পারমাণবিক অস্ত্রের বিলুপ্তির আহ্বান জানালেন পোপ ফ্রান্সিস

জাপানের টোকিওতে এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন পোপ ফ্রান্সিস। টোকিও, জাপান, ২৫ নভেম্বর। ছবি: রয়টার্স
জাপানের টোকিওতে এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন পোপ ফ্রান্সিস। টোকিও, জাপান, ২৫ নভেম্বর। ছবি: রয়টার্স

জাপান সফরে এসেছেন পোপ ফ্রান্সিস। শনিবার বিকেলে টোকিও পৌঁছে গতকাল রোববার সকালে প্রথমেই তিনি যাত্রা করেন আণবিক বোমা বিধ্বস্ত শহর, পশ্চিমা জাপানের নাগাসাকির উদ্দেশ্যে। নাগাসাকি থেকে তিনি গিয়েছিলেন হিরোশিমা।

নাগাসাকি হচ্ছে সেই শহর, জাপানে খ্রিষ্টধর্ম যেখানে একসময় বিস্তৃত হয়েছিল। ১৫৪৯ সালে সেন্ট ফ্রান্সিস জাভিয়ের খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ভারতের গোয়া থেকে জাপানে এসেছিলেন এবং জাপানে খ্রিষ্টধর্মের বীজ তাঁর হাতে রোপিত হয়। তবে সপ্তদশ শতকের সূচনালগ্নে তোকুগাওয়া শোগুন প্রশাসন খ্রিষ্টধর্মের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে খ্রিষ্টের অনুসারীদের সংখ্যা জাপানে ক্রমশ হ্রাস পেতে শুরু করে।

রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন সত্ত্বেও নাগাসাকি-ভিত্তিক কিছু অনুসারী অবশ্য গোপনে ধর্মবিশ্বাস টিকিয়ে রেখেছিলেন এবং পরবর্তীতে নিষেধাজ্ঞা শিথিল হলে এদের পরবর্তী প্রজন্ম আবারও প্রকাশ্যে ধর্মচর্চার সুযোগ লাভ করেন এবং খ্রিষ্টধর্ম জাপানে সীমিত মাত্রায় হলেও টিকে থাকে। ফলে নাগাসাকি শুরু থেকেই ছিল জাপানে খ্রিষ্টধর্ম বিকাশের প্রধান কেন্দ্র। ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসে নাগাসাকি আণবিক বোমা হামলার শিকার হলে অন্য জাপানিদের সঙ্গে খ্রিষ্টধর্মে বিশ্বাসী অনেকেও প্রাণ হারান এবং ধ্বংস হয়ে যায় নাগাসাকি শহরের উরাকামি গির্জা। ফলে নাগাসাকি সফর পোপ ফ্রান্সিসের জন্য ছিল আবেগতাড়িত এক সফর।

বৃষ্টি-ভেজা দিনে নাগাসাকি বেসবল স্টেডিয়ামে ৩৫ হাজার জনতার সমাবেশে পোপ ফ্রান্সিস আজ এক প্রার্থনায় নেতৃত্ব দেন। এর আগে নাগাসাকি শহরের আণবিক বোমা হামলায় নিহতদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত স্মারক স্মৃতিসৌধের পাদদেশে পুষ্পস্তবক অর্পণের পর খেয়া ভাষণে তিনি বলেছেন, “আমরা মানব জাতি একে অন্যের জন্য বেদনা আর বিভীষিকা নিয়ে আসায় কতটা পারদর্শী, সেই স্থানটি হচ্ছে তা আমাদের পরিষ্কারভাবে মনে করিয়ে দেয়।“ তিনি উল্লেখ করেন তিনি নিশ্চিত যে পারমাণবিক অস্ত্র-মুক্ত বিশ্ব যে কেবল সম্ভব তাই নয়, বরং এটা হচ্ছে আবশ্যকীয়।

বিশ্ব জুড়ে চলতে থাকা বিরামহীন অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করা এবং শান্তির আহ্বান জানিয়ে দেওয়া আবেগ প্রবণ সেই ভাষণে পারমাণবিক অস্ত্র পরিহার ও স্নায়ু যুদ্ধকালীন সময়ের নিবারক তত্ত্ব থেকে বের হয়ে আসার দাবি বিশ্ব-নেতাদের প্রতি জানিয়ে তিনি বলেছেন, পারমাণবিক অস্ত্রের মজুত বৃদ্ধি নিরাপত্তার সম্ভাবনা হ্রাস করছে, অর্থের অপচয় ঘটাচ্ছে এবং মানবতাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। অস্ত্রের ভান্ডার যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার সামনে দেখা দেওয়া হুমকি থেকে আমাদের রক্ষা করতে পারে না, তা ভুলে না যাওয়ার আহ্বানও তিনি একই সঙ্গে তাঁদের প্রতি জানান।
পোপের তিন দিনের জাপান সফরের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় নাগাসাকি ও হিরোশিমা ভ্রমণের মধ্যে দিয়ে। উল্লেখ্য পোপ ফ্রান্সিসের নেতৃত্বে ভ্যাটিকান পারমাণবিক অস্ত্র বিরোধী বলিষ্ঠ অবস্থান গ্রহণ করে আসছে। ভ্যাটিকান হচ্ছে জাতিসংঘের পরমাণু অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তি স্বাক্ষর ও অনুমোদনকারী প্রথম রাষ্ট্রগুলোর একটি।

২০১৭ সালে দেওয়া এক বিবৃতিতে পোপ ফ্রান্সিস বলেছিলেন, পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহারই কেবল নয়, সেরকম অস্ত্রের মালিকানাও হচ্ছে নিন্দনীয় একটি বিষয়। পরমাণু অস্ত্র বিলুপ্তির পক্ষে এতটা জোরালো বক্তব্য এর আগে কোনো পোপ রাখেন নি। নাগাসাকিতে দেওয়া ভাষণেও সেই প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়।
তিনি বলেছেন, “আমাদের এই পৃথিবীতে লাখ লাখ শিশু ও পরিবারকে অমানবিক পরিবেশে জীবন কাটাতে হওয়ায় আরও বেশি বিধ্বংসী অস্ত্র তৈরি, সেগুলো উন্নত করে নেওয়া ও এর রক্ষণাবেক্ষণে অর্থের অপচয় ও সেই সঙ্গে অস্ত্র বিক্রি করার মধ্যে দিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে নেওয়া হচ্ছে স্বর্গের অবমাননা করে যাওয়া চিৎকার। ভাষণ তিনি শেষ করেন সেন্ট ফ্রান্সিস আসসিসির বন্দনা হিসেবে গণ্য এক প্রার্থনার মধ্যে দিয়ে, যেখানে বলা হয়েছে:

প্রভু, আমাকে তুমি করে নাও তোমার শান্তির হাতিয়ার:
যেখানে আছে ঘৃণা, আমাকে বপন করতে দাও সেখানে শান্তির বীজ;
যেখানে আছে আঘাত, ক্ষমা;
যেখানে আছে সন্দেহ, বিশ্বাস;
যেখানে আছে নৈরাশ্য, আশা;
যেখানে আছে অন্ধকার, আলো;
যেখানে আছে বেদনা, আনন্দ।

প্রার্থনা শুরু করার আগে পোপ অবশ্য বলে নিয়েছিলেন সমবেত সকলেই যে ক্যাথলিক মতবাদে বিশ্বাসী নন তা তাঁর জানা আছে। তবে তা সত্ত্বেও সেন্ট ফ্রান্সিস আসসিসিকে নিবেদিত শান্তির আকুতি জানানো প্রার্থনা সকলেই নিজেদের মতো করে করতে সক্ষম বলে তিনি মনে করেন।