একনায়কের প্রতিবাদে মানুষ কেন ব্যর্থ

কানাডীয় ঔপন্যাসিক মার্গারেট অ্যাটউড তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য হ্যান্ডসমেইড টেল’–এ দেখিয়েছিলেন, ‘রিপাবলিক অব গিলেড’ নামের একটি কল্পিত রাষ্ট্রে কীভাবে একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুকৌশলে টিকিয়ে রাখা হয়েছিল। একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে না পেরে সেখানকার বেশির ভাগ জনগণই মুখ বুজে অত্যাচার সহ্য করতেন। কিন্তু এই উপন্যাসের পরবর্তী পর্বে ‘দ্য টেস্টামেন্টস’–এ তিনি দেখিয়েছেন, সাহস ও ভাগ্য থাকলে এমন পরিস্থিতিতেও মানুষের পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব।

কিন্তু আসলেই কি মানুষ প্রতিবাদ করতে পারে? অতীতে এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে, যেখানে মানুষ প্রতিবাদ করতে ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমান দুনিয়াতেও একনায়কতান্ত্রিক শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার উদাহরণ একেবারেই নগণ্য। শোষিত হওয়া সত্ত্বেও যখন প্রতিবাদের ঢেউ ওঠে না, তখন অনেকেই চট করে সিদ্ধান্তে পৌঁছে যেতে চান, মুখ বুজে থাকা মানুষগুলোকে ‘মেরুদণ্ডহীন’ বলে আখ্যা দিতে চান। কিন্তু মানুষ কেন প্রতিবাদ করতে ব্যর্থ হয়, গভীরে গিয়ে সেটির বিশ্লেষণ অনেকেই করতে চান না।

এই বিষয়টি নিয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম স্ক্রল ডট ইন। নিবন্ধে বলা হয়েছে, এমন প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন আমেরিকান তাত্ত্বিক জেমস মার্চ ও নরওয়ের বিজ্ঞানী ইয়োহান ওলসেন। তাঁদের মতে, কোনো নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে, বেশির ভাগ মানুষই সেটি ঠিক করে একজন ‘ভালো অর্থনীতিবিদের’ মতো। প্রতিক্রিয়া দেখালে তিনি লাভবান হবেন, না কি প্রতিক্রিয়া না দেখালে লাভবান হবেন—এটি বিবেচনা করার পর তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন প্রতিক্রিয়া দেখাবেন, না কি দেখাবেন না।

কিন্তু সবাই তো আর এক রকম হয় না। এক ধরনের মানুষও আছেন, যারা নিজেদের বিবেকের প্রতি দায়বদ্ধ। একনায়কতন্ত্রের মধ্যে থাকার সময় তাঁরা নিজেদের কাছেই প্রশ্ন রাখেন, ‘এমন পরিস্থিতিতে আমার মতো একজন মানুষের কী করা উচিত?’

কেউ প্রতিবাদী হবে না কি অনুগামী—সেটি তাঁর ব্যক্তিত্বের ওপরেও নির্ভর করে। ফুটবল মাঠে রেফারির সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া কিংবা পুলিশের সিদ্ধান্ত মেনে চলাটাই নিয়ম—শিশুদের ছোটবেলা থেকে এমনটাই শেখানো হয়। তিন বছর বয়সী শিশুও কিন্তু খেলার মাঠে অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করে। প্রশ্ন হলো, সেই শিশুই যখন বড় হয়, কেন সে প্রতিবাদ করতে পারে না? এর বড় একটা কারণ হলো একনায়কতান্ত্রিক শাসকদের শাসননীতি। বলা হয়ে থাকে, একনায়কতান্ত্রিক শাসকদের এক হাতে থাকে উপহার, আরেক হাতে লাঠি। যদি আপনি শাসকদের সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হন, তাহলে আপনার জন্য থাকবে উপহার। আর যদি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেন, তাহলে জুটবে শাস্তি। তাঁরা জনগণকে নিজেদের সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত পোষণ করতে বাধ্য করে। শাস্তির খড়গ মাথার ওপর ঝুলন্ত অবস্থায় থাকায় মানুষ নিজেও অনুগামী হয়, অন্যকেও হতে প্রভাবিত করে। শাসকেরাই ঠিক করে দেয়—মানুষ কোনটিকে সঠিক ভাববে, আর কোনটিকে ভুল।

তবে সব সমাজেই হাতেগোনা কিছু মানুষ থাকেন, যারা স্বভাবগতভাবেই কিছুটা প্রতিবাদী। কিন্তু সেই সংখ্যাটা খুব কম।

সিংহভাগ মানুষের প্রতিবাদ না করার প্রবণতার বিষয়েও ব্যাখ্যা মিলেছে। গবেষকেরা বলছেন, যারা একটু ঝুঁকি নিতে ভয় পান এবং সহজেই অন্যকে বিশ্বাস করে বসেন, তাঁদের প্রতিবাদ করার হার খুব কম। চোখের সামনে অন্যায় দেখলেও তাঁরা প্রতিবাদী হতে দ্বিধা বোধ করেন। আরেকটি কারণ হচ্ছে, সামাজিক বাস্তবতা।

গবেষণায় দেখা গেছে, অর্থনৈতিক দিক থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষেরা প্রতিবাদে যোগ দিতে দ্বিধা বোধ করেন। যাদের হারানোর কিছু নেই, কিংবা যারা সামাজিক মর্যাদার দিক থেকে আরও ওপরে ওঠতে চান, তাঁরাই বেশি প্রতিবাদ করেন। আবার নিজের চারপাশের লোকজন যখন মুখ বুজে থাকেন, তখন তাঁদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েও অনেকে মুখে কুলুপ আঁটেন।