কেমন কাটল জাপানের ২০১৯ সাল?

ছবি: রযটার্স
ছবি: রযটার্স

জীবন চক্রকে চীনারা দেখে থাকে আমাদের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। প্রাচীন চীনা দর্শনে মানবজীবন প্রতি ১২ বছরে একটি চক্র অতিক্রম করে। সময়ের সে হিসাব পারিপার্শ্বিক জীবনকেও প্রভাবিত করে। এতে চীনের জ্যোতির্বিজ্ঞান শাস্ত্রে সময়ের আবহমান স্রোতকে ১২ বছরের যে চক্রে ভাগ করা হয়েছে, তার প্রতিটি নির্দিষ্ট হয়েছে একেকটি প্রাণীর নামে।

প্রাচীন সেই শাস্ত্রে আরও বলা আছে, নতুন একটি বছর কী রকম যাবে, তার আঁচ কিছুটা পাওয়া যাবে যে প্রাণীর বছর, সেই প্রাণীর বৈশিষ্ট্যের দিকে আলোকপাত করার মধ্য দিয়ে। চীনা বর্ষপঞ্জির সেই হিসাব অনুযায়ী বিদায়ী ২০১৯ সাল হচ্ছে বন্য বরাহ বা বুনো শূকরের বছর। আর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা ২০২০ সাল হচ্ছে ইঁদুরের বছর। ১২ বছরের চক্র শুরু হয় ইঁদুরের বছর দিয়ে এবং শেষ হয় বন্য বরাহের বছরে। সেই হিসাব অনুযায়ী, নতুন এক চক্র আমাদের জীবনে এখন শুরু হতে যাচ্ছে।

লিখিত ভাষার লিপি থেকে শুরু করে ধর্ম পর্যন্ত অনেক কিছু জাপানে এসেছে চীন দেশ থেকে। সেই তালিকায় বর্ষপঞ্জিও বাদ যায়নি। ফলে জাপানেও বছরের গণনায় চীনা পদ্ধতিকে হিসাবের মধ্যে নেওয়া হয়। ইঁদুরের বছর চাঞ্চল্যে ভরা বছর হলেও একই সঙ্গে আবার সাফল্যের বাণীও শোনাতে শুরু করেছেন জ্যোতির্বিদেরা। অন্যদিকে বরাহের বছরটির হওয়ার কথা ছিল বাধাবিপত্তি দূর করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার বছর। দেখা যাক, কেমন ছিল জাপানের জন্য বিদায় নিতে যাওয়া বছরটি।

বছর শেষ হওয়ার মুখে হঠাৎ করেই জাপানের নিরাপত্তার বজ্র আঁটুনিকে প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে নিসান মোটরের সাবেক প্রধান কার্লোস গনের দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা নিয়ে। নিসানের এই সাবেক মুখ্য নির্বাহী বিচারের মুখোমুখি থাকা অবস্থায় কিছুদিন আগে জামিনে মুক্তি পেয়েছিলেন, যার একটি শর্ত ছিল জাপান ছেড়ে তাঁর চলে না যাওয়া। বছরের শেষ দিনে সেই ব্যক্তি বৈরুতে পৌঁছে সেখান থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেছেন, জাপান থেকে তিনি পালিয়ে যাননি, বরং জাপানের অন্যায় বিচারব্যবস্থা থেকে তিনি মুক্তি পেয়েছেন। গন কীভাবে জাপানের অভিবাসন ব্যবস্থাকে এড়িয়ে গিয়ে দেশ ছেড়ে চলে গেলেন, তার কিছুই এখনো পর্যন্ত জানা না গেলেও অনেকেই ধারণা করছেন পেছন থেকে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেনদরবার করেই তিনি হয়তো তা করে থাকবেন। তবে বৈরুত থেকে দেওয়া তাঁর বিবৃতির কঠোর ভাষা অবশ্য সে রকম সম্ভাবনার সঙ্গে মেলে না।

এ রকম এক আপাত চমক সৃষ্টি করা খবর দিয়ে জাপান বছর শেষ করতে চললেও ২০১৯ অনেক দিক থেকেই জাপানের জন্য ছিল প্রত্যাশা আর সম্ভাবনার সঙ্গে সংগতি রেখে চলা একটি বছর। বছরের সবচেয়ে আলোচিত সংবাদ অবশ্যই হচ্ছে সম্রাট আকিহিতোর সিংহাসন ত্যাগের মধ্যে দিয়ে যুবরাজ নারুহিতোর সিংহাসনে আরোহণ। জাপানে সম্রাটের সিংহাসন ত্যাগ হচ্ছে বিরল এক ঘটনা। তবে সম্রাট আকিহিতো বেশ কিছুদিন থেকে নিজেই বলে আসছিলেন বার্ধক্যের কারণে দায়িত্ব পালন তাঁর জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে এবং সম্রাটের আসন থেকে তিনি সরে যেতে চাইছেন। তবে সম্রাটের পরিবারসংক্রান্ত আইনে সিংহাসন ত্যাগের উল্লেখ না থাকায় শুরুতে আইনটি সংশোধন করে নিতে হয় এবং এর পরই এপ্রিল মাসের শেষ দিনে সম্রাট তাঁর পদ থেকে সরে দাঁড়ালে মে মাসের প্রথম দিনে সম্রাটের দায়িত্ব গ্রহণ করেন যুবরাজ নারুহিতো। সম্রাটের অভিষেক অবশ্য অনুষ্ঠিত হয়েছে নভেম্বরের শেষ দিকে।

নতুন সম্রাটের পাশাপাশি জাপান পেয়েছে নতুন একটি যুগ। জাপানে সাধারণত প্রতিটি সম্রাটের রাজত্বকালকে ভিন্ন যুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সেই হিসাবে আকিহিতোর কালটি ছিল হেইসেই যুগ এবং নতুন সম্রাট নারুহিতোর সিংহাসনে আসীন হওয়ার যুগটি চিহ্নিত হচ্ছে রেইওয়া বা শান্তিপূর্ণ সংগতির যুগ হিসেবে। সম্রাট তাঁর অভিষেক ভাষণে শান্তির আদর্শকে সমুন্নত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ২০১৯ সাল জাপানের জন্য খুব যে ভালো একটি বছর ছিল, তা অবশ্য নয়। বাণিজ্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিরোধের নিষ্পত্তি না হলেও দুই দেশ একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে নিতে সক্ষম হয়েছে, যে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি ও খামার পণ্যের ওপর থেকে শুল্ক হ্রাসের প্রতিশ্রুতি জাপান দেয়। অন্যদিকে জাপানের শিল্প পণ্য, বিশেষ করে মোটরগাড়ি ও যন্ত্রাংশের ওপর উচ্চহারের যে শুল্ক যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন চাপিয়ে দিয়েছে, তার সবটাই তুলে নেওয়া না হলেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে টোকিও এবং ওয়াশিংটন সম্মত হয়েছে।

জাপানের বাণিজ্য সংঘাত কেবল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেই নয়, একই সঙ্গে চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গেও চলমান। চীনের সঙ্গে বিরোধিতার মূল কারণ যতটা না জাপানের নিজের স্বার্থে, তার চেয়ে বেশি যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে পড়ে। বিশেষ করে হুয়ায়েই ও সংশ্লিষ্ট অন্য যে কয়েকটি উচ্চ প্রযুক্তির কোম্পানিকে যুক্তরাষ্ট্র কালো তালিকাভুক্ত করে, এদের পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ওয়াশিংটন চাইছে জাপান এবং অন্য কয়েকটি ঘনিষ্ঠ মিত্রদেশও যেন তাদের সেই পথ অনুসরণ করে। জাপান অবশ্য নানা রকম দোহাই দিয়ে সেই চাপ কিছুটা হলেও লাঘব করতে পেরেছে। অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে দেখা দেওয়া বাণিজ্য বিরোধের পেছনে আছে অন্য কিছু হিসাব।

দক্ষিণ কোরিয়ার সর্বোচ্চ আদালত বছরের প্রথমার্ধে দেওয়া রায়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কোরীয় উপদ্বীপের শ্রমিকদের বাধ্যতামূলকভাবে কাজে নিয়োগ করার জন্য জাপানের কয়েকটি কোম্পানিকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ জারি করলে জাপান সেটাকে গ্রহণযোগ্য মনে করেনি।

জাপান বলছে, দুই দেশ ১৯৬৫ সালে স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে নেওয়ার সময় ক্ষতিপূরণ বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। পাশাপাশি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলার সময় জাপানি সৈন্যদের মনোরঞ্জনের জন্য কোরীয় তরুণীদের বাধ্যতামূলক যৌন সেবা প্রদানে নিয়োগ করা নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার গ্রহণ করা কঠোর অবস্থান নিয়েও জাপান অসন্তুষ্ট।

বিতর্কিত এসব বিষয় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে দেখা দেওয়া তিক্ততা সম্পর্ককে তলানির পর্যায়ে নিয়ে গেলে জুলাই মাসে জাপান হঠাৎ করে দক্ষিণ কোরিয়ায় রপ্তানি হওয়া উচ্চ প্রযুক্তি পণ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ কঠোর করে। পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে সিউল, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে স্বাক্ষরিত একটি সামরিক গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান চুক্তি থেকে বের হয়ে যাওয়ার হুমকি দেয়। যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত তাদের মধ্যস্থতায় দুই দেশ একটি আপস-মীমাংসায় পৌঁছায়।

২০১৯ সালে চীনের সঙ্গে দেখা দেওয়া দূরত্ব জাপান অনেকটা দূর করে নিতে পারলেও দক্ষিণ কোরিয়ার বিষয়াবলির সম্পূর্ণ নিষ্পত্তি এখনো হয়নি। অন্যদিকে চীনের ক্রমেই বাড়তে থাকা সামরিক শক্তি এবং পূর্ব চীন সাগরে দ্বীপের মালিকানা নিয়ে চলা ভূখণ্ডগত বিরোধ নিয়ে জাপানের উদ্বেগ এখনো দূর হয়নি। তবে তা সত্ত্বেও চীনের প্রেসিডেন্ট আগামী বসন্তে জাপান সফরে আসতে রাজি হওয়ায় ধারণা করা হচ্ছে, জাপান চীন সম্পর্কে বিরাজমান উষ্ণতা আগামী বছরেও বজায় থাকবে।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনের গুরুত্বপূর্ণ দুটি সমাবেশের আয়োজন জাপান ২০১৯ সালে সফলভাবে শেষ করতে পেরেছে। এর একটি হলো বিশ্বের ২০টি অগ্রসর অর্থনীতির জোট জি-২০-এর বার্ষিক শীর্ষ সম্মেলন এবং অন্যটি হচ্ছে আফ্রিকার উন্নয়নবিষয়ক টোকিও সম্মেলন। অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জন্য বছরটি ছিল কেলেঙ্কারির ঘটনাসংবলিত আরও একটি বছর।

ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলটির সঙ্গে এসব কেলেঙ্কারি জড়িত থাকা সত্ত্বেও অপেক্ষাকৃত দুর্বল বিরোধী শিবির এর সুযোগ সেভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। ফলে প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে জাপানের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে সরকারপ্রধানের দায়িত্ব পালনের রেকর্ড ২০১৯ সালেই গড়ে নিতে পেরেছেন।

জাপানের অর্থনীতি নানা দিক থেকে চাপের মুখে থাকা সত্ত্বেও গতিশীলতা পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেনি। বছরের মাঝামাঝি আঘাত হানা বড় দুটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেশের অর্থনীতির ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে এবং অক্টোবর থেকে ভোগ্যপণ্যের কর বৃদ্ধি অর্থনীতির ওপর আরও কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এসব কিছুর ফলে গতি শ্লথ হয়ে এলেও মন্দা অবস্থার মুখে অর্থনীতিকে পড়তে হয়নি।

বছরের আরেকটি সাফল্য জাপানের জন্য ছিল রাগবির বিশ্বকাপ আয়োজন করতে পারা। রাগবি তেমন জনপ্রিয় খেলা না হওয়ায় অনেকেই ধারণা করেছিলেন বিশ্বকাপের স্বাগতিক দেশ হওয়া অর্থনৈতিক দিক থেকে জাপানের জন্য বিড়ম্বনা হয়ে দেখা দিতে পারে। তবে শেষ পর্যন্ত তা হয়নি অনেকটা জাপানের জাতীয় দলের প্রত্যাশা ছাড়িয়ে যাওয়া পারদর্শিতার কারণে।

২০১৯ জাপানের জন্য কেটেছে সাফল্য-ব্যর্থতার মিশ্রণের মধ্য দিয়ে। ২০২০ সালের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়টি অবশ্যই হতে যাচ্ছে টোকিওতে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন। জাপানের নাগরিকদের পাশাপাশি বিশ্বের অনেক দেশের লোকজনই এখন সেই আয়োজনের দিকে তাকিয়ে। অলিম্পিককে সফল করে তুলতে নানা রকম প্রস্তুতি কয়েক বছর ধরেই চলছে। ফলে নতুন কোনো চমক জাপান সেখানে দেখাবে, সেই অপেক্ষায় এখন থাকা।