ধর্মভিত্তিক দলের ওপর আস্থা কমছে আরবদের

ইরাকে চলমান বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তরুণেরাই। ছবি: রয়টার্স
ইরাকে চলমান বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তরুণেরাই। ছবি: রয়টার্স

‘ধর্ম ও সম্প্রদায়কে না বল’—এ স্লোগান দিচ্ছেন ইরাকের বিক্ষোভকারীরা। আর এরই যেন প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে লেবাননে, যখন সেখানকার বিক্ষোভকারীরা স্লোগান দেন, ‘ইসলামকে না, ক্রিশ্চিয়ানিটিকে না, জাতির জন্য লড়াই কর।’ এ শুধু এ দুই দেশের বাস্তবতা বা বিক্ষোভকারী অতি ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠীর স্লোগান নয়। আরব দেশগুলোতে কম-বেশি এই বাস্তবতাই এখন বিরাজ করছে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর তাদের আস্থা কমছে। বিশেষত তরুণদের মধ্য এ মনোভাব বেশ স্পষ্ট।

ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, আরব বিশ্বের সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও ধর্মীয় নেতাদের ওপর আস্থা দিন দিন কমছে।

আরব দেশগুলোতে নিয়মিত জরিপ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান আরব ব্যারোমিটার পরিচালিত সাম্প্রতিক এক জরিপ ফলাফলে এমন তথ্য উঠে এসেছে। এতে দেখা গেছে, ধর্মভিত্তিক বা এ ঘরানার রাজনৈতিক দলগুলোকে বিশ্বাস করা মানুষের সংখ্যা ২০১১ সালের তুলনায় ২০১৮-১৯ সালে এক-তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটি হয়েছে লিবিয়া, আলজেরিয়া, ইরাক ও তিউনিসিয়ায়। আলজেরিয়ায় ২০১২-১৪ সময়ে ধর্মভিত্তিক দলের প্রতি প্রায় ৪৪ শতাংশ মানুষের আস্থা থাকলেও ২০১৮-১৯ সময়ে তা ১৮ শতাংশে নেমে এসেছে। একই অবস্থা ইরাকে। দেশটিতে এ ধরনের মানুষের সংখ্যা ৪১ শতাংশ থেকে ১৬ শতাংশে নেমে এসেছে।

মূলত আরব বিশ্বে বিদ্যমান রাজনীতির প্রতি জনগণ বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছে বলা যায়। ইরাকে যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক দলকেই আর বিশ্বাস করেন না ৭৮ শতাংশ মানুষ। অথচ ২০১২-১৪ সময়ে এ অনাস্থার হার ছিল ৫১ শতাংশ।
নিজেকে ধার্মিক হিসেবে পরিচয় দিতে চান না, এমন মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে এ দেশগুলোয়। তিউনিসিয়া, লিবিয়া, আলজেরিয়া, ইরাক লেবানন ও মিসরে এ ধরনের মানুষের সংখ্যা সময়ের সঙ্গে বাড়ছে। বর্তমানে এমন মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি তিউনিসিয়ায়। ২০১৮-১৯ সালে করা জরিপে নিজেকে ধার্মিক মনে করেন না বলে মত দিয়েছেন দেশটির জরিপে অংশ নেওয়াদের ২৫ শতাংশেরও বেশি মানুষ। ২০১২-১৪ সময়ে এ হার ছিল ১৮ শতাংশের কাছাকাছি। উল্লিখিত প্রতিটি দেশেই ওই সময়ের তুলনায় বর্তমানে এ ধরনের মনোভাবের মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে তিউনিসিয়া ও লিবিয়ায়।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে ধর্মীয় নেতাদের প্রতি মনোভাবে, যার প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। আরব ব্যারোমিটার জানায়, ২০১৩ সালে ধর্মীয় নেতাদের বিষয়ে আরব জনগণের ৫১ শতাংশই তাদের আস্থার কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু গত বছর এ হার ৪০ শতাংশের নিচে নেমে আসে। ধর্মীয় নেতাদের ওপর আস্থার বিচারে সবচেয়ে বড় কাছে জানতে চাইলে ৫১ শতাংশ মানুষ তাদের আস্থার কথা জানিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটি হয়েছে ইরাকে। ২০১২-১৪ সময়ে দেশটির ৬০ শতাংশেরও বেশি মানুষ ধর্মীয় নেতাদের ওপর আস্থা রাখলেও গত বছর তা কমে ৪০ শতাংশে নেমে আসে।
বুঝতে বাকি থাকে না যে, কয়েক দশক ধরে আরব বিশ্বে চলা রাজনৈতিক অস্থিরতাই এই বিরাট পরিবর্তনের কারণ। গত কয়েক দশক ধরে আরব অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের মানুষ নিজেদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার। রাজপথের আন্দোলন থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সর্বত্র তাঁরা নিজেদের অধিকারের দাবিটি তুলছেন। তাঁদের মূল আপত্তি অঞ্চলটির কর্তৃত্ববাদী শাসকদের নিয়ে। কিন্তু যে ধর্মীয় নেতাদের ওপর তাঁরা আস্থা রেখেছিলেন, তাঁদেরকেও এই সময়ে এসব শাসকদের পক্ষেই কম-বেশি অবস্থান নিতে দেখা যাওয়ায়, তা আশাহত করেছে সাধারণ মানুষকে। বিশেষ তরুণেরা এ কারণে আর তাঁদের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না।

ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও ধর্মীয় নেতারা জনগণকে রাজনৈতিক অধিকারটি পাইয়ে দিতে না পারায় অঞ্চলটিতে পূর্বতন ধারার প্রতি এক ধরনের বিতৃষ্ণা তৈরি হয়েছে। তরুণ আরবদের মধ্যে এক ধরনের বিদ্রোহের মানসিকতা দিন দিন বিকাশ পাচ্ছে। তাঁরা তাঁদের মত প্রকাশের বিষয়টিকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। এটি এক নতুন আরবের নির্মাণ করে ফেলতে পারে। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানসহ অনেক আরব নেতাই হয়তো বিষয়টি বুঝতে পেরে এক ধরনের মুক্ত সমাজ তরুণদের সামনে হাজির করতে চাইছেন। তবে এ ধরনের পদক্ষেপ দিয়ে তরুণদের এমন অনাস্থাকে কতটা জয় করা যাবে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ।