বিশ্বব্যাপী অস্থিরতার কারণ কী

চীনের কাছে অপরাধী প্রত্যর্পণে আইন করার উদ্যোগ নেওয়ার প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে হংকং। ছবি: রয়টার্স
চীনের কাছে অপরাধী প্রত্যর্পণে আইন করার উদ্যোগ নেওয়ার প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে হংকং। ছবি: রয়টার্স

বিশ্বের কোন কোন দেশ উত্তাল হয়ে উঠেছে, তার হদিস রাখাটা এই সময়ে কোনো এক ব্যক্তির পক্ষে প্রায় অসম্ভব একটি কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, সহিংস হোক বা অহিংস হোক বিশ্বের অনেকগুলো দেশে বর্তমানে সরকারবিরোধী আন্দোলন চলছে। প্রতিটি মহাদেশই এই অস্থির ঢেউয়ে আক্রান্ত বলা চলে। রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে এমন দেশের তালিকায় আলজেরিয়া, বলিভিয়া, ব্রিটেন, স্পেন, চিলি, ইকুয়েডর, ফ্রান্স, গিনি, হাইতি, হন্ডুরাস, হংকং, ইরাক, কাজাখস্তান, লেবাননসহ আরও দেশ রয়েছে। আর চলতি মাসের শুরুতেই তালিকাটিতে ঢুকে পড়েছে পাকিস্তান। দশ হাজারেরও বেশি মানুষ দেশটির রাজধানী ইসলামাবাদে জড়ো হয়ে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের পদত্যাগ চেয়েছে।

গত শতকের আশির দশকের শেষ ও নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে এশিয়া ও পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোতে যে গণ-আন্দোলন হয়েছিল, বর্তমান পরিস্থিতি তার সঙ্গে কিছুটা তুলনীয়। তবে যথাযথ তুলনাটি টানতে হলে তাকাতে হবে আরও পেছনে। ১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকে বিশ্বব্যাপী যে গণ-আন্দোলনের ঢেউ উঠেছিল দেশ ও আন্দোলনকারীদের সংখ্যার বিচারে এই সময়ের চরিত্রটি তার সঙ্গে অনেকটা মেলে।

তবে উল্লিখিত দশকগুলোয় বিশ্বব্যাপী হওয়া গণ-আন্দোলনের সঙ্গে শুধু সংখ্যার বিচারেই এ সময়ের আন্দোলনগুলো তুলনীয়; চরিত্র বিচারে নয়। সে সময়ে আন্দোলনগুলো অনেক বেশি পরস্পর-সম্পৃক্ত ছিল। বিপরীতে বর্তমানে উত্তাল বিশ্বের নানা প্রান্তে ঘটে চলা আন্দোলনগুলো অনেকটাই বিচ্ছিন্ন ও স্বতঃস্ফূর্ত। বিভিন্ন দেশের আন্দোলনকারীদের ক্ষোভ ও লক্ষ্যের মূলটি একই হলেও আন্দোলনকারীরা তা যথাযথভাবে শনাক্ত করতে না পারায় এই বিচ্ছিন্নতা থেকে যাচ্ছে।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, পাকিস্তানে চলমান আন্দোলনের মূলে রয়েছে অর্থনীতি, যা মুদ্রাস্ফীতি ও আইএমএফ প্রস্তাবিত ব্যয় সংকোচন নীতিতে আরও সংকটাপন্ন, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি এবং গত জাতীয় নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির অভিযোগ। অন্য দেশগুলোর দিকে তাকালে এর অন্তর্নিহিত ঐক্যের দেখা পাওয়া গেলেও তা দূরদর্শিতার অভাবে বিচ্ছিন্ন থেকে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে করা কলের ওপর করারোপের প্রতিবাদে লেবাননে আন্দোলনের সূচনা হয়। হংকং উত্তাল হয়েছে চীনের কাছে অপরাধী প্রত্যর্পণের জন্য আইন করার উদ্যোগ নেওয়ার প্রতিবাদে, স্পেনের কাতালোনিয়ায় স্বাধীনতার সমর্থকদের কারাদণ্ড দেওয়ার প্রতিবাদে, ব্রিটেনে দ্বিতীয় ব্রেক্সিট গণভোটের দাবিতে আন্দোলনের সূচনা হয়।

আন্দোলন সূচনার এই কারণগুলোর মধ্যে মোটাদাগে কোনো ঐক্য নেই। অনেকটা স্থানিক ও সাময়িক প্রতিক্রিয়া হিসেবে এই আন্দোলনগুলোর জন্ম বলে মনে হয়। কিন্তু তেমন হলে এটি অল্প দিনেই শক্তি হারিয়ে ফেলার কথা। তা কিন্তু হচ্ছে না। ফলে প্রাথমিক দাবিটি থেকে অন্য কোথাও চোখ বোলাতে হয়, যেখানে মূলত অর্থনৈতিক অসাম্য ও চাপিয়ে দেওয়া নীতিই কারণ হিসেবে সামনে আসে। কিন্তু দেশের ভূগোলে ভাগ হয়ে থাকা আন্দোলনকারীরা এই মৌল কারণটিকে শনাক্ত ও সামনে না এনে বিচ্ছিন্ন থেকেই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, শুরু থেকেই দেশে দেশে চলমান এই আন্দোলনগুলোর ধরনকে চিহ্নিত করার চেষ্টা শুরু করছেন পণ্ডিতেরা। মোটাদাগে তাঁরা এই সময়ের আন্দোলনগুলোর ব্যাখ্যা হিসেবে তিনটি ব্যাখ্যাকে হাজির করছেন। এর মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক ও জনমিতিক ব্যাখ্যা। আর তৃতীয়টি যথারীতি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব।

ফরেইন অ্যাফেয়ার্সের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, মেট্রো ভাড়ার হার ৪ শতাংশ বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়াতে চিলি উত্তাল হয়ে উঠলেও তা মৌলিক কারণ নয়। কারণ, সেখানকার সাধারণ মানুষ অনেক আগে থেকেই অর্থনৈতিক অসাম্যের দরুন ক্ষোভে ফুঁসছিল। বামপন্থীদের দৃষ্টিতে এটি ব্যর্থ ও অকার্যকর পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিপরীতে সাধারণ মানুষের বিস্ফোরণ।

বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সমাজতান্ত্রিক ঘরানার অস্ট্রেলীয় পত্রিকা রেড ফ্ল্যাগ বলছে, দশকের পর দশক ধরে চলা ব্যবস্থার কারণেই এটি ঘটছে। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে নয়া উদারবাদী ধারায় শ্রমিক ও দরিদ্রদের পকেট কাটার যে নীতি প্রণীত ও অনুসৃত হয়েছে দেশগুলোয়, তা-ই সংকটকে জটিল ও বিস্ফোরণোন্মুখ করে তুলেছে। এই সংকট মূলত দেশগুলোর অনুসৃত ব্যবস্থার সংকট। এমনকি মুক্তবাজার অর্থনীতির ভক্তরাও বিভিন্ন দেশে তৈরি হওয়া জন-অসন্তোষের কারণ হিসেবে ক্রমবর্ধমান অসাম্যকেই দায়ী করছেন। লাতিন আমেরিকায় চিলিকে এক সময় সবচেয়ে স্থিতিশীল দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। অথচ বর্তমানে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশটি দুটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন থেকে পিছিয়ে এসেছে। এই অস্থিরতার পেছনেও রয়েছে অসাম্যই। কারণ, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর জোট ওইসিডিভুক্ত এ দেশে কিছু কিছু সূচকে সবচেয়ে বেশি অসমতা রয়েছে।

জনমিতিক ব্যাখ্যা মূলত আন্দোলনকারীদের গড় বয়স দিয়েই এর ধরনটিকে শনাক্ত করতে চায়। এ ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে, বিভিন্ন দেশে চলমান আন্দোলনের মূল শক্তি হচ্ছে তরুণেরা। যুক্তরাজ্যভিত্তিক পত্রিকা টাইমস জানাচ্ছে, বিশ্বে বর্তমানে চলমান আন্দোলনগুলোর সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের এক-তৃতীয়াংশের বয়স ২০ বছরের নিচে। এই বিপুলসংখ্যক আন্দোলনকারীর বোঝার বয়সটি হয়েছিল কিন্তু ২০০৭-০৮ সালে, সর্বশেষ মহামন্দার সময়। বুঝতে শিখেই সে দেখেছে অস্থিরতা। এরা শিক্ষিত এবং অসাম্যের শিকার। এ ক্ষেত্রে ১৯৬০-এর দশকের আন্দোলনকারীদের সঙ্গে এদের চারিত্রিক সাদৃশ্য রয়েছে। সে সময় উচ্চশিক্ষার প্রসারে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে একটি উচ্চশিক্ষিত শ্রেণির উদ্ভব হয়েছিল। বয়সে তরুণ এই বিপুল জনগোষ্ঠীর সামনে ছিল উপার্জনের অনিশ্চয়তা। একই ধরনের অনিশ্চয়তাকে সঙ্গে নিয়ে বেড়ে উঠেছে বর্তমান আন্দোলনকারী প্রজন্ম, যারা শিক্ষিত হলেও কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তাশূন্য।

আর ষড়যন্ত্র তত্ত্ব তো সবারই জানা। যেকোনো দেশের সরকারই তার বিরুদ্ধে হওয়া যেকোনো আন্দোলনকে এই তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারলে বর্তে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা বহিঃশক্তিকে কারণ হিসেবে দেখায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হাজির করে পেছনের মূল খেলোয়াড় হিসেবে। চীন যেমন হংকংয়ে চলমান আন্দোলনকে মার্কিন ও ব্রিটিশ কারসাজি হিসেবে দেখাতে তৎপর, পাকিস্তান তেমনি প্রতিবেশীর ষড়যন্ত্র হিসেবে তার জনরোষকে দেখাতে চায়। একইভাবে চিলি, বলিভিয়ার মতো দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো তাদের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার দায় চাপাতে চায় কিউবা ও ভেনেজুয়েলার ওপর।

মেট্রো ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে শুরু হলেও চিলির আন্দোলনের মূলে রয়েছে অর্থনৈতিক অসাম্য। ছবি: রয়টার্স
মেট্রো ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে শুরু হলেও চিলির আন্দোলনের মূলে রয়েছে অর্থনৈতিক অসাম্য। ছবি: রয়টার্স

এই সবগুলো কারণ ও ব্যাখ্যাকেই ধর্তব্যে নেওয়া যেতে পারে। কোনো কোনো দেশে অন্য দেশের হস্তক্ষেপের তত্ত্বটিও খাটে বৈকি। কিন্তু এই কোনো ব্যাখ্যাই এখনকার ক্রম-উত্তাল বিশ্বের পেছনের কারণটিকে শনাক্ত করতে পারে না। প্রথমত, ২০০৭-০৮-এর মহামন্দার সময়ের চেয়ে নিশ্চয় এখন বৈশ্বিক অর্থনীতির অবস্থা ভালো। সে সময় যদি, গোটা বিশ্ব একযোগে উত্তাল না হয়ে ওঠে, তবে এখন কারণ কী? তরুণ জনগোষ্ঠী তো তখনো ছিল। তরুণেরাই বিভিন্ন আন্দোলনের মূল শক্তি—এ তো ঐতিহাসিক সত্য। তাহলে, জনমিতিক ব্যাখ্যাটিও যথেষ্ট নয়। তাহলে কারণটি কোথায়?

এই শেষ প্রশ্নটিই তাকাতে বলে ব্যবস্থার দিকে। ব্যবস্থা বলতে যুক্তরাষ্ট্রের ফেরি করা উদারবাদী গণতন্ত্রের যে কাঠামো, তার দিকে তাকানোটা জরুরি। প্রতিটি মহাদেশেই এই কাঠামোটি হয় আক্রান্ত, নয় তো ভেতর থেকে ক্ষয়ে গেছে। কোনো দেশের মানুষ হয়তো মনে করছে, তাদের ভোটের শক্তিটি ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। কোনো দেশের মানুষ আবার ভাবছে ভোটের এ পদ্ধতিই ত্রুটিপূর্ণ। আবার হয়তো কোনো দেশে নির্বাচনী পুরো ব্যবস্থাই ঠিক আছে, কিন্তু মানুষ ঠিক নির্বাচিতদের বিশ্বাস করছে না। তারা ভাবছে, নির্বাচিতরা তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। অর্থাৎ, মোটাদাগে জনসাধারণ নিজেকে ‘ক্ষমতাহীন’, ‘গুরুত্বহীন’ মনে করছে। সে মনে করছে, তার কথা নীতিনির্ধারকেরা শুনছেন না। ফলে তার পক্ষে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ প্রদর্শন ও চিৎকার করে নিজের কথাটি বলা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর থাকছে না।

যেহেতু মুক্তবাজার পণ্যকেই শুধু অবারিত করেনি, সমস্যা ও সম্ভাবনাকেও অবারিত করেছে, সেহেতু বিদ্যমান ব্যবস্থায় কোনো একটি দেশ বা অঞ্চলের পক্ষে বাকি বিশ্বের সংকটের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলা সম্ভব নয়। ফলে একচেটিয়াপনা, কর্তৃত্ব, দুর্নীতি ইত্যাদি সমস্যারও এক ধরনের বিশ্বায়ন হয়। তাই বর্তমান বিশ্বকাঠামোয় অর্থনীতির শক্তি বিচারে বিভিন্ন দেশ আলাদা কাতারে থাকলেও অসাম্য বিবেচনায় সবাই একই কেন্দ্রের সঙ্গেই যুক্ত। তাই এক দেশে শুরু হওয়া গণ-আন্দোলন অন্য দেশগুলোতেও সঞ্চারিত হচ্ছে। কখন কোথায় সঞ্চারিত হবে, তা নির্ভর করছে শুধু ওই নির্দিষ্ট ভূগোলে দৃশ্যমান সংকটের ব্যাপ্তির ওপর। গণ-আন্দোলনের আগের দুটি ঢেউয়ের সঙ্গে এবারের ঢেউটি আলাদা থেকে যাচ্ছে সুনির্দিষ্ট আদর্শের অনুপস্থিতিতে। আগের দুটি ক্ষেত্রেই সুস্পষ্ট আদর্শ সামনে ছিল আন্দোলনকারীদের সামনে। এবার এখনো তেমন কোনো সাধারণ আদর্শের উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে না। তবে বিরোধটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে; আর তা হলো অসাম্যকে বল্গাহীন করা পুঁজির কাঠামো।