উগ্রবাদ ছড়িয়ে উত্থান বাগদাদির

তিনি ছিলেন ঘৃণার প্রচারক। পলাতক এই আসামিকে ড্রোন দিয়েও খোঁজা হয়েছিল। মাত্র একবারই প্রকাশ্যে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। তিনি স্বঘোষিত খেলাফতের খলিফা এবং জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) নেতা আবু বকর আল-বাগদাদি। তিনি তাঁর জঘন্য এক আদর্শের মাধ্যমে বঞ্চিত সংখ্যালঘুদের প্রলুব্ধ করেছেন। ইসলামকে ভুল পথে চালিত করেছেন। তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসের উত্থানটা যতটা রাতারাতি, পতনটাও ঠিক দ্রুত ঘটেছে। এর আগে একাধিকবার বাগদাদির মৃত্যুর গুজব ছড়ালেও গতকাল রোববার যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিত করেছে, মার্কিন বাহিনীর বিশেষ অভিযানে বাগদাদির মৃত্যু হয়েছে।

বিভিন্ন জিহাদি ওয়েবসাইট ও অন্যান্য সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, আবু বকর আল-বাগদাদির জন্ম ১৯৭১ সালে, ইরাকের দিয়ালা বা সামারায়। রাজধানী বাগদাদের ইসলামিক ইউনিভার্সিটিতে পড়েন তিনি। পিএইচডি করেন ইসলামের সংস্কৃতি ও দর্শন নিয়ে। বিভিন্ন জিহাদি গ্রন্থে তাঁর পুরো নাম দেওয়া হয়েছে—ইব্রাহিম বিন আওয়াদ বিন ইব্রাহিম আল-বাদরি আল-রাধউই আল-হুসেইনি আল-সামারাই। বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের আগ পর্যন্ত সামারার মসজিদের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন বাগদাদি। মার্কিন আগ্রাসন শুরুর পরপরই ইরাকে সুন্নি জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দেয়। পরের বছরই জঙ্গিবাদের অভিযোগে গ্রেপ্তার হন বাগদাদি।

বাগদাদি ছিলেন ইরাকের সুন্নিদের ওপর পুরোপুরি ক্ষুব্ধ। কিন্তু পরে তিনি ওই সুন্নিদেরই নিজের সমর্থক বানান। ইরাকের সিয়া ও সুন্নি মুসলমানদের মধ্যে উত্তেজনার খুব নির্মমভাবে ইতি টানেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন, যার কারণে সেই সময়েই সুন্নিদের মনে রোপিত হয়েছিল আইএসের উত্থান ঘটার মতো প্রতিহিংসাপরায়ণতার বীজ।

ধারণা করা হয়, কারাবাসই বদলে দেয় বাগদাদিকে। ইরাকে আইএসের নেতা হিসেবে উত্থান হয় তাঁর। এর আগে ইরাককে মানুষ চিনত জঙ্গিগোষ্ঠী আল-কায়েদার জন্য। ২০০৬ সালে মার্কিন বোমা হামলায় আল-কায়েদা নেতা আবু মুসাব আল-জাওয়াহিরির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জঙ্গি সংগঠনটির কর্মকাণ্ড কমে আসতে শুরু করে। বলা হয়ে থাকে, নিষ্ঠুর কৌশলের কারণে আল-কায়েদা তার সমর্থন হারাতে শুরু করে এবং ২০১০ সালে এসে সংগঠনটিতে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এ সময় ইরাকের সুন্নিদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে উগ্রবাদ ছড়িয়ে সংগঠনটিকে রূপান্তরের চেষ্টা করেন বাগদাদি। তখন তাঁর বয়স ছিল ৩৯ বছর। ইরাকের অস্থিরতা ও সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ এ সময়ে বাগদাদির মনোবাসনা পূরণের জন্য উপহার বা আশীর্বাদ হয়ে আবির্ভূত হয়। একপর্যায়ে বাগদাদি ইরাক ও সিরিয়া জুড়ে দখলকৃত এলাকায় খেলাফত ঘোষণা করেন।

বাগদাদি যখন খেলাফত ঘোষণা করেছিলেন, তা আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের কাছে বেশ হাস্যকর ঠেকেছিল। কারণ, কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীই এভাবে এলাকা দখল করে না। কিন্তু অচিরেই আইএসের খেলাফত আয়তনে বড় হতে থাকে। এতে যোগ দিতে থাকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা আইএসের আদর্শে উদ্বুদ্ধ মানুষ। পশ্চিমা বিশ্বে ঘটা বেশ কিছু বড় হামলার দায়ও স্বীকার করে আইএস। এভাবে আইএসের নাম ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। এরপর প্রকাশ পায় আইএস জঙ্গিদের হাতে নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া বিদেশি নাগরিকদের ভিডিও। তাঁদের অনেককেই শিরশ্ছেদ করে হত্যা করা হয়।

একপর্যায়ে মার্কিন সাংবাদিক জেমস ফোলের হত্যাকাণ্ডের ভয়ংকর এক ভিডিও প্রকাশ পায়। এর পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসন আইএসের বিরুদ্ধে দৃঢ় সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এভাবেই আইএসের বিরুদ্ধে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের যুদ্ধ শুরু হয়।

২০১৪ সালে ইরাকের মসুল থেকে ক্রোধোদ্দীপ্ত এক বক্তৃতা দিয়েছিলেন বাগদাদি। এরপর তাঁকে আর দেখা যায়নি। তবে, ২০১৫ সালে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছিল, মার্কিন হামলায় বাগদাদি গুরুতর আহত হয়েছেন। যদিও পেন্টাগন ওই তথ্য নিশ্চিত করেনি। এরপর ২০১৭ সালে মার্কিন মদদপুষ্ট অন্যান্য বাহিনী সিরিয়ায় আরও অগ্রসর হলে একাধিক প্রতিবেদনে আবারও বলা হয়, বাগদাদি গুরুতর আহত হয়েছেন। কিন্তু ২০১৮ সালে আইএস বাগদাদির একটি অডিও প্রকাশ করে, যাতে তাঁকে জঙ্গিগোষ্ঠীটির পতনের মুখে পড়ার কথা স্বীকার করতে শোনা যায়। এরপর এ বছর সবশেষ বাগাদাদির একটি ভিডিও প্রকাশ করেছিল আইএস। এরপর গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দেন, মার্কিন বাহিনীর অভিযানে বাগদাদি নিহত হয়েছেন।