চীন কি নতুন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি

দক্ষিণ চীন সাগরে সামরিক শক্তি বাড়াচ্ছে চীন। ছবি: রয়টার্স
দক্ষিণ চীন সাগরে সামরিক শক্তি বাড়াচ্ছে চীন। ছবি: রয়টার্স

পুঁজিবাদ ও সমাজতান্ত্রিক শিবিরের আদর্শিক দ্বন্দ্বের কাল শেষ হয়েছে অনেক দিনই হলো। এখন আর আদর্শিক শিবিরের অস্তিত্ব নেই, কারণ আজকের চীন আর যা-ই হোক, সমাজতান্ত্রিক নয়। কিন্তু তাই বলে আবার দ্বন্দ্ব-সংঘাত থেমে নেই। দ্বন্দ্ব এখন মার্কিন মডেলের পুঁজিবাদের সঙ্গে চীনা মডেলের পুঁজিবাদের। বিশেষ করে আফ্রিকা ও এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই দ্বন্দ্ব দৃশ্যমান হবে। আর সেখানেই চীনের সাম্রাজ্যিক বাসনার স্বরূপ দেখা যাবে।

সার্বিয়ান-মার্কিন অর্থনীতিবিদ ব্লাঙ্কো মিলানোভিচ সাম্প্রতিক বই ‘ক্যাপিটালিজম, অ্যালোন’ গ্রন্থে আজকের ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বের স্বরূপটি ধরার চেষ্টা করেছেন। তিনি এই দুই মডেলের মধ্যে পার্থক্যও দেখিয়েছেন। বলেছেন, চীন মূলত পুঁজিবাদী এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হলেও তার বেলায় মুনাফা নয়, জাতীয় স্বার্থই প্রধান। রাষ্ট্রই এ ক্ষেত্রে সর্বেসর্বা। ব্যাপারটা হলো, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন থেকে চীনারা যে শিক্ষা নিয়েছে, ইতিহাসের তথাকথিত শেষ দেখে ফেলা মানুষেরা সেই শিক্ষা নিতে পারেননি।

মিলানোভিচের বক্তব্য হলো, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য চীনা মডেল অনেক ক্ষেত্রেই বেশি আকর্ষণীয় এ কারণে যে, চীন কখনোই অন্য দেশকে মানবাধিকার কিংবা সমকামীদের অধিকার নিয়ে জ্ঞান দেয় না। এসব দিতে বাধ্য করে না। আবার অন্য দেশের সার্বভৌমত্বেও হাত দেয় না। মোদ্দাকথা হলো, মার্কিনরা চায় অন্যরা তাদের মতো হোক, আর চীনারা বাহবা চায়।

কিন্তু অনেক বিশ্লেষকই আবার বলেন, চীন চিরকাল এভাবে সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারবে না। আজ হোক বা কাল, নিজের স্বার্থ ও নিরাপত্তাজনিত স্বার্থ রক্ষায় তাকে অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতেই হবে। আর সেখানেই তার ঔপনিবেশিক চরিত্র বেরিয়ে আসবে।

চীন যে সাম্রাজ্যিক শক্তি হতে পারে, তার নজির কিন্তু ইতিমধ্যে দেখা যাচ্ছে। আফ্রিকার জিবুতিতে ইতিমধ্যে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে চীন। সেখান থেকে ভারত মহাসাগরে নজরদারি চালাচ্ছে। ইতিমধ্যে চীনের ঋণ কূটনীতির শিকার হয়েছে শ্রীলঙ্কা। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে হাম্বানটোটা বন্দরের নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা চীনের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে তারা। এ ঘটনায় চীন-ভারত দ্বন্দ্ব প্রবল হয়েছে। এই বন্দর পেয়ে চীন কার্যত ভারত মহাসাগরের মাঝখানে নৌসেনা উপস্থিতি বাড়াতে পেরেছে। কেনিয়ারও একই পরিণতি হতে যাচ্ছে। অন্যদিকে পাকিস্তানে ‘চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর’ নিয়েও ভারতের সন্দেহ ও আপত্তি আছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের ঋণের মতো নয়, চীনা ঋণের বিপরীতে গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ জামানত রাখতে হয়। যেসব সম্পদের দীর্ঘ মেয়াদে উচ্চ মূল্য আছে। উদাহরণ হিসেবে এই হাম্বানটোটার কথাই বলা যায়। এটি ভারত মহাসাগরে ইউরোপ, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার বাণিজ্যপথের সংযোগকারী বন্দর। গরিব দেশে অবকাঠামো নির্মাণ ও অর্থায়ন করে চীন সেখানকার প্রাকৃতিক সম্পদের সুবিধাজনক ব্যবহার দাবি করে, তার মধ্যে যেমন প্রাকৃতিক সম্পদ আছে, তেমনি বন্দরও আছে।

শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা থেকে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, চীনের অর্থায়ন যেকোনো দেশকে অর্গলে বাঁধতে পারে। অনুদান বা বিশেষ ছাড়ে ঋণ না দিয়ে চীন বাজারমূল্যে বড় বড় প্রকল্পে ঋণ দিয়ে থাকে। এতে যেমন স্বচ্ছতা থাকে না, তেমনি পরিবেশ ও সামাজিক প্রভাব সমীক্ষারও বালাই থাকে না। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন বলেছেন, বিআরআই প্রকল্প দিয়ে চীন ‘নিজের নিয়মকানুন ও মানদণ্ড নির্ধারণ’ করতে চায়। নিজের অবস্থান আরও শক্তিশালী করতে চীন স্বীয় কোম্পানিগুলোকে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বন্দরগুলো সরাসরি কিনতে উৎসাহিত করে। ওদিকে চীন ভূমধ্যসাগরে ৪৩ কোটি ৬০ লাখ ডলারে নগদ অর্থের ঘাটতিতে থাকা গ্রিসের কাছ থেকে পিরায়েয়ুস বন্দর কিনে নিয়েছে, যেটা ইউরোপে বিআরআই প্রকল্পের ‘ড্রাগন হেড’ হিসেবে কাজ করবে।

অন্যদিকে আফ্রিকার উগান্ডা ও জাম্বিয়ায় চীন বিপুল পরিমাণে সম্পদ কিনছে। শুধু আফ্রিকা নয়, ইউরোপের সার্বিয়া, ইতালি, গ্রিস ও এমনকি জার্মানিতেও সম্পদ কিনছে তারা। এই বিনিয়োগ যেকোনো সময় ঋণ-ফাঁদ হতে পারে।
বলা দরকার, ‘সমাজতান্ত্রিক’ সোভিয়েত ইউনিয়নও একসময় ঔপনিবেশিক শক্তি হয়ে উঠেছিল। লেনিন একতরফা ঘোষণা দিয়েছিলেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন রাশিয়ার কোনো উপনিবেশ ধরে রাখবে না। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্তালিন ইউরোপের অর্ধেক করতলগত করেন। বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ দেশ থেকে তারা পশ্চিমপন্থী সরকার উৎখাতে সহায়তা করেছে। তখন তাদের অসংখ্য স্যাটেলাইট রাষ্ট্র ছিল। চীনও একসময় এই পথে হাঁটবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে ইতিমধ্যে অতীতের প্রতিধ্বনি পাওয়া যাচ্ছে। মার্কিন চিন্তাশালা সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের গবেষক জোনাথন হিলম্যানের ভাষায়, ‘এই পথে যেমন পণ্য যাবে, তেমনি সেনাও যেতে পারে।’ ঔপনিবেশিক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও প্রথমে বাণিজ্যের পথ ধরে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল।

উপনিবেশ বা সাম্রাজ্যের সঙ্গে পশ্চিমা শব্দটা চুম্বকের মতো চলে আসে। কিন্তু পশ্চিমারা ঔপনিবেশিক বা সাম্রাজ্যিক হওয়ার অনেক আগেই পূর্বাঞ্চলের অনেক রাজ্য উপনিবেশ বিস্তার করেছে। মোগলরা আর তো ভারতের ভূমিপুত্র নয়। তারাও সেখানে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। চীনের মিং রাজবংশও একই পথে হেঁটেছে। এই দুই বংশের পতনের পর পশ্চিমারা ঔপনিবেশিক শক্তি হিসেবে হালে পানি পায়। আবার পরবর্তী সময়ের সাম্রাজ্যিক উপনিবেশের যুগের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল অটোমান ও পার্সিরা। ফলে পূর্বাঞ্চলের চীনের পক্ষের নতুন করে সেই পথে হাঁটা অসম্ভব কিছু নয়। ইতিহাসও তাকে রসদ জোগাবে।

আগেও বলেছি, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন থেকে ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামা ইতিহাসের শেষ দেখতে পেয়েছিলেন—আদর্শিক লড়াইয়ের অবসান অর্থে। কিন্তু চীন সেখান থেকে নিয়েছে শিক্ষা। তিয়েনআনমেন স্কয়ারে তরুণদের বিক্ষোভ থেকেও তারা বড় শিক্ষা নিয়েছে। মুক্তবাজার বা নব্য উদারনীতিবাদের সুবিধা কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রের পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রণে এক নিজস্ব ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে তারা, চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের ভাষায় এটি হচ্ছে চীনা বৈশিষ্ট্যযুক্ত সমাজতন্ত্র।

মুক্তবাজারে প্রবেশ করলেও বা উদার গণতন্ত্র বা সংসদীয় গণতন্ত্রের ধার ঘেঁষেও চীন কখনো দাঁড়ায়নি। ব্লাঙ্কো মিলানোভিচ একে বলছেন রাজনৈতিক পুঁজিবাদ। এই প্রক্রিয়ায় চীন যেমন বিশ্বের উৎপাদন কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে, তেমনি বিপুলসংখ্যক মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের করে এনেছে। চীন যদি এই প্রক্রিয়া জারি রাখতে পারে, অর্থাৎ উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রেখে সামাজিক চ্যালেঞ্জগুলো আমলে নিতে পারে, তাহলে চীনা মডেল অনুসরণযোগ্য হতে পারে। কিন্তু প্রবল কর্তৃত্বপরায়ণ সরকারব্যবস্থার কারণে চীনা মডেল বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা পাবে না বলেই ধারণা করা যায়।

অন্যদিকে চীন বলপ্রয়োগ করে অন্য দেশের সম্পদ হরণ করেছে বা জোর করে কাউকে কিছু করতে বাধ্য করেছে, সেই ইতিহাস নেই বললেই চলে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দক্ষিণ চীন সাগরে বৃহত্তর নিরাপত্তার স্বার্থে চীন আগ্রাসী অবস্থান নিয়েছে।

কিন্তু যত যা-ই হোক, আগামী শতক হবে এশীয় শতক। এ ক্ষেত্রে চীনের ভূমিকাই প্রধান। সঙ্গে আছে ভারতও। তাদের দ্বন্দ্ব নতুন যুগকে অনিশ্চিত করে তুলতে পারে। তাই এশিয়া ও পৃথিবী চীনের দিকে তাকিয়ে থাকবে, সে কি আগামী দিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হবে, নাকি নতুন ও উন্নত যুগের সূচনা করবে।