মস্কোয় মুচকি হাসি

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: রয়টার্স
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: রয়টার্স

সাত দশক। মানে ৭০ বছর। বেশ দীর্ঘ সময়। একটা সংগঠন ৭০ বছর পূর্ণ করলে তা উদ্‌যাপনেরই বিষয়।

নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন (ন্যাটো) প্রতিষ্ঠার ৭০ বছর পূর্ণ করেছে। এ উপলক্ষে সম্প্রতি পশ্চিমা সামরিক জোটের শীর্ষ সম্মেলন বসে লন্ডনে। সেখানে হাজির হন জোটের রথী-মহারথীরা।

উপলক্ষটা উদ্‌যাপন হলেও জোটে নেতাদের মুখে হাসি ছিল না। বরং সম্মেলন ছাপিয়ে সামনে আসে পারস্পরিক দোষারোপ, হুমকি-ধমকি, উপহাস-কটূক্তি।

লন্ডনে ন্যাটো সম্মেলনে এমন গুমোট অবস্থা দেখে মস্কো নির্ভার হয়ে কিছুটা মুচকি হাসি হাসতেই পারে। কারণ, ন্যাটোর মধ্যে ‘গিট্টু’ লাগলে মস্কোরই লাভ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্নায়ুযুদ্ধের শুরুর দিকে মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নকে মোকাবিলা করতেই ১৯৪৯ সালে গঠিত হয় ন্যাটো। শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন এই জোটের সদস্য ছিল ১২। জোট সম্প্রসারিত হতে হতে সদস্যসংখ্যা এখন ২৯।

সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য মাথাব্যথার কারণ ছিল ন্যাটো। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়ার জন্যও ন্যাটো বড় হুমকি হিসেবে কাজ করে। সদস্যের সংখ্যা বাড়িয়ে ন্যাটোর সীমান্ত মস্কোর দিকে প্রায় এক হাজার মাইল অগ্রসর হয়েছে। বিষয়টি মস্কোকে দারুণভাবে উদ্বেগে ফেলে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স

ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে থেকেই ন্যাটোর সমালোচনা করে আসছিলেন। তাঁকে ক্ষমতায় আনতে রাশিয়া ভূমিকা রাখে বলে জোরালো অভিযোগ প্রচলিত আছে।

ট্রাম্প ক্ষমতায় বসেই ন্যাটোর বিরুদ্ধে কামান দাগেন। তিনি প্রকাশ্যে ন্যাটোকে ‘সেকেলে’, ‘বাতিল’ বলে বর্ণনা করেন। ন্যাটোর খয়-খরচা নিয়ে সদস্যদের সঙ্গে টানাপোড়েন সৃষ্টি করেন তিনি। ডলারের ‘খোটা’ দিয়ে ন্যাটোকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ‘বোঝা’ হিসেবে অভিহিত করেন।

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন অনেক দিন ধরে মনে মনে যেমনটা চাচ্ছিলেন, ট্রাম্প ঠিক তা-ই করতে শুরু করেন।

জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল। ছবি: রয়টার্স
জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল। ছবি: রয়টার্স

ন্যাটোর ঘরে ‘গন্ডগোল’ লাগাতে মস্কো সব সময়ই তক্কে-তক্কে থাকে। শিকারি-চোখ একটা দুর্বল ‘পয়েন্ট’ ঠিকই পেয়ে যায়। ঝোপ বুঝে কোপ মারে মস্কো। বিশেষ করে জোটের সদস্য তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার কৌশল নেয় রাশিয়া। আঙ্কারাকে আধুনিক সমরাস্ত্র দিয়ে ন্যাটো জোটে ‘প্যাঁচ’ লাগিয়ে দেয় মস্কো। শত্রুর (রাশিয়া) সঙ্গে তুরস্কের দহরম-মহরম ন্যাটো জোটের অন্য সদস্যরা মোটেই ভালোভাবে নেয়নি।

সিরিয়া যুদ্ধ রাশিয়ার জন্য সৌভাগ্যই বয়ে এনেছে। ন্যাটোকে না জানিয়ে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চল থেকে হুট করে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করে নেন ট্রাম্প। আর মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সুযোগে সিরিয়ায় কুর্দি বাহিনীর বিরুদ্ধে হামলা শুরু করে তুরস্ক। এ নিয়ে ন্যাটোর অন্য সদস্যদের সঙ্গে তুরস্কের ঝামেলা বাধে। এমনকি তুরস্কের কাছে অস্ত্র বিক্রি পর্যন্ত বন্ধ করে দেয় ন্যাটোর ইউরোপীয় দেশগুলো।

ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ। ছবি: রয়টার্স
ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ। ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের এমন কর্মকাণ্ডে রুষ্ট হয়ে ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ গত নভেম্বরে এক সাক্ষাৎকারে ন্যাটোকে ‘মৃতপ্রায়’ বলে অভিহিত করেন। তাঁর এমন মন্তব্যের সঙ্গে পুরোপুরি দ্বিমত পোষণ করেন জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল। তবে ন্যাটো নিয়ে ফরাসি প্রেসিডেন্টের মূল্যায়নকে অতি ‘সত্য কথন’ হিসেবে মন্তব্য করে রাশিয়া।

তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। ছবি: রয়টার্স
তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। ছবি: রয়টার্স

লন্ডনে ন্যাটো সম্মেলনের দিন কয়েক আগে সিরিয়ায় কুর্দিদের ওপর হামলা নিয়ে তুরস্কের সঙ্গে ফ্রান্সের একচোট হয়ে যায়। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ‘গো’ ধরেন, কুর্দিদের ব্যাপারে আঙ্কারার অবস্থান সমর্থন না করলে বাল্টিক অঞ্চলের নিরাপত্তা নিয়ে ন্যাটোর পরিকল্পনায় নারাজি জানাবে তাঁর দেশ।

ন্যাটোকে ‘মৃতপ্রায়’ বলায় লন্ডনে মাখোঁকে কঠোর ভাষায় আক্রমণ করেন ট্রাম্প। মাখোঁও ছেড়ে কথা বলেননি।

শুধু তা-ই নয়, লন্ডনে ট্রাম্পকে নিয়ে হাসি-তামাশাও করেন মাখোঁসহ অন্য ন্যাটো নেতারা। এতে আরও চটেন ট্রাম্প।

ন্যাটো নেতাদের মধ্যকার টানাপোড়েনে লন্ডনের উৎসব মাটি হয়। ন্যাটোর এই ‘লেজেগোবরে’ হালে পুতিনের চেয়ে কে আর বেশি খুশি হতে পারেন!