সর্বনাশা প্লাস্টিক থেকে বাঁচতে

পর্তুগালের এক সৈকতে প্লাস্টিকের স্তূপ। ছবি: রয়টার্স
পর্তুগালের এক সৈকতে প্লাস্টিকের স্তূপ। ছবি: রয়টার্স

ইন্দোনেশিয়ার সাগরে ২০১৮ সালের নভেম্বরে ভেসে থাকা মৃত তিমিটি বেশ আলোচনার জন্ম দেয়। সুলাওয়েসি প্রদেশের ওয়াকাতোবি ন্যাশনাল পার্কসংলগ্ন সাগরজলে ভেসে থাকা তিমিটির মৃত্যু কীভাবে হয়েছিল, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে মৃত তিমিটি যেন ছিল বিশ্বের জন্য এক সতর্কবার্তা। ৩১ ফুট দীর্ঘ ওই স্পার্ম তিমির পেট থেকে ১১৫টি প্লাস্টিকের কাপ, চারটি বোতল আর ২৫টি ব্যাগ বেরিয়েছিল। সব মিলিয়ে কেজি ছয়েক প্লাস্টিক খেয়েছিল তিমিটি।

জাতিসংঘ পরিবেশের (ইউএন এনভায়রনমেন্ট) তথ্য অনুসারে, বছরে ৮০ লাখ টনের বেশি প্লাস্টিক সমুদ্রে পড়ছে।

ব্যবহারে সুবিধা থাকায় বিশ্বব্যাপী সময়ে–সময়ে প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়েছে। বাজার থেকে এক কেজি আপেল বা সবজি কিনে পলিথিনের ব্যাগে ভরে বাড়ি ফিরলেন এবং সেগুলো বের করে ব্যাগটি ময়লার বালতিতে ফেলে দিলেন। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বাইরে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার সময় ব্যাগ ভরে প্লাস্টিকের প্লেট, গ্লাস, কাপ নিয়ে গেলেন। ওজনে হালকা হওয়ায় বহন করতে সুবিধা। আবার ব্যবহারের পর ধোয়ারও প্রয়োজন হলো না, নির্দিষ্ট স্থানে ফেলে দিয়ে চলে এলেন। এসব সুবিধা দিয়ে প্লাস্টিক আমাদের এমন ‘বন্ধনে’ বেঁধে ফেলছে যে এর ক্ষতিকারক দিক বা হুমকির বিষয়টি মাথা থেকে এক ঝটকায় আমরা ঝেড়ে ফেলি।

চীনের একটি নদীর পাশ থেকে প্লাস্টিকের বর্জ্য সরাচ্ছেন কর্মীরা। ছবি: রয়টার্স
চীনের একটি নদীর পাশ থেকে প্লাস্টিকের বর্জ্য সরাচ্ছেন কর্মীরা। ছবি: রয়টার্স

পরিবেশবিজ্ঞানীরা সতর্ক করছেন, প্লাস্টিকের দূষণ এক জায়গায় থেমে নেই। মাটি, পানি, বায়ু—সবখানেই প্লাস্টিকের দূষণ চলছে। অপচ্য প্লাস্টিকের আয়ু ৫০০ বছরের কম নয়। একপর্যায়ে প্লাস্টিক ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণায় পরিণত হয়। এই ক্ষুদ্র কণাকে বলা হয় মাইক্রোপ্লাস্টিক। এই মাইক্রোপ্লাস্টিক খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে মানুষের দেহে ঢুকে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

প্লাস্টিক ওশিন্স ইন্টারন্যাশনালের (পিওআই) তথ্য অনুসারে বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর ৩০ কোটি টন প্লাস্টিক উৎপাদন হয়। কোনো কোনো সংস্থার তথ্য, বছরে ৩৩ কোটি টন প্লাস্টিক উৎপাদন হয়। এর অর্ধেক একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয়। পরিবেশবাদীরা বারবারই হুঁশিয়ার করছেন, প্লাস্টিক উৎপাদনের লাগাম টেনে ধরতে না পারলে তা বিশ্বের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে। তবে আশার কথা, অনেকেই এ ব্যাপারে সচেতনতা তৈরিতে এগিয়ে আসছেন। একটি তরুণ অধিকারকর্মী প্রজন্মও গড়ে উঠেছে, যারা প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে সোচ্চার।

প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে সোচ্চার এসব মানুষের প্রচারাভিযানের কিছু সুফলও উঠে আসছে। দেশে দেশে সরকারগুলো স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে অনেক প্রতিষ্ঠানকে তাদের পণ্য উৎপাদন ও প্যাকেজ প্রক্রিয়া, সরবরাহ চেন এবং বিতরণ নেটওয়ার্ককে পুনরায় পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বাধ্য করছে। এ বছর বিশ্বের বিখ্যাত কিছু প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্য উৎপাদন, প্যাকেজিং থেকে প্লাস্টিককে একেবারে ছেঁটে ফেলার ঘোষণা দিয়েছে। তাদের আউটলেটগুলোও প্লাস্টিকমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে। অনেকে কার্যকর শুরু করেছে, অনেকে নতুন বছর ২০২০ থেকে এই ঘোষণা কার্যকর শুরু করবে। এখানে তুলে আনা হয়েছে তেমন কিছু প্রতিষ্ঠানের কথা।

পানিতে ভাসছে প্লাস্টিকের বোতল। ছবি: রয়টার্স
পানিতে ভাসছে প্লাস্টিকের বোতল। ছবি: রয়টার্স


ইকেয়া
পরিবেশবান্ধব প্যাকেজ প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দিচ্ছে পণ্য উৎপাদনকারী সুইডেনভিত্তিক আসবাবপত্রের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ইকেয়া। যদিও আমেরিকানরা এই ব্র্যান্ডটিকে ‘আইকিয়া’ বলে উচ্চারণ করেন। তারা মাশরুমভিত্তিক বারবার ব্যবহারযোগ্য প্যাকেটে পণ্য বিক্রি করছে। প্লাস্টিকের বিকল্প এই প্যাকেট প্লাস্টিকের মতোই যেকোনো আকৃতিতে ভাঁজ করা যায়। এই ‘মাইকো কম্পোজিট’ প্যাকেট শুকনা রাখা গেলে তা বারবার ব্যবহার করা যায়। ফেলে দিলে মাত্র ৩০ দিনের মধ্যে প্যাকেটগুলো পচে যায়। ২০২০ সালের শুরুতে বিশ্বজুড়ে প্রতিষ্ঠানটির ৩৬৩টি আউটলেট একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক প্লেট, কাপ, স্ট্র, গার্বেজ ব্যাগ, ফ্রিজার ব্যাগ ইত্যাদি ব্যবহার পরিহার করতে যাচ্ছে।

মেটাল
বারবি ডলসহ বহু জনপ্রিয় খেলনা নির্মাণ প্রতিষ্ঠান মেটাল প্লাস্টিকের বিকল্প ব্যবহারে এগিয়ে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি সম্প্রতি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তারা ২০৩০ সালের মধ্যে তাদের সব পণ্য উৎপাদন ও প্যাকেজে শতভাগ পুনরায় ব্যবহারযোগ্য জৈব প্লাস্টিক পদার্থ ব্যবহার করবে। ২০২০ সালের শুরু থেকেই প্রতিষ্ঠানটি তাদের ফিশার প্রাইস রক এ স্ট্যাক খেলনাটি আখ থেকে তৈরি প্লাস্টিকে প্যাকেজজাত করার নতুন লক্ষ্য নিয়ে বাজারে আসছে। এগুলোতে ব্যবহার হবে শতভাগ পূর্ণ প্রক্রিয়াযোগ্য প্লাস্টিক।

প্লাস্টিকের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। ছবি: প্রথম আলো
প্লাস্টিকের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। ছবি: প্রথম আলো


ওয়ালমার্ট
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ মার্কিন খুচরা পণ্য বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ওয়ালমার্ট এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ঘোষণা দেয়, তারা ২০২৫ সালের মধ্যে শতভাগ পূর্ণ প্রক্রিয়াজাতযোগ্য, বারবার ব্যবহারযোগ্য এবং পচনশীল প্যাকেট ব্যবহার করবে এবং অন্য প্রতিষ্ঠানকেও তা ব্যবহারে উৎসাহিত করবে।

হলিডে ইন এবং ক্রাউন প্লাজা হোটেল
বিশ্বের খ্যাতনামা চেন হোটেল হলিডে ইন এবং ক্রাউন প্লাজা পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলস গ্রুপ (আইএইচজি) ঘোষণা দিয়েছে, এখন থেকে বিশ্বজুড়ে এ দুটি হোটেলের সব শাখা মিলে ৮ লাখ ৪৩ হাজার অতিথি কক্ষের বাথরুমে প্লাস্টিকের বোতলে শ্যাম্পু বা অন্য সামগ্রী দেবে না। প্লাস্টিকের বোতল অপসারণে তারা ছোট ছোট প্লাস্টিকের বোতলের পরিবর্তে বাল্ক আকৃতির কনটেইনারে শ্যাম্পুসহ অন্যান্য প্রসাধনী সামগ্রী রাখবে। আইএইজচি জানিয়েছে, ১০০টিরও বেশি দেশে তাদের অধীনে পরিচালিত ৫ হাজার ৬০০ হোটেলে আগামী দুই বছরের মধ্যে ধাপে ধাপে প্লাস্টিক অপসারণে এ কাজ চলবে।

ভারতের হায়দরাবাদে ইকেয়ার একটি স্টোর। ছবি: এএফপি
ভারতের হায়দরাবাদে ইকেয়ার একটি স্টোর। ছবি: এএফপি


সেইন্সবারিস
যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত চেন সুপারমার্কেট সেইন্সবারিস অঙ্গীকার করেছে, নতুন বছর থেকে তাদের ব্যবহৃত আরও ১ হাজার ২৮৪ টন প্লাস্টিক ছেঁটে ফেলা হবে। প্লাস্টিক কাটলারি, ব্যাগ, লিড, ট্রে ব্যবহার বাদ দেওয়া হবে। খুচরা ফল, সবজি আর বেকারি পণ্য বিক্রিতে ব্যবহৃত ৪৮৯ টন প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার বন্ধের মাধ্যমে এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন শুরু করবে প্রতিষ্ঠানটি। এই সুপারমার্কেট থেকে ক্রেতারা খুচরা পণ্য কিনতে হয় নিজস্ব ব্যাগ ব্যবহার করবেন, নয়তো পূর্ণ প্রক্রিয়াজাতযোগ্য ব্যাগ সুপারমার্কেট থেকে কিনে নেবেন। ক্রেতাদের জন্য কাগজের তৈরি ব্যাগও থাকবে।

ক্রোগার
ক্রোগার নামের মার্কিন চেন সুপারমার্কেট ধাপে ধাপে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার বন্ধ করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। এই চেন সুপারমার্কেটের মোট ২ হাজার ৮০০ শাখা রয়েছে।

বিয়ার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হাইনেকেন, করোনা, কার্লসবার্গ এবং গিনেজ এ বছর ঘোষণা দিয়েছে তারা পণ্য প্যাকেজে প্লাস্টিক বর্জন করবে।

প্লাস্টিক বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে ওয়ালমার্টও। ছবি: এএফপি
প্লাস্টিক বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে ওয়ালমার্টও। ছবি: এএফপি

২০১৫ সালে জরিমানার বিধান করার পর যুক্তরাজ্যে প্লাস্টিক ব্যাগ বিক্রি ৯০ শতাংশ কমেছে। ২০১৪ সালে যুক্তরাজ্যে একজন গড়ে ১৪০টি প্লাস্টিকের ব্যাগ কিনতেন। এখন সেটি নেমে এসেছে মাত্র ১০টিতে। অস্ট্রেলিয়ায় কোলস এবং উলওয়ার্থস নামের দুটি সুপারমার্কেট এ বছরের আগস্টে তাদের ক্রেতাদের কাছে একবার ব্যবহারযোগ্য পলিথিনের ব্যাগ বিক্রি বন্ধের ঘোষণা দিলে তা দেশজুড়ে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। মাত্র তিন মাসে দেশটিতে প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার ৮০ শতাংশে নেমে এসেছে। সংখ্যার হিসাবে যা ১৫০ কোটি।

প্লাস্টিক নিয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশও। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা আর্থ ডে নেটওয়ার্কের প্রতিবেদন অনুসারে, বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় প্লাস্টিক দূষণকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ দশম।

পরিবেশবিজ্ঞানী অধ্যাপক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার প্রথম আলোকে জানিয়েছিলেন, দেশে ২০১৪ সালেই দিনে ২৭ হাজার টন প্লাস্টিক ব্যবহৃত হয়েছে। এই হার চললে ২০২৫ সালে তা ৫০ হাজার টনে পৌঁছাবে। তাঁর নেতৃত্বাধীন গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা পুকুর-ডোবা, নদী-নালা, খাল-বিলসহ জলাশয়ে পড়ছে। এই প্লাস্টিক মাছ খাচ্ছে। আমরা আমাদের অজান্তে মাছের মাধ্যমে প্লাস্টিক খাচ্ছি।

‘বিট প্লাস্টিক পলিউশন’ শিরোনামের এক সেমিনারে দেশে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার নাজুক অবস্থার কথা তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, দেশে দিনে ১ হাজার ৭০০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে। ঢাকায় তা ৩৮১ দশমিক ৩৬ টন।

সূত্র: গার্ডিয়ান, গুড নিউজ নেটওয়ার্ক, আর্থ টক