বাবরি মসজিদ মামলার রায় নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে

ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে রায়ের খবর।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে রায়ের খবর।

অযোধ্যার বিতর্কিত ২.৭৭ একর জমি নিয়ে গতকাল শনিবার রায় দিলেন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। রায়ে বলা হয়েছে, অযোধ্যার বিতর্কিত জমি শর্তসাপেক্ষে দেওয়া হোক হিন্দুদের। মুসলিমদের মসজিদ তৈরির জন্য বিকল্প জমি দেওয়া হোক। শীর্ষ আদালত নির্দেশ দিয়েছেন,৩-৪ মাসের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারকে তৈরি করতে হবে ট্রাস্ট। সেই ট্রাস্ট ওই জমিতে মন্দির নির্মাণের জন্য রূপরেখা তৈরি করবে। আর অযোধ্যাতেই মসজিদের জন্য মুসলিম সুন্নি ওয়াক্ফ বোর্ডকে দেওয়া হবে ৫ একর বিকল্প জমি।

ঐতিহাসিক রায় দিতে গিয়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ আরও বলেছিলেন, ৯২ সালে মসজিদ ভাঙা বে–আইনি কাজ ছিল। বাবরি মসজিদ ভাঙা নিয়ে মামলা চলছে লক্ষ্ণৌয়ের সিবিআই আদালতে। সুপ্রিম কোর্টের এ পর্যবেক্ষণ যথেষ্ট তাৎপর্য বলে মনে করা হচ্ছে।

সুপ্রিম কোর্ট এ দিন রায়ে আরও বলেছেন, জমির স্বত্ব ধর্মীয় ভাবনার ভিত্তিতে দেওয়া যেতে পারে না। হিন্দুরা ঐতিহাসিকভাবে বিশ্বাস করে, অযোধ্যা রামের জন্মভূমি। বিতর্কিত জমির বাইরের অংশের মালিকানা হিন্দুদের ছিল, তার প্রামাণ্য দলিল রয়েছে।

তবে সুপ্রিম কোর্টের এই রায় নিয়ে ভারত জুড়ে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের মধ্যে স্বস্তির পাশাপাশি রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। দেশের সরকার প্রধান থেকে আমজনতা সবার বক্তব্য উঠে এসেছে ভারতসহ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ছবি: এএফপি
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ছবি: এএফপি

গতকাল সুপ্রিম কোর্ট যখন রায় ঘোষণা করছিলেন তখন করতারপুর করিডর উদ্বোধনে ব্যস্ত ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ফাঁক পেয়ে টুইট করলেন, ‘রায় কারও জয় বা পরাজয় নয়। রাম-ভক্তি হোক বা রহিম-ভক্তি, রাষ্ট্র ভক্তিকেই শক্ত করতে হবে।’

দিল্লি ফিরেই মোদি সিদ্ধান্ত নিলেন, জাতির উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিতে ফের আসবেন টিভির পর্দায়। বললেন, ‘ভারতের বিচার বিভাগের ইতিহাসে এই দিনটি একটি স্বর্ণালি অধ্যায়’। ভারতীয় গণতন্ত্রের শক্তির প্রশংসা করে বললেন, কোর্টের রায়কে গোটা দেশ খোলা মনে মেনে নিয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট রাম মন্দির নির্মাণের পক্ষে যে রায় দিয়েছে, তাতে তিনি সন্তুষ্ট।

রায় ঘোষিত হওয়ার অল্প ক্ষণের মধ্যেই টুইটারে শাসক দলের সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ লিখলেন ‘মিল কা পত্থর’, অর্থাৎ, মাইলফলক।

ওদিকে, মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড স্পষ্ট জানিয়ে দিল, এই রায়ে তারা সন্তুষ্ট নয়। বোর্ডের কৌঁসুলি শুধু বলেছেন, ‘রায়কে সম্মান করি’। প্রথমে তারা এ ব্যাপারে রিভিউ পিটিশন করার কথা বললেও পরে কিছু জানায়নি।

কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। ছবি: এএফপি
কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। ছবি: এএফপি

বিজেপি এবং আরএসএস নেতৃত্ব প্রত্যাশিত ভাবেই রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন। কংগ্রেসের মুখেও একই সুর নেই। রায় মেনে নিয়ে সবাইকে শান্তি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে দলটি আহ্বান জানিয়েছে। কংগ্রেসের সাবেক সভাপতি রাহুল গান্ধী সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে বিতর্কিত জমিতে রাম মন্দির নির্মাণ বা বিকল্প জমিতে মসজিদ তৈরির প্রসঙ্গ নিজের টুইটে উল্লেখ করেননি রাহুল। শুধু আদালতের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানানোর এবং নিজেদের মধ্যে সদ্ভাব বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।

এক বিবৃতিতে কংগ্রেস বলেছে, ‘অযোধ্যা মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়কে সম্মান করি। আমাদের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধ ও ভ্রাতৃত্বের চেতনা মেনে চলতে সব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানাই।’ দলটির মুখপাত্র রণদীপ সূর্যওয়ালাকে বলেছেন, ‘যুগে যুগে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ঐক্য আমাদের সমাজকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে, তা পুনরায় নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের প্রত্যেকের।’

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বিষয়টিকে এড়িয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন, রাজ্য ঘূর্ণিঝড় বুলবুল মোকাবিলা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা।

এমআইএম প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়েইসি ছাড়া কোনো রাজনৈতিক নেতাকে অযোধ্যা মামলার এই রায়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে দেখা যায়নি। তাঁর মন্তব্য, ‘রায়ে তথ্য–প্রমাণকে হারিয়ে আস্থা-বিশ্বাসের জয় হয়েছে।’’

আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং প্রশাসনিক বিভাগের জনসংযোগ আধিকারিক শাফে কিদোয়াই বলছেন, ‘আগে অপছন্দ হলে মুখের ওপরে কথা বলা যেত। তা তিনি যে সম্প্রদায়েরই হোন না কেন। কিন্তু এখন সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কথা বলতে ভয় পাচ্ছে। সাধারণ তর্ক করতেও ভয় পাচ্ছে। এই ভয় থেকেই মুসলিম সমাজও নিজেদের বাঁচাতে পরিচয় সত্তার রাজনীতি (আইডেনটিটি পলিটিকস) করতে শুরু করেছে বলেই মনে করেন তিনি।’

উত্তর প্রদেশের অন্য দুই প্রধান রাজনৈতিক শক্তি সমাজবাদী পার্টি বা বহুজন সমাজ পার্টির শীর্ষ নেতৃত্বের তরফ থেকে কোনো মন্তব্য করা হয়নি। বামেরা সব দিক বাঁচিয়ে বয়ান দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।

প্রত্যাশিত ভাবেই উচ্ছ্বসিত রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)। এ দিনদুপুরে সাংবাদিক সম্মেলন করে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে স্বাগত জানান আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত। এই রায়কে কারও হার বা কারও জয় হিসেবে দেখা উচিত নয়—বলেন তিনি। সরকার কোথায় এবং কীভাবে ৫ একর জমি সুন্নি বোর্ডকে দেবে, তা নিয়ে যে তিনি মাথা ঘামাতে রাজি নন, সে বার্তা নিজের সাংবাদিক সম্মেলনে বেশ স্পষ্ট ভাবেই দেন তিনি। শুধুমাত্র রাম মন্দির তৈরি নিয়েই যে সংঘ ভাবছে, অন্য কিছু নিয়ে নয়, সে কথাও কোনো রাখঢাক না করেই বলেন।

উত্তর প্রদেশের সুন্নি ওয়াক্ফ বোর্ড এই রায়ে খুশি নয়। ওয়াক্ফ বোর্ডের কৌঁসুলি জাফরিয়াব জিলানি এ দিন বলেন, ‘রায়কে আমরা সম্মান জানাচ্ছি। কিন্তু এই রায়ে খুশি নই।’ পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, এই রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন করা হবে কি না, তা আলোচনা করে স্থির করা হবে বলে তিনি জানান। মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের তরফে বলা হয়, এ ভাবে মসজিদ কাউকে হস্তান্তর করা যায় না।

ভারতের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অযোধ্যা জমি মামলার রায়। এক শতাব্দীর পুরোনো মামলা অযোধ্যা। চূড়ান্ত পর্বে টানা ৪০ দিন ধরে চলেছে শুনানি। অযোধ্যা জমি মামলার চূড়ান্ত শুনানির জন্য, জানুয়ারি মাসে ৫ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ গঠন করে সুপ্রিম কোর্ট। প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের সঙ্গে ছিলেন বিচারপতি অশোক ভূষণ, ডিওয়াই চন্দ্রচূড়, এসএ বোবদে এবং এস আবদুল নাজির। গত ১৬ অক্টোবর রায়দান স্থগিত রাখে শীর্ষ আদালত। শুনানির শেষ দিনে সুন্নি ওয়াক্ফ বোর্ড জমির দাবি ছেড়ে দিতে রাজি বলে খবর ছড়ায়। যদিও আদালতের নির্দেশে শুনানির পর তারা নির্দিষ্টভাবে বিতর্কিত জমিতে মসজিদ তৈরির দাবি জানায়। হিন্দু মহাসভা রাম মন্দির নির্মাণ-সহ পুরো জমিটিই দাবি করে। আর নির্মোহী আখাড়া আরজি জানায় হিন্দুদের অন্য পক্ষের হাতে জমির অধিকার গেলেও পুজো করার অধিকার তাদেরই দিতে হবে।

বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি। ছবি: এএফপি
বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি। ছবি: এএফপি

রাম মন্দির দাবির জন্য প্রচার চালানো বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি রায়ের পর বলেছেন, সার্থক হয়েছে তাঁর রাম জন্মভূমি আন্দোলন। নব্বইয়ের দশকে সোমনাথ থেকে রথযাত্রা শুরু করেছিলেন বর্ষীয়ান নেতা। সেই রথযাত্রায় তাঁর সারথী ছিলেন নরেন্দ্র মোদী। সেই রথযাত্রাই উসকে দিয়েছিল হিন্দুত্বের আবেগ।

লালকৃষ্ণ আদভানি বলেন, ‘আজ স্বপ্নপূরণ হয়েছে। রাম মন্দির নির্মাণের গণ-আন্দোলনে আমাকেও অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছিলেন ঈশ্বর। স্বাধীনতা পর এটাই ছিল সবচেয়ে বড় আন্দোলন। সুপ্রিম কোর্টের আজকের রায়ে তা সার্থক হলো।’

রায় ঘোষণার সময়ে আদালত চত্বর ঘেরা ছিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভার সাধু সন্ত মহন্তে। স্বামী চক্রবাণী মহারাজ বাজিয়েছেন শাঁখ। রায় আসার পর সন্তেরা আদালত চত্বরেই জয়ধ্বনিতে ফেটে পড়েছেন।

রায়–পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় সমাজবিজ্ঞানী আশিস নন্দীর কথায়, ‘এখন প্রধানমন্ত্রীর হাতে যা ক্ষমতা তার ধারে কাছে কেউ নেই। সেটা আরএসএস-ও জানে। এটাও ঘটনা যে দেশের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ই মোদীর শক্তির উৎস অর্থাৎ তাঁর ভোট ব্যাংক। ফলে সমাজের এই অংশের মন জয় করে চলাটাই বিধেয় মোদীর কাছে। এই কার্যকারণ থেকেই দেশকে হিন্দু রাষ্ট্রের অভিমুখে চালনা করার প্রশ্নটা উঠে আসছে।’

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক অশোক মজুমদার অবশ্য জানাচ্ছেন, ‘বিশ্বাস করি না যে গোটা দেশ হিন্দু রাষ্ট্রের পথে হাঁটছে। নিচের তলায় হিন্দুত্বের আস্ফালন থাকলেও তা সমাজের সর্ব স্তরে পৌঁছায়নি।’

ভারতের সংবিধান বিশেষজ্ঞদের ব্যাখ্যা, হিন্দু দেবতাদের ‘জুরিস্টিক পারসন’ বা আইনের চোখে ব্যক্তি হয়ে ওঠার সূত্রপাত ব্রিটিশ জমানায়, ‘ইংলিশ কমন ল’ থেকে। প্রবীণ আইনজীবী আদীশ চন্দ্র আগরওয়াল বলেন, ‘আইনের চোখে ব্যক্তি হিসেবে দেবতার সব রকম আইনি অধিকার রয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়, তিনিও মামলা করতে পারেন। তবে তাঁর সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার নেই। তা শুধু দেশের নাগরিকদের জন্য।’

কলকাতার অধ্যাপক মীরাতুন নাহার এ বিষয়ে বিবিসি বাংলাকে বলেন, “একটা সম্পূর্ণ ‘তৈরি করা বিবাদ’ যে এভাবে দেশের শীর্ষ আদালত পর্যন্ত গড়াতে দেওয়া হলো, আমি তাতে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। দেশপ্রেমী একজন ভারতীয় নাগরিক হিসেবে আমি ভাবতেই পারি না, যাদেরকে আমরা দেশের ক্ষমতায় বসিয়েছি তারা কীভাবে ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতিকে এভাবে উসকানি দিতে পারেন! শুধুমাত্র নিজেদের সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থের কথা ভেবে তারা ভারতের মহান সংবিধানকেও অপমান করলেন। ” তিনি আরও বলেন, “জমির দখল নিয়ে বিবাদ, সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ দুটো পরিবারের মধ্যে হয়, কখনো বা কোর্টেও গড়ায়-এটাই চিরকাল জেনে এসেছি। কিন্তু সেই জমির বিবাদকে ঘিরে দেশের দুটো ধর্মীয় সম্প্রদায়কেও যে লড়িয়ে দেওয়া যায় তা কখনো ভাবতেও পারিনি—আর সে কারণেই পুরো বিষয়টা আমার কাছে এতটা কষ্টদায়ক! আজকের রায় নিয়ে আর কী বলব? কোর্টে গেলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে, তাই সেটা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার মানে হয় না। আমার প্রশ্ন তাই একটাই, এই যে বিবাদ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়া হয়েছিল সেটা কি আপনা থেকেই তৈরি হয়েছিল না কি সচেতনভাবে গড়ে তোলা হয়েছিল?

জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক পার্থ দত্তের বক্তব্য, ‘ব্রিটিশ রাজের সময় থেকে সরকার মন্দির-মসজিদের মতো স্থাবর সম্পত্তির ওপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আনতে কর আদায় ব্যবস্থা চালু করে। এই রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের জায়গা থেকেই দেবস্থানের অছি পরিষদে সরকারি প্রতিনিধি রাখা শুরু হয়। সেই সংক্রান্ত কোনো মামলা মোকদ্দমা তৈরি হওয়ায় দেবতাকে আইনি দরবারে টানা শুরু হয়। ঔপনিবেশিক এই প্রথা হিন্দু আইনেও বলবৎ আছে এবং কালক্রমে তা পুষ্ট হয়েছে।’

ভারতের সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি অশোক কুমার গঙ্গোপাধ্যায়। ছবি: এএফপি
ভারতের সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি অশোক কুমার গঙ্গোপাধ্যায়। ছবি: এএফপি

ভারতের সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি অশোক কুমার গঙ্গোপাধ্যায় কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় লিখেছেন, ‘রায়টা কিসের ভিত্তিতে দেওয়া হলো, সবটা ঠিক বুঝতে পারছি না। সুপ্রিম কোর্ট দেশের সর্বোচ্চ আদালত। সেই আদালত একটা রায় দিলে তাকে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর আমি খুঁজে পাচ্ছি না। চার শ-পাঁচ শ বছর ধরে একটা মসজিদ একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল। সেই মসজিদকে আজ থেকে ২৭ বছর আগে ভেঙে দেওয়া হলো বর্বরদের মতো আক্রমণ চালিয়ে। আর আজ দেশের সর্বোচ্চ আদালত বলল, ওখানে এ বার মন্দির হবে। সাংবিধানিক নৈতিকতা বলে তো একটা বিষয় রয়েছে! এমন কোনো কাজ করা উচিত নয়, যাতে দেশের সংবিধানের ওপর থেকে কারও ভরসা উঠে যায়। আজ অযোধ্যার ক্ষেত্রে যে রায় হলো, সেই রায়কে হাতিয়ার করে ভবিষ্যতে এই রকম কাণ্ড আরও ঘটানো হবে না, সে নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবেন?’

‘১০৪৫ পাতার রায়ে বিচারপতিদের যে সব পর্যবেক্ষণ সামনে এসেছে, তা থেকে কিন্তু মনে হচ্ছে না যে, সব যুক্তি ঝুঁকে রয়েছে কোনো একটি পক্ষের দিকে। সর্বোচ্চ আদালত কোথাও বলেছে, বাবরি মসজিদ কোনো ফাঁকা জমিতে তৈরি হয়নি, তার নিচে আরও প্রাচীন অমুসলিম স্থাপত্যের সন্ধান পেয়েছে পুরাতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণ। আবার তার পরেই বলেছে, মসজিদের নিচে যে স্থাপত্য মিলেছে, তা হিন্দু স্থাপত্যও যদি হতো, তা হলেও ওই জমি হিন্দুদের হয়ে যায় না। তা হলে বিতর্কিত জমি কার? বিচারপতিরা রায়ে লিখেছেন, ১৮৫৭ সালের আগেও যে রামজন্মভূমিতে হিন্দু পুণ্যার্থীদের যাতায়াত ছিল। বিতর্কিত অংশের বাইরের চত্বরেও যে হিন্দুরাই পূজার্চনা করতেন, তা-ও স্পষ্ট ভাবে প্রমাণিত বলে আদালত মনে করেছে। কিন্তু ১৮৫৭ আগে ওই অংশ সম্পূর্ণ ভাবে মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণে ছিল, এমন কোনো প্রমাণ সুন্নি ওয়াক্ফ বোর্ড দাখিল করতে পারেনি বলে আদালত মনে করছে।’

বিচারপতি অশোক কুমার গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘ওয়াক্ফ বোর্ড শুধুমাত্র ওই প্রমাণটা দাখিল করতে পারল না বলেই কি জমির দখল রামলালা পেলেন? না, তেমন কোনো কথাও রায়ে লেখা নেই। বিতর্কিত জমির ওপরে রামলালা বিরাজমানের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার নেপথ্যে বরং অন্য দু’টি কারণ সামনে আসছে। প্রথমত, বিতর্কিত জমিকে যে হিন্দুরা রামের জন্মস্থান হিসেবে বিশ্বাস করেন, তা নিয়ে কোনো বিতর্ক বা বিরোধ নেই বলে আদালত মনে করেছে। আর দ্বিতীয়ত, বিতর্কিত জমিতে রামলালার অধিকার স্বীকার করে নেওয়াটা আইন-শৃঙ্খলা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বহাল রাখার প্রশ্নের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে বিচারপতিরা মনে করেছেন।’

তবে আমজনতা অযোধ্যার সৈয়দ বাদা এলাকার মোহাম্মদ শিবু খান মনে করেন, মসজিদের জন্য স্থানটি আদালত সুনির্দিষ্ট করে দিলে মুসলিমরা খুশি হতেন। তিনি কাতার–ভিত্তিক টিভি চ্যানেল আল জাজিরাকে বলেন, ‘তারপরেও আমি খুশি যে এটার একটা শেষ হলো। বছর জুড়ে এভাবে বন্ধ থাকতে থাকতে অযোধ্যার মানুষ ক্লান্ত।’

তথ্যসূত্র: আনন্দবাজার, এনডিটিভি, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, জিনিউজ।