করুণ পরিণতিই পাকিস্তানি শাসকদের নিয়তি

পারভেজ মোশাররফ। ছবি: রয়টার্স
পারভেজ মোশাররফ। ছবি: রয়টার্স

রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে পাকিস্তানের সাবেক সামরিক শাসক জেনারেল পারভেজ মোশাররফকে। ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করা পারভেজ মোশাররফই দেশটির প্রথম সামরিক শাসক, যাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো। তবে পাকিস্তানি শাসকদের এমন করুণ পরিণতি কিন্তু বিরল নয়। দেশটির অনেক শাসককেই এমন পরিণতি বরণ করতে হয়েছে। লিয়াকত আলী খান থেকে শুরু করে পারভেজ মোশাররফ—পাকিস্তানি শাসকদের মধ্যে কার পরিণতি কেমন ছিল, তা নিয়েই এ আয়োজন:

লিয়াকত আলী খান
লিয়াকত আলী খান পাকিস্তানের ইতিহাসের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। ১৯৪৯ সালে পাকিস্তানের সংবিধানের রূপরেখা প্রণয়ন করেছিলেন তিনি। এর আড়াই বছরের মাথায় খুন হতে হয় তাঁকে। ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর রাওয়ালপিন্ডির কোম্পানিবাগে এক জনসভায় ভাষণ দেওয়ার সময় আততায়ীর গুলিতে নিহত হন তিনি। তাৎক্ষণিকভাবে এই হত্যাকাণ্ডের কারণ জানা না গেলেও পরবর্তী সময়ে এর রহস্য উন্মোচিত হয়। আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ৬৪ বছর পর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে প্রকাশিত এক গোপন নথি থেকে জানা যায়, আফগানিস্তানের তৎকালীন সরকারের সহায়তায় লিয়াকত আলী খানকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ।

গোপন ওই নথির বরাতে জানা যায়, গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে মার্কিন তেল কোম্পানিগুলোকে ইরানে তেল–সংশ্লিষ্ট চুক্তি পাইয়ে দেওয়ার জন্য লিয়াকত আলী খানকে অনুরোধ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। সে সময় লিয়াকত আলী খানের সঙ্গে ইরানের বেশ সুসম্পর্ক ছিল। কিন্তু লিয়াকত আলী খান যুক্তরাষ্ট্রের ওই প্রস্তাবে রাজি হননি। এমনকি পাকিস্তান থেকে মার্কিন ঘাঁটি সরানোর দাবি জানান তিনি। যে কারণে তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করে সিআইএ। কৌশলগত কারণে তারা আফগানিস্তানের শরণাপন্ন হয়। আফগানিস্তানও যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গিয়েছিল। ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর জনসভায় ভাষণ দিতে উঠলে সৈয়দ আকবর নামের এক আততায়ী লিয়াকত আলী খানের বুক বরাবর দুটি গুলি করেন। তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে নিয়ে গেলেও বাঁচানো যায়নি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে।

জুলফিকার আলী ভুট্টো। ছবি: রয়টার্স
জুলফিকার আলী ভুট্টো। ছবি: রয়টার্স

জুলফিকার আলী ভুট্টো
পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) প্রতিষ্ঠাতা জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের রাজনীতির ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত চরিত্র। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের কাছে আত্মসমর্পণের পর ইয়াহিয়া খানের জায়গায় প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পান তিনি। ১৯৭৩ সালে সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু স্বস্তিতে ক্ষমতা ভোগ করতে পারেননি তিনি। বিশ্লেষকদের মতে, ভুট্টোর ‘একনায়কতান্ত্রিক’ আচরণের কারণে পাকিস্তানজুড়ে ক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে। তাঁর গ্রহণযোগ্যতাও দুর্বল হতে থাকে। এই সুযোগে ১৯৭৭ সালে ভুট্টোকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে নেন জিয়া-উল-হক। অথচ জুলফিকার আলী ভুট্টোই তাঁকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন।

শুধু ক্ষমতা হারানোই নয়, ভুট্টোর জন্য অপেক্ষা করছিল আরও বড় দণ্ড। ১৯৭৪ সালে এক রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর বাবাকে হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন ভুট্টো। রায়ে তাঁর মৃত্যুদণ্ড হয়। অবশেষে ১৯৭৯ সালের ৩ এপ্রিল মাঝরাতে রাওয়ালপিন্ডি কারাগারে ভুট্টোর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

জিয়া-উল-হক
জুলফিকার আলী ভুট্টোকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন যিনি, সেই জেনারেল জিয়া-উল-হকের পরিণতিও সুখকর হয়নি। ১৯৭৮ সালে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতায় আসেন তিনি। দীর্ঘ ১০ বছর ক্ষমতা আঁকড়ে ছিলেন জিয়া-উল-হক। ১৯৮৮ সালের ৭ আগস্ট রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে ৪০০ মাইল দক্ষিণে বাহওয়ালপুর থেকে রাজধানীতে ফিরছিলেন তিনি। পাকিস্তানে নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত আরনল্ড রাফেল ও মার্কিন সামরিক উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হারবার্ট এম ওয়াসমও তাঁর সঙ্গে একই উড়োজাহাজে ছিলেন। স্থানীয় সময় বেলা ৩টা ৪০ মিনিটে বাহওয়ালপুর থেকে আকাশে ওড়ার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই বিধ্বস্ত হয় প্রেসিডেন্টকে বহনকারী বিমান। এতে উড়োজাহাজে থাকা ৩১ জন নিহত হন।

এই দুর্ঘটনা ঘিরে শুরু থেকেই রহস্যের গন্ধ পেয়েছিলেন অনেকে। গত বছর এই দুর্ঘটনার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের হাত ছিল বলে দাবি করেন পাকিস্তানের সিনেটর মুশাহিদ হোসেইন। পাকিস্তানের একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি দাবি করেন, জিয়া-উল-হককে হত্যার পেছনে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক প্রশাসন যৌথভাবে কাজ করেছিল।

বেনজির ভুট্টো। ছবি: এএফপি
বেনজির ভুট্টো। ছবি: এএফপি

বেনজির ভুট্টো
ভুট্টো পরিবারের দ্বিতীয় সদস্য হিসেবে পাকিস্তানের শীর্ষ ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলেন বেনজির ভুট্টো। তিনি জুলফিকার আলী ভুট্টোর মেয়ে। হার্ভার্ড ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা নেওয়া বেনজির ১৯৮৬ সালে নির্বাচনে জিতে প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। কিন্তু ক্ষমতার মেয়াদ শেষ করতে পারেননি তিনি। ১৯৯০ সালে তিনি বরখাস্ত হন। ১৯৯৩ সালে দ্বিতীয়বার নির্বাচনে জিতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু সেবারও মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি, উৎখাত হন তিন বছর পরেই। এরপর একপ্রকার স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান বেনজির। ২০০৭ সালের অক্টোবরে পুনরায় পাকিস্তানে ফেরেন তিনি। তাঁর দেশে ফেরার দিনই করাচিতে ভয়াবহ বোমা বিস্ফোরণে শতাধিক ব্যক্তি নিহত হন। সৌভাগ্যবশত ওই ঘটনায় বেঁচে যান বেনজির। কিন্তু দুই মাস পর সৌভাগ্য আর সঙ্গ দেয়নি তাঁকে। লিয়াকত আলী খানকে যেখানে হত্যা করা হয়েছিল, রাওয়ালপিন্ডির সেই এলাকাতেই ২০০৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর এক নির্বাচনী জনসভায় আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত হন বেনজির।

নওয়াজ শরিফ। ছবি: এএফপি
নওয়াজ শরিফ। ছবি: এএফপি

নওয়াজ শরিফ
তিনবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন নওয়াজ শরিফ। কিন্তু কোনোবারই মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি তিনি। ১৯৯০ সালের ১ নভেম্বর প্রথমবার ক্ষমতায় আসেন নওয়াজ। তিন বছর পূরণের আগেই ক্ষমতা ছাড়তে হয় তাঁকে। ১৯৯৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। তখন ক্ষমতা ছাড়তে হয় আড়াই বছরের মাথায়। ২০১৩ সালের নির্বাচনে জিতে ফের ক্ষমতায় আসেন নওয়াজ শরিফ। কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগে সেবারও ক্ষমতা ছাড়তে হয় তাঁকে। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বর্তমানে দুর্নীতির মামলায় ১০ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করছেন নওয়াজ। একই মামলায় তাঁর মেয়ে মরিয়ম শরিফকেও সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

তথ্যসূত্র: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, বিবিসি, গার্ডিয়ান, ডন, জিও টিভি ও পাকিস্তান টুডে