যুক্তরাজ্যের নির্বাচনে ট্রাম্পের ছায়া

বরিস জনসন ও ডোনাল্ড ট্রাম্প
বরিস জনসন ও ডোনাল্ড ট্রাম্প

সব দেশেই নির্বাচন একান্তই নিজস্ব বা অভ্যন্তরীণ বিষয়। অন্তত প্রকাশ্যে বাইরের কারও হস্তক্ষেপ বা প্রভাব খাটানোর চেষ্টা স্বাভাবিক বা প্রত্যাশিত নয়। যুক্তরাজ্যের মতো একটি বৃহৎ শক্তির নির্বাচনে তাই তা অনেকটা অকল্পনীয় বিষয়। কিন্তু বাস্তবে সেটাই ঘটেছে এবং এখন তার পুনরাবৃত্তি ও প্রভাব নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই হস্তক্ষেপ ঘটেছে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষ থেকে। তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যাঁর পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, সেই প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনই এখন বলছেন, তিনি এমন সমর্থন চান না। ট্রাম্পের লন্ডন সফরের প্রাক্কালে তাই নির্বাচন বিষয়ে তিনি আবারও মুখ খোলেন কি না, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। পাশ্চাত্যের সামরিক জোট ন্যাটোর শীর্ষ বৈঠকে অংশ নিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আজ লন্ডন আসার কথা।

২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অনেকটাই বদলে দিয়েছে। ওই নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে জেতাতে রাশিয়ার নানাভাবে প্রভাব খাটানোর অভিযোগ রয়েছে। কাজেই যুক্তরাজ্যের নির্বাচনে ট্রাম্পের কথিত ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক সম্ভবত গণতান্ত্রিক এই রীতিনীতি বদলে যাওয়ারই সাক্ষ্য বহন করে।

২০১৬ সালের নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের অভিযোগের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বছরব্যাপী তদন্তও অনুষ্ঠিত হয়েছে। ইতিমধ্যে নির্বাচনে অনাকাঙ্ক্ষিত বিদেশি হস্তক্ষেপ বন্ধে গুগল, ফেসবুক, টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ ইন্টারনেটভিত্তিক সেবাদানকারী বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে।

নির্বাচনের পবিত্রতা রক্ষায় বিভিন্ন দেশ এবং বহুজাতিক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলো যত তৎপরই হোক না কেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে নিয়ন্ত্রণ করবে কে? ফলে, যুক্তরাজ্যে কার প্রধানমন্ত্রী হওয়া উচিত, সে বিষয়ে তিনি কোনো ধরনের রাখঢাক না করেই বেছে নিয়েছেন বরিস জনসনকে। এমনকি সাবেক প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মেকে পাশে রেখেই অতীতে তিনি বরিসের নেতৃত্বের প্রশংসা করেছেন। বরিসকে অনেকে ‘যুক্তরাজ্যের ট্রাম্প’ অভিহিত করেন বলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গর্বও করেছিলেন। রাজনীতিতেও তাঁদের মধ্যে যে বড় ধরনের মিল রয়েছে, সে কথা মোটামুটি সবার জানা।

যুক্তরাজ্যে দ্বিতীয় যে রাজনীতিককে ট্রাম্প পছন্দ করেন, তিনি হলেন আরেক কট্টর ডানপন্থী নেতা নাইজেল ফারাজ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে যুক্তরাজ্যের বিচ্ছেদ (ব্রেক্সিট) ঘটানোই ফারাজের একমাত্র লক্ষ্য। এই লক্ষ্য নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইউনাইটেড কিংডম ইনডিপেনডেন্স পার্টি (ইউকিপ)। ২০১৬ সালের গণভোটে ব্রেক্সিটের পক্ষে রায় আসার পর তিনি অবসর নেন। কিন্তু ব্রেক্সিট বাস্তবায়নে জটিলতা তৈরি হওয়ায় অবসর থেকে ফিরে নাইজেল ফারাজ গত এপ্রিলে গঠন করেন ব্রেক্সিট পার্টি। মাত্র কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচনে তাঁর দল সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে চমক সৃষ্টি করে।

ব্রেক্সিট পার্টির এ রকম নাটকীয় উত্থানে সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে পড়ে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ (টোরি) পার্টি। দলটিতে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ শুরু হয় এবং যেকোনো মূল্যে ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের স্লোগান নিয়ে নেতৃত্বে আবির্ভূত হন বরিস জনসন। কিন্তু পার্লামেন্টে ব্রেক্সিট চুক্তি অনুমোদনে প্রয়োজনীয় সমর্থন না পাওয়ায় নতুন সাধারণ নির্বাচন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। ব্রেক্সিট পার্টির কারণে কনজারভেটিভ পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ার ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। এ রকম বিপন্ন পরিবেশে এগিয়ে আসেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তিনি প্রকাশ্যেই নাইজেল ফারাজ এবং বরিস জনসনের মধ্যে সমঝোতার আহ্বান জানান। লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন যুক্তরাজ্যের জন্য খুব খারাপ বলেও তখন মন্তব্য করেছিলেন তিনি। স্মরণ করা প্রয়োজন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের বাণিজ্য বাড়ানোর বিষয়ে ব্রেক্সিটপন্থীরা বিশেষভাবে আগ্রহী। কিন্তু করবিন ও তাঁর লেবার পার্টি শ্রম অধিকার এবং পরিবেশগত মানের প্রশ্নে কোনো রকম নমনীয়তার পক্ষে নয়। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে একধরনের প্রতিবন্ধক হিসেবেই বিবেচনা করে।

কনজারভেটিভ পার্টি নাইজেল ফারাজ ও তাঁর ব্রেক্সিট পার্টির সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে নির্বাচনের প্রস্তাব প্রকাশ্যে প্রত্যাখ্যান করলেও বাস্তবে ঘটেছে উল্টোটা। কনজারভেটিভ পার্টির প্রার্থীরা যেসব আসনের প্রতিনিধিত্ব করতেন এবং গত নির্বাচনে ভালো ব্যবধানে জিতেছেন, সেসব আসনে নাইজেল ফারাজ নিজের দলের প্রার্থীদের প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। যেসব আসনে লেবার পার্টির প্রার্থীরা সামান্য ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছিলেন এবং যেসব আসনে ব্রেক্সিটের পক্ষে ভোট বেশি পড়েছিল, সেগুলোয় ব্রেক্সিট পার্টি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। উদ্দেশ্য, লেবার পার্টির ভোট কমিয়ে কনজারভেটিভদের সাহায্য করা।

বিশ্লেষকেরা প্রায় সবাই একমত, বরিস জনসনের নেতৃত্বে কনজারভেটিভ পার্টি ব্রেক্সিট সমর্থকদের সংগঠনে রূপান্তরিত হয়েছে। বিপরীতে ব্রেক্সিটবিরোধী ও নমনীয় ব্রেক্সিটের সমর্থকদের মধ্যে অনেক মতপার্থক্য রয়েছে। ফলে লেবার পার্টি ব্রেক্সিটবিরোধীদের একমাত্র বিকল্প নয়।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সমর্থনের কারণে প্রধানমন্ত্রী বরিস যে ইতিমধ্যে লাভবান হয়েছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাহলে এখন কেন আর প্রকাশ্য সমর্থন চান না? এ প্রশ্নের জবাব মিলবে সম্ভবত গত শুক্রবার অনুষ্ঠিত বিবিসির নির্বাচনী বিতর্কে অংশ নেওয়া সাতটি দলের নেতাদের বক্তব্যে। বিতর্কে জানতে চাওয়া হয়েছিল, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে ৩০ সেকেন্ড কথা বলার সুযোগ পেলে তাঁরা তাঁকে কী বলবেন?

জবাবে কনজারভেটিভ পার্টির প্রতিনিধি অর্থ প্রতিমন্ত্রী রিশি সুনাক বলেন, তিনি বলবেন ‘হ্যাপি থ্যাংকসগিভিং’। ব্রেক্সিট পার্টির রিচার্ড টাইস জানান, তিনি বলবেন ‘আসুন, বাণিজ্য চুক্তিটা করে ফেলি’। লেবার পার্টির রেবেকা লং-বেইলি জানান, তিনি ট্রাম্পকে যা বলবেন, একজন ভালো ক্যাথলিক খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী হিসেবে তা প্রকাশ্যে বলতে চান না। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটি বলবেন তা হলো, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত জরুরি অবস্থার বিষয়ে তিনি যেন তাঁর অবস্থান বদলান। গ্রিন পার্টির ক্যারোলাইন লুকাস বলেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে ফিরে আসার আহ্বান জানাবেন। স্কটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টির প্রধান ও স্কটিশ ফার্স্ট মিনিস্টার (মুখ্যমন্ত্রী) নিকোলা স্টারজেন ট্রাম্পকে বলতে চান, ‘দয়া করে পদত্যাগ করুন।’ ওয়েলসের আঞ্চলিক দল প্লাইড কামরুর অ্যাডাম প্রাইস বলবেন, ‘পদত্যাগ করুন এবং বরিসকে আপনার সঙ্গে নিয়ে যান।’

বিবিসি জানিয়েছে, বিতর্কে উপস্থিত দর্শকেরা সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন অ্যাডাম প্রাইসের কথায়। তাঁর কথায় হাসির রোল পড়ে যায়।