখন ইইউ কত দিনের জন্য বিচ্ছেদ পিছিয়ে দেয়, তার ওপর নির্ভর করছে যুক্তরাজ্যে পরবর্তী রাজনীতির মোড়।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্রে বলা হয়েছে, লম্বা সময়ের জন্য ব্রেক্সিট পেছালে দ্রুত সাধারণ নির্বাচনের পর বেছে নেবে সরকার। তবে আগাম নির্বাচন ডাকার কাজটিও নির্ভর করছে পার্লামেন্টের দুই-তৃতীয়াংশ আইনপ্রণেতার সমর্থনের ওপর। ইতিমধ্যে দুই দফা আগাম নির্বাচনের প্রস্তাব পাসে ব্যর্থ হয়েছেন বরিস জনসন। তখন বিরোধী দলগুলোর দাবি ছিল, ৩১ অক্টোবর চুক্তিবিহীন বিচ্ছেদ ঘটছে না—এমনটা নিশ্চিত হওয়ার পর তাঁরা আগাম নির্বাচনে সমর্থন দেবেন।

এখন ব্রেক্সিট পিছিয়ে গেলে আগাম নির্বাচনে সমর্থন দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে লিবারেল ডেমোক্র্যাট এবং স্কটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি। এবার লেবার পার্টিও আগাম নির্বাচনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের বাহানা পাবে না।