খাসোগি হত্যাকাণ্ডের তদন্তে সৌদি আরব যা করল

সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগি। রয়টার্স ফাইল ছবি।
সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগি। রয়টার্স ফাইল ছবি।

সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে বছরজুড়েই আলোচনা ছিল। নিন্দুকদের দাবি, সৌদি সরকারের প্রত্যক্ষ মদদেই এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এ ঘটনায় সৌদি সরকারের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে লাগাতার সমালোচনার মধ্যেই গতকাল সোমবার পাঁচজনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন সৌদি আরবের একটি আদালত। এ ছাড়া তিনজনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে সৌদি আরব কী কী করেছে, তা নিয়ে বিস্তারিত জানিয়েছে বার্তা সংস্থা এএফপি।

আসুন, দেখে নেওয়া যাক জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে সৌদি তদন্তের ইতিবৃত্ত:

সন্দেহভাজনের তালিকায় ৩১
সৌদি প্রসিকিউটর অফিস কারও নাম না উল্লেখ না করে জানিয়েছে খাসোগি হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে মোট ৩১ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত করা হয়। এদের মধ্যে ২১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ১০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। ১১ জন অভিযুক্ত হয় এবং রিয়াদের আদালতে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য যুক্তরাজ্য, চীন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের প্রতিনিধিরা পর্যবেক্ষক হিসেবে বিচারকাজে উপস্থিত ছিলেন।

পাঁচজনের মৃত্যুদণ্ড
প্রসিকিউটর অফিস জানায়, সরাসরি এ হত্যাকাণ্ডে যুক্ত থাকায় পাঁচজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে এই অন্যায় কাজে সহায়তা ও আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে তিনজনকে বিভিন্ন দণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। সব মিলিয়ে এই শাস্তির মেয়াদ ২৪ বছর। অভিযুক্ত ১১ জনের মধ্যে তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ খারিজ হয়ে যায়। এ হত্যাকাণ্ডের মামলায় সব তথ্যপ্রমাণে দেখা যায় এই হত্যাকাণ্ড পূর্ব-পরিকল্পিত ছিল না।

শীর্ষ দুই কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার
যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ঘনিষ্ঠ দুই ব্যক্তিকে তথ্য-প্রমাণের অভাবে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এ দুজন হলেন গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক উপপ্রধান আহমেদ আল-আসিরি ও রাজকীয় আদালতের সাবেক শীর্ষ গণমাধ্যম কর্মী সৌদ আল-কাহতানি। এই হত্যাকাণ্ডের পর দুজনকেই বরখাস্ত করা হয়। তবে শুধু আসিরিকে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়।

গত বছর যুক্তরাষ্ট্র এই হত্যাকাণ্ডের রেশে কাহাতানিসহ ১৭ সৌদি নাগরিকের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ বলছে, কাহতানি ‘এই হত্যা পরিকল্পনা ও তা কার্যকরের অংশ ছিলেন।’

এই হত্যাকাণ্ডের পর থেকে কাহাতানিকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। এখন তিনি কোথায় আছেন, তাও অজানা।

সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান।
সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান।

অভিযোগের তির সৌদি যুবরাজের দিকে
এ হত্যাকাণ্ডের বিচারকাজ থেকে প্রিন্স মোহাম্মদকে দূরে রাখতে চেষ্টা করে দেশটির প্রসিকিউটর অফিস। যুক্তরাষ্ট্রের সম্প্রচার ও টেলিভিশন অনুষ্ঠান বণ্টনকারী সংস্থা পিবিএসের একটি প্রামাণ্যচিত্রে সৌদি যুবরাজ এ হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছেন। কারণ তাঁর ‘নজরদারির’ মধ্যে এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। তবে এ সম্পর্কে আগে থেকে তিনি কিছু জানতেন না বলে দাবি করেন।

মামলার রায়ের প্রতিক্রিয়ায় জাতিসংঘের বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ার অ্যাগনেজ ক্যাল্লামার্ড বলেছেন, এই বিচার ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। এই রায় একটি উপহাস। অ্যাগনেজ ক্যাল্লামার্ড আরও বলেন, তিনি নিজে এ ঘটনার তদন্ত করেছেন। সে সময় তিনি এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সৌদি যুবরাজের জড়িত থাকার বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পেয়েছিলেন।

ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ বরাবরই বলে আসছে যে, এই খুনের আদেশ যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান দিয়েছেন বলে তাদের বিশ্বাস।

খাসোগির লাশ
সৌদি প্রসিকিউটর অফিস আগে বলেছিল, খাসোগি কনস্যুলেটে যাওয়ার পর ধ্বস্তাধ্বস্তি হয়। তাকে নিবৃত্ত করতে জোর করে ইনজেকশনের মাধ্যমে অতিমাত্রায় ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। মাত্রাতিরিক্ত ওষুধের কারণে তাঁর মৃত্যু হয়। এরপর তাঁর লাশ কেটে টুকরো টুকরো করে ‘কনস্যুলেটের বাইরে’ এক ‘সহযোগীর’ হাতে তুলে দেওয়া হয়। এরপর খাসোগির লাশ নিয়ে কী করা হয়েছে, তা আজও অজানা।

অবশ্য জাতিসংঘের বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ার অ্যাগনেজ ক্যাল্লামার্ড বলছেন, ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া অডিও ট্রান্সস্ক্রিপ্টে শোনা গেছে যে, সৌদি এজেন্টরা খাসোগিকে ‘কোরবানির পশু’র সঙ্গে তুলনা করেছিল। জাতিসংঘের তদন্ত দল ওই গোপন কথোপকথন শুনেছিলেন। ওই কথোপকথনে খাসোগিকে হত্যার পর তাঁকে কেটে টুকরো টুকরো করার কথা সৌদি কর্মীদের বলতে শোনা গিয়েছিল।

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের জুনে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ক্রাউন প্রিন্স হন। এর পর পরই তাঁর কড়া সমালোচক হিসেবে খাসোগি যুবরাজের রোষানলে পড়েন। দুর্নীতিবিরোধী ও ভিন্নমত দমনের অভিযানে ব্যাপক ধরপাকড়ের মধ্যে নিজেকে বাঁচাতে ওই বছরের সেপ্টেম্বরে সৌদি আরব ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে স্বেচ্ছানির্বাসনে চলে যান একসময় সৌদি রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠ জামাল খাসোগি। স্বেচ্ছানির্বাসনের সময়ে তিনি ওয়াশিংটন পোস্টে কলাম লিখতেন। তাঁর কলামজুড়ে থাকত সৌদি শাসকদের বিরুদ্ধে গঠনমূলক সমালোচনা। ২০১৭ সালের অক্টোবরে যুবরাজের গণমাধ্যমবিষয়ক উপদেষ্টা কাহতানি খাসোগির সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে যুবরাজের পক্ষে কলাম লেখার অনুরোধ জানান। সঙ্গে এও জানানো হয় যে, খাসোগির লেখা প্রতিটি শব্দ যুবরাজের নজরে রয়েছে। কিন্তু সে কথা শোনেননি খাসোগি। আর কথা না শোনার পরিণতি তাঁকে ভোগ করতে হয়েছে ঠিক পরের বছরের অক্টোবরে প্রাণ দিয়ে।

ব্যক্তিগত কাগজপত্রের প্রয়োজনে গত বছরের ২ অক্টোবর তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেট ভবনে যান জামাল খাসোগি। কিন্তু সেখান থেকে আর বেরিয়ে আসেননি তিনি। বলা হচ্ছে, সৌদি থেকে দুটি ব্যক্তিগত বিমানে আসা ১৫ সদস্যের একটি স্কোয়াড কনস্যুলেট ভবনের ভেতর খাসোগি হত্যায় অংশ নেয়। হত্যার পর ওই স্কোয়াড দ্রুত তুরস্ক ত্যাগ করে। তুরস্কের স্থানীয় দৈনিকগুলোয় ওই ১৫ জনের ছবি ও পরিচয় প্রকাশ করা হয়েছে।

নিখোঁজের দিন থেকে প্রায় প্রতিদিন খাসোগি ছিলেন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ খবরে। বলা হচ্ছে, সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের নির্দেশে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। যদিও সৌদি আরব বরাবরই তা অস্বীকার করে আসছে।