শ্রীলঙ্কার গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা

ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

ভারত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। দেশটিতে বহু বছর ধরে তুমুল গৃহযুদ্ধ চলেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি ও সংখ্যালঘু তামিলদের মধ্যে এই যুদ্ধ চলেছে দেশটির উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে। এক দশক আগে ২৫ বছর ধরে চলা সেই গৃহযুদ্ধের অবসান হয়। চলতি বছরের ২১ এপ্রিল ইস্টার সানডেতে শ্রীলঙ্কার বাণিজ্যিক রাজধানী কলম্বোসহ কয়েকটি শহরের তিনটি গির্জা ও তিনটি হোটেলে একযোগে বিস্ফোরণের খবর পাওয়া যায়। এ ঘটনায় ২৬৯ জন নিহত হয়। সবকিছু পেছনে ফেলে শনিবার লঙ্কানরা নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে ভোট দিয়েছে।

এই নির্বাচনে ধর্ম, তামিল টাইগার নিধন, পর্যটনসহ বেশ কিছু বিষয় বিশেষ গুরুত্ব রাখবে।

বৌদ্ধপ্রধান দেশ
ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের অশ্রুবিন্দু আকৃতির গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দ্বীপটিকে উপমহাদেশ থেকে আলাদা করেছে পক প্রণালি। সামুদ্রিক এই প্রণালিটির সবচেয়ে সরু অংশটিও প্রায় ২০ কিলোমিটার প্রশস্ত। বিশ্বব্যাংকের ২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী, এই দ্বীপদেশের জনসংখ্যা ২ কোটি ১৬ লাখ।

দেশটির জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ নাগরিক বৌদ্ধ, তাদের বেশির ভাগই জাতিগতভাবে সিংহলি। এ ছাড়া প্রায় ১২ শতাংশ নাগরিক হিন্দু, যাদের বেশির ভাগ তামিল। তারা মূলত দ্বীপটির উত্তর এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বাস করে।

জনসংখ্যার ১০ শতাংশ নাগরিক মুসলিম। খ্রিষ্টানদের সংখ্যা প্রায় ৭ শতাংশ।

ইস্টার সানডেতে হামলায় নিহত হয় বহু মানুষ। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
ইস্টার সানডেতে হামলায় নিহত হয় বহু মানুষ। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

সিলন থেকে শ্রীলঙ্কা
১৮১৫ সালে সিলন নামে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার আগে দ্বীপটি প্রথমে পর্তুগাল (১৫০৫-১৬৫৬) এবং পরে নেদারল্যান্ডসের (১৬৫৬-১৭৯৬) অধীনে ছিল।

শেষ সিংহলি রাজা ১৭৯৮ থেকে ১৮১৫ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেন। ব্রিটিশ শাসনের ১৩০ বছরের বেশি সময় পরে ১৯৪৮ সালে দ্বীপটি স্বাধীনতা অর্জন করে।

১৯৭২ সালে দ্বীপরাষ্ট্রটি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয় এবং শ্রীলঙ্কা নাম গ্রহণ করে।

তামিল টাইগারদের পতন
১৯৭২ সালে তামিল বিদ্রোহীরা পৃথক একটি দেশের জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে। এতে প্রায় চার দশকের গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, যাতে প্রায় ১০ লাখ মানুষ মারা গেছে।

১৯৯৩ সালে লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলমের (এলটিটিই) প্রচারণার সময় আত্মঘাতী বোমা হামলায় প্রেসিডেন্ট রানাসিংহে প্রেমাদাসাসহ বেশ কয়েকজন নিহত হন। পশ্চিমা দেশ ও ভারত এলটিটিইকে সন্ত্রাসবাদী দল হিসেবে চিহ্নিত করে।

যুদ্ধবিরতি ব্যর্থ হওয়ার পর ২০০৯ সালে সিংহলি সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার সর্বাত্মক সামরিক হামলায় তামিল টাইগারদের প্রতিহত করে। এ সময় দলটির প্রতিষ্ঠাতা ও নেতা ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণকে হত্যা করা হয়।

বর্বরতার জন্য অভিযানটি সমালোচনার শিকার হয়। সৈন্যরা অন্তত ৪০ হাজার তামিল নাগরিককে হত্যা করে বলে অভিযোগ উঠেছিল। এই সংঘর্ষে যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে স্বাধীন তদন্তের দাবি জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল।

চা রপ্তানিতে বেশ এগিয়ে আছে শ্রীলঙ্কা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
চা রপ্তানিতে বেশ এগিয়ে আছে শ্রীলঙ্কা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

রক্তাক্ত ইস্টার
বিচ্ছিন্নতাবাদী তামিলদের সঙ্গে যুদ্ধের সমাপ্তির এক দশক উদ্‌যাপন করতে চলেছিল শ্রীলঙ্কা। তারই মধ্যে এ বছরের ২১ এপ্রিল ইস্টার সানডের দিন দেশটির রাজধানীতে নতুন করে সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয়।

সেদিন জনবহুল তিনটি গির্জা এবং তিনটি বিলাসবহুল হোটেলে একের পর এক আত্মঘাতী বোমা হামলায় ৪৫ বিদেশি নাগরিকসহ ২৬৯ জন নিহত হয়।

সরকার স্থানীয় একটি জিহাদি দলকে এই হামলার জন্য দায়ী করে। ইসলামিক স্টেটও (আইএস) এই হামলার দায় স্বীকার করেছে।

এই হামলার পর মুসলিমবিরোধী দাঙ্গার সূত্রপাত হয়। এর জেরে মুসলিম এক নাগরিককে হত্যা করা হয় এবং শত শত বাড়িঘর, দোকানপাট ও মসজিদে ভাঙচুর চলে। তখন থেকে জারি করা জরুরি অবস্থা আগস্টে শিথিল করা হয়েছে।

প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা এবং প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের মধ্যকার দ্বন্দ্বের মধ্যে এই হামলা হয়েছে। তাঁরা দুজনই সাম্প্রতিক এই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নিতে ব্যর্থ হয়েছেন।

পর্যটন ও চা
গৃহযুদ্ধ অবসানের পর শ্রীলঙ্কায় আন্তর্জাতিক পর্যটকের সংখ্যা বেড়েছে। ২০১৬ সাল থেকে প্রতিবছর গড়ে ২০ লাখের বেশি দর্শনার্থী দেশটিতে আসছেন। ২০০৯ সালে সংখ্যাটি ৪ লাখ ৪৮ হাজার ছিল।

তবে ইস্টার সানডেতে বোমা বিস্ফোরণের পর পর্যটকদের আনাগোনা কমে যাওয়ায় শ্রীলঙ্কা সরকার রাজস্ব খাতে এ বছর প্রায় ১৫ লাখ ডলার হারাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

শ্রীলঙ্কা প্রধানত চা রপ্তানি করে। দেশে উৎপাদিত চায়ের ৯০ শতাংশের বেশি বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। শীর্ষস্থানীয় আন্তর্জাতিক রপ্তানিকারী হিসেবে চীন ও কেনিয়ার সঙ্গে শ্রীলঙ্কার অবস্থান।

পোশাকশিল্প ও বিদেশে বসবাসরত শ্রমিকদের কাছ থেকে অর্জিত রেমিট্যান্সও শ্রীলঙ্কার আয়ের মূল উৎস।

বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে, ২০১০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে প্রবৃদ্ধির হার গড়ে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ ছিল। ২০১৯ সালে এই প্রবৃদ্ধির হার ২ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে যেতে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।