ব্রেক্সিটেই ফল, তবু বিভাজন প্রকট

বরিস জনসন
বরিস জনসন

ব্রেক্সিট নিয়ে অচলাবস্থা কাটাতে জোয়ার সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। তাঁর একক ইস্যু ব্রেক্সিট কার্যকরের বার্তা ব্রিটিশ ভোটারদের কাছে সমাদৃত হয়েছে। অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে পিষ্ট হলেও ভোটাররা কৃচ্ছ্রের অবসানে লেবার পার্টির অনেকটা বৈপ্লবিক কর্মসূচিতে আস্থা পাননি। ফলে জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর যখন অনেকেই তাঁকে ইতিহাসের অন্যতম সংক্ষিপ্ততম মেয়াদের প্রধানমন্ত্রী ভেবেছিলেন, তা ভুল প্রমাণ করে মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যেই তিনি দলটিকে ৩১ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় জয় এনে দিতে পেরেছেন।

নির্বাচনে পার্লামেন্টের আসনসংখ্যা ভাগাভাগির চিত্রে যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আড়ালে পড়ে যাচ্ছে, তা হলো ব্রেক্সিট বিভাজন প্রায় একই রকম রয়ে গেছে। ব্রেক্সিটের পক্ষে কনজারভেটিভ এবং ব্রেক্সিট পার্টির মোট ভোটের হার হচ্ছে ৪৮ শতাংশ আর বিপক্ষে পড়া ভোটের হার ৫২ শতাংশ। ২০১৬ সালের গণভোটে ব্রেক্সিটের পক্ষে ভোট ছিল ৫২ শতাংশ, বিপক্ষে ৪৮ শতাংশ। ৪ শতাংশের ব্যবধানই রয়ে গেছে, তবে উল্টোভাবে।

ফলে ব্রেক্সিট প্রশ্নে দেশটিতে যে চরম বিভাজন তৈরি হয়েছে, তা একটুও কমেনি। নতুন সরকারের জন্য ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের পাশাপাশি এই বিভাজন কাটানোর প্রশ্নটিও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। এই নির্বাচনের ফল আবারও প্রমাণ করেছে যে ব্রেক্সিট পার্টি কনজারভেটিভ পার্টির জন্য যে হুমকি তৈরি করেছিল, একক স্লোগান ‘গেট ব্রেক্সিট ডান’–এর মাধ্যমে বরিস তা মোকাবিলা করেছেন এবং ব্রেক্সিট সমর্থকেরা তাঁর পেছনেই জড়ো হয়েছেন।

বিপরীতে ব্রেক্সিট পুরোপুরি বাতিল, আরও একটি গণভোট, নাকি নতুন করে সমঝোতা করে তারপর গণভোট—এ রকম ভিন্ন ভিন্ন ধারায় বিভক্ত ছিল তাঁর প্রতিপক্ষ। লিবারেল ডেমোক্র্যাটরা যেমন শুধু করবিনের নেতৃত্বের কারণে লেবার পার্টির সঙ্গে সমঝোতার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছে, তেমনই লেবার পার্টিও কনজারভেটিভদের কৃচ্ছ্রনীতিতে অতীত সমর্থনের কারণে লিবারেলদের থেকে দূরে থাকতে চেয়েছে। কিন্তু লেবার ও লিবারেলদের এই রেষারেষি যে ব্রেক্সিটবিরোধীদের আশাভঙ্গের জন্য যথেষ্ট ছিল, সেটা ভোটের ফলাফলে প্রমাণিত হয়েছে। লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের ভোটের হার যে ৪ শতাংশ বেড়েছে, সেগুলো প্রধানত লেবারের ভোট এবং এই রেষারেষি না থাকলে হয়তো তাদের আসনসংখ্যা আরও কিছু বাড়ত।

>

যুক্তরাজ্যে নির্বাচন
ইতিহাসের সংক্ষিপ্ততম মেয়াদের প্রধানমন্ত্রী ভাবা হলেও বরিস তা ভুল প্রমাণ করলেন

কনজারভেটিভ পার্টি এখন যেকোনো আইন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। নির্বাচনে তাদের আসন বেড়েছে ৪৭টি এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতার ব্যবধান প্রায় আশির ঘরে। বিপরীতে বিরোধী দল লেবার পার্টির আসন গতবারের তুলনায় কমেছে ৫৯টি। তৃতীয় অবস্থানে গতবার যে স্কটিশ জাতীয়তাবাদীরা ছিলেন, এবার তাঁদেরও আসন বেড়েছে ১৩টি। কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে যাঁরা তৃতীয় শক্তি হিসেবে গণ্য হতেন, সেই লিবারেল ডেমোক্র্যাটরাও গতবারের তুলনায় এবার একটি আসন কম পেয়েছে এবং দলের নেতা নিজে পরাজিত হয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, এ রকম বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন কি একলা চলার নীতি অনুসরণ করবেন, নাকি পার্লামেন্টে ঐকমত্য ও সমঝোতা তৈরির চেষ্টা করবেন?

লৌহমানবীখ্যাত মার্গারেট থ্যাচারের পর গত তিন দশকে কনজারভেটিভ পার্টির এত বড় বিজয় যে বড় প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে, তা হলো বরিস কনজারভেটিভ পার্টিকে কোন পথে নিয়ে যাবেন। থ্যাচার যে কট্টর বাজার অর্থনীতি এবং বিরাষ্ট্রীয়করণের নীতি অনুসরণ করে দলটিকে মধ্য-ডানপন্থার পথ থেকে সরিয়ে কট্টর রক্ষণশীলতার পথে নিয়ে গিয়েছিলেন, সে রকম কিছুরই কি পুনরাবৃত্তি ঘটবে? নাকি ট্রাম্পের ব্রিটিশ সংস্করণ হিসেবে আবির্ভূত হবেন? নাকি যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান পার্টির মতোই যুক্তরাজ্যেও কনজারভেটিভ পার্টিকে নিও-কনজারভেটিজম বা নতুন ধরনের সংরক্ষণবাদের পথে নিয়ে যাবেন?

বরিস জনসনের বিরুদ্ধে উচ্চাকাঙ্ক্ষী, আত্মকেন্দ্রিক ও সুবিধাবাদিতার নানা অভিযোগ আছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মতো তাঁর বিরুদ্ধেও মিথ্যাকে সত্য এবং সত্যকে মিথ্যা হিসেবে হাজির করার অভিযোগ আছে। ট্রাম্পের মতোই তাঁর কৌশল হচ্ছে তথ্যপ্রবাহকে একমুখী রাখা, যেখানে তাঁরা যা বলেন সেটাই প্রচারিত হয়, সেগুলোর সত্যতা যাচাইয়ের সুযোগ দিতে তাঁরা নারাজ। বরিস তাই এবারের নির্বাচনে গণমাধ্যমের জেরা এড়ানোর জন্য অবিশ্বাস্য রকম নানা কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন। এমনকি ভোরবেলার টিভি অনুষ্ঠানের সরাসরি সম্প্রচারে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব এড়াতে বড় ফ্রিজারে ঢুকে যাওয়ার মতো দৃশ্যও ভোটাররা দেখেছেন। একের পর এক সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে অন্য সব নেতা হাজির হলেও তিনি গরহাজির থেকেছেন।

প্রধানমন্ত্রী বরিস নির্বাচনে ব্রেক্সিট ছাড়া অন্য কোনো ইস্যুতেই তাঁর দলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বিস্তারিতভাবে কিছু বলেননি। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলোতে এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে যুক্তরাজ্যের ভূমিকা কী হবে, সেগুলোর সামান্যই উল্লেখ ছিল তাঁর ইশতেহারে। ফলে এসব বিষয়ে ভোটারদের কাছে জবাবদিহি এড়ানোর সুযোগ তিনি তৈরি করেই রেখেছেন। অনেকের ধারণা, ব্রেক্সিট বাস্তবায়িত হলে বরিস অন্তত ‍দুই মেয়াদে সরকার পরিচালনার পথ নিশ্চিত করলেন।

নির্বাচনের এই ফল নিশ্চিত করছে যে ব্রেক্সিটের প্রথম ধাপটি আগামী ৩১ জানুয়ারিতে কার্যকর হবে। কেননা, তিনি হয়তো বড়দিনের আগেই পার্লামেন্টে তাঁর সম্পাদিত চুক্তি অনুমোদন এবং প্রয়োজনীয় আইনগুলো করে নিতে সক্ষম হবেন। কিন্তু তাঁর জন্য আসল পরীক্ষা হবে দ্বিতীয় ধাপে, যেখানে ২০২০ সালের মধ্যে ইউরোপের সঙ্গে তাঁর বাণিজ্যসহ অন্যান্য বিষয়ের বোঝাপড়া সম্পন্ন করতে হবে। যার মানে হচ্ছে বাণিজ্য ও সেবা খাত, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তার মতো বিষয়গুলোতে গত চার দশকের ব্যবস্থাগুলোর বদলে নতুন কী কী ব্যবস্থা করা হবে, সেসব বিষয়ে দর–কষাকষি ও চুক্তি এক বছরের মধ্যেই শেষ করা। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এটি অসম্ভব। কারণ, এ ধরনের বাণিজ্য চুক্তিতে কানাডার সময় লেগেছে সাত বছর। অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও অভিজ্ঞতা একই রকম। তাঁরা বলছেন, সে কারণে জুলাইতেই বরিসকে ইউরোপের কাছে সময় বাড়ানোর আবেদন করতে হবে। সময় বাড়ানোর মানে হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইউরোপের আইনকানুনগুলো মেনে চলার মেয়াদ বাড়ানো।

ব্রেক্সিটের একটি বড় উদ্দীপক ছিল যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের নিজস্ব বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন। বরিসের বিজয়ের খবরকে স্বাগত জানিয়ে ট্রাম্প ইতিমধ্যেই বলেছেন যে এখনই সামগ্রিক বাণিজ্য আলোচনা শুরু হোক।

প্রধানমন্ত্রী বরিসের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি কিন্তু ইতিমধ্যেই ছুড়ে দিয়েছেন স্কটিশ জাতীয়তাবাদী নেতা স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার নিকোলা স্টারজিয়ন। তিনি আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার বিষয়ে গণভোটের আইনের খসড়া প্রকাশ করার ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, ওই গণভোটের জন্য স্কটল্যান্ডের কারও সম্মতি বা অনুমতির প্রয়োজন নেই। প্রধানমন্ত্রী বরিস নির্বাচনী প্রচারের সময়ে বলেছেন, তিনি এ ধরনের গণভোটে সম্মতি দেবেন না। স্কটিশ জাতীয়তাবাদীরা এই নির্বাচনে ৮০ শতাংশ আসনে জয়ী হওয়ায় তাঁদের উপেক্ষা করা এখন সহজ হবে না। স্কটল্যান্ড ব্রেক্সিটের ঘোরবিরোধী।

যুক্তরাজ্যের অখণ্ডতার প্রতি আরেকটি হুমকি তৈরি হয়েছে উত্তর আয়ারল্যান্ড, যারা ব্রেক্সিটের বিরুদ্ধে গণভোটে রায় দিয়েছিল। সেখানে কনজারভেটিভদের যে দলটি সমর্থন দিয়েছিল, তাদের আসনসংখ্যা কমেছে এবং দলীয় নেতা হেরে গেছেন। বিপরীতে আইরিশ জাতীয়তাবাদীরা বেশি সংখ্যায় জিতেছেন এবং তাঁরাও আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য গণভোট দাবি করতে পারেন। ফলে যুক্তরাজ্যের অখণ্ডতা রক্ষার প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দেবে।

বরিসের বিষয়ে নেতিবাচক কথা যতই থাকুক না কেন, লন্ডনবাসীর অভিজ্ঞতা কিন্তু ততটা বিরূপ নয়। লন্ডনের মেয়র হিসেবে বরিস সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলার চেষ্টা করেছেন। অবৈধ অভিবাসীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার সুযোগ দিতে তিনি ক্যামেরন সরকারের সঙ্গে দেন-দরবার করেছিলেন। বিজয়ের পর দলীয় সমর্থকদের উদ্দেশে বলেছেন, তিনি কাউকেই উপেক্ষা করবেন না।

এই পার্লামেন্টের আরেকটি উল্লেখযোগ্য অর্জন হচ্ছে সর্বোচ্চ ৬৫ জন, অর্থাৎ প্রতি ১০ জনে ১ জন এমপি সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী। গত ১০ বছরে পার্লামেন্টে এই জাতিগোষ্ঠীগত বৈচিত্র্য কার্যত প্রায় চার গুণ বেড়েছে। এঁদের মধ্যে ৩৭ জন সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর নারী।