ইরানের 'প্রতিশোধের' হুমকির মধ্যে মার্কিন দূতাবাসের কাছে হামলা

ছবি: এএফপি
ছবি: এএফপি

ইরাকে মার্কিন হামলায় জেনারেল কাশেম সোলাইমানির নিহত হওয়ার পর ‘চরম প্রতিশোধের’ হুমকি দিয়েছিল ইরান। এ নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে উত্তেজনার মধ্যে গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় বাগদাদের অতি সুরক্ষিত গ্রিন জোন এবং ইরাকের একটি বিমানঘাঁটিতে রকেট ও মর্টার হামলা হয়েছে। তবে এতে হতাহতের বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু জানা যায়নি।

বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, গ্রিন জোনে দুটি মর্টার ও বাগদাদের উত্তরের আল–বালাদ বিমানঘাঁটিতে দুটি রকেট আঘাত হেনেছে। ওই গ্রিন জোনের মধ্যেই আছে মার্কিন দূতাবাস। মর্টার দুটি পড়েছে এর কাছে। আর আল–বালাদ বিমানঘাঁটিতে থাকে মার্কিন সেনারা। সাম্প্রতিক সময়ে বাগদাদে মার্কিন দূতাবাস এবং মার্কিন সেনাদের লক্ষ্য করে এমন মর্টার–রকেট হামলা হয়েছে অনেকবার। এসবের সঙ্গে ইরান এবং ইরাকে তাদের শিয়া সহযোগীরা জড়িত বলে মনে করে ওয়াশিংটন।

নিহত ইরানি জেনারেল কাশেম সোলাইমানির (৬২) জানাজা গতকাল অনুষ্ঠিত হয়েছে বাগদাদে। মরদেহ গতকালই দেশে নেওয়ার কথা ছিল, দাফন হবে মঙ্গলবার। তাঁর মৃত্যুতে শোক করছে, বিক্ষোভ করছে ইরানিরা। সঙ্গে আছে ইরাকিদের একটি বড় অংশ। বাইরের বিশ্বও নজর রাখছে ইরানি কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপের দিকে—সোলাইমানি হত্যার ‘সমুচিত প্রতিশোধ’ তারা কী নেয় এবং কখন কীভাবে নেয়। বিশেষজ্ঞরা নিজেদের মতো হিসাব–নিকাশ করে মতামত দিচ্ছেন, প্রতিশোধের কোন পথ–পন্থা ইরানের জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক। এমনও তো হতে পারে, তিনি মারা পড়লে কী করতে হবে—সব পথ বাতলে গেছেন সোলাইমানি নিজেই।

তবে বিশেষজ্ঞদের হিসাব–নিকাশ যেমনই হোক, ইরান যে প্রতিশোধ নেবে, তা হয়তো আগে থেকেই আঁচ করতে পেরেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন। বার্তা সংস্থা এএফপি গতকাল জানায়, ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের উপপ্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল আলি ফাদাভি গত শুক্রবার স্থানীয় সময় রাতে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দাবি করেছেন, ওই দিন ভোরে সোলাইমানিকে হত্যার পর সকালে মার্কিন কর্তৃপক্ষ কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়েছে। তিনি বলেন, ‘তারা বলেছে, “তোমরা যদি প্রতিশোধ নিতেই চাও, তাহলে আমরা যতটা করেছি, তার সমানুপাতিক কিছু কোরো।’ যুক্তরাষ্ট্র কোন মাধ্যমে ইরানি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল, তা অবশ্য বলেননি আলি ফাদাভি।

তবে যোগাযোগমাধ্যমের একটি ইঙ্গিত সম্ভবত আছে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফের কথায়। শুক্রবার রাতে পৃথক এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আজ (শুক্রবার) সকালে ইরানে সুইজারল্যান্ডের দূত যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ফালতু একটি বার্তা নিয়ে এসেছিলেন।’ তিনি বলেন, সন্ধ্যায় ওই রাষ্ট্রদূতকে তলব করে লিখিতভাবে কড়া জবাব দেওয়া হয়েছে।

সুইজারল্যান্ডের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও গতকাল শনিবার নিশ্চিত করেছে, ইরানে তাদের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স মার্কিন কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে শুক্রবার সকালে একটি চিঠি ইরানি কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেয়।

ইরানের ক্ষমতাধর রেভল্যুশনারি গার্ডের শাখা কুদস ফোর্সের প্রধান ছিলেন মেজর জেনারেল কাশেম সোলাইমানি। গত শুক্রবার ভোরে ইরাকের রাজধানী বাগদাদের বিমানবন্দরের কাছে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় তাঁকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র। একই সঙ্গে নিহত হন ইরাকের শিয়া মিলিশিয়া গ্রুপের নেতাসহ আরও নয়জন।

সোলাইমানিকে হত্যার পর যুক্তরাষ্ট্র যে বেশ বেকায়দায় রয়েছে, তা অনেকখানিই বোঝা গেছে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর মন্তব্যে। শুক্রবার তিনি বলেছেন, সোলাইমানিকে হত্যার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপীয় মিত্ররা যতটা সহায়ক হবে বলে তাঁরা ভেবেছিলেন, তা তারা হয়নি। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানিসহ ইউরোপীয় সব মিত্রকে বুঝতে হবে, আমরা কী করেছি। আমরা হাজারো প্রাণ বাঁচিয়েছি।’

সোলাইমানি নিহত হওয়ার ঘটনা যে মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা উসকে দেবে, তারও ইঙ্গিত পাওয়া গেছে বাগদাদে তাঁর গতকালের জানাজায়। হাজারো মানুষ এতে অংশ নেয়। তারা এ সময় মার্কিনবিরোধী স্লোগান দেয়। ঠিক এদিন থেকেই ইরাকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনী তাদের কর্মকাণ্ড সীমিত রাখার ঘোষণা দিয়েছে।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র এএফপিকে বলেছে, ‘আমাদের প্রধান অগ্রাধিকার হলো যৌথ বাহিনীর সদস্যদের সুরক্ষা দেওয়া। এ কারণেই ইরাকি বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কার্যক্রম আপাতত সীমিত রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’ পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোও গতকাল ঘোষণা দিয়েছে, ইরাকে তারা প্রশিক্ষণ কার্যক্রম স্থগিত করেছে। এ ছাড়া ইরান ও ইরাক সফর না করতে নিজেদের নাগরিকদের সতর্ক করেছে যুক্তরাজ্যের সরকার।

বিবিসি জানায়, ইরানের প্রতিশোধের হুমকিকে গুরুত্বের সঙ্গেই নিতে হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ, নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও তেহরান আধুনিক সমরাস্ত্র তৈরি করেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা এ–ও মনে করছেন, ইরান সম্মুখ সমরে গেলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠবে। এতে ইরানেরই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। তেলসমৃদ্ধ দেশটির বেশির ভাগ তেল শোধনাগারই উপকূলবর্তী এলাকায়। উপসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের যে সামরিক উপস্থিতি রয়েছে, তার জন্য এসব শোধনাগার সহজ লক্ষ্যবস্তু।

তবে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ডিফেন্স প্রায়োরিটিজের নীতিবিষয়ক পরিচালক বেন ফ্রাইডম্যান সিএনএনকে বলেন, ইরান যদি প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নিয়েই বসে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রকে বিপদে পড়তে হবে। কারণ, মধ্যপ্রাচ্যে যে সংখ্যক মার্কিন সেনা উপস্থিতি রয়েছে, তা ইরানের আক্রমণ মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট নয়।

বিবিসি জানায়, ইরান হয়তো প্রতিশোধ নিতে সোলাইমানির কৌশলই অবলম্বন করবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্মুখ সমরে না গিয়ে অস্ত্র, প্রশিক্ষণসহ নানা সহযোগিতার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে শিয়াপন্থী সশস্ত্র সংগঠনগুলোকে সুসংগঠিত করেছেন। ইরান হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এই সংগঠনগুলোকেই ব্যবহার করবে।

এ ছাড়া ইরাকের মাটিতে সোলাইমানিকে হত্যার প্রতিক্রিয়ায় আরেকটি ঘটনাও ঘটতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এত দিন কেবল ইরাকের শিয়াপন্থী স্থানীয় যোদ্ধারাই ইরানের, বিশেষ করে সোলাইমানির অনুসারী ছিল। এবার হয়তো ইরাকের রাজনীতিকেরাও নিজেদের টিকে থাকার স্বার্থে ইরানের দিকে ভিড়বেন। হামলার পরপরই ইরাকের প্রধানমন্ত্রী আদেল আবদেল মাহদি এবং দেশটির শিয়া সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক গুরু আয়াতুল্লাহ আলি আল–সিস্তানি নিন্দা জানিয়েছেন, দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘিত হয়েছে বলে মন্তব্য করেন। গতকাল বাগদাদে সোলাইমানির জানাজায়ও অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী মাহদি। এ ছাড়া বাগদাদের তাহরির স্কয়ারে গতকাল দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্নে একজোট হয়ে সংগ্রাম করার ঘোষণা দিয়েছে ইরানপন্থী ও ইরানবিরোধী বিক্ষোভকারীরা। ইরাকের মাটি থেকে মার্কিন সেনাদের তাড়ানোর দাবি করছেন ইরাকি আইনপ্রণেতারা। এ নিয়ে আজ রোববার ইরাকের পার্লামেন্টে বিশেষ অধিবেশন বসবে। সোলাইমানিকে হত্যার প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্রের ৭০টির বেশি শহরে গতকাল বিক্ষোভ হয়েছে।

সিঙ্গাপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডল ইস্ট সেন্টারের বিশেষজ্ঞ ফানার হাদ্দাদ এএফপিকে বলেন, কেউ কেউ হয়তো মনে করছেন, সোলাইমানি নিহত হওয়ায় ইরাকে ইরানের পাখা ভেঙে গেছে। কিন্তু উল্টোটা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ইরাকি রাজনীতিকেরা এখন ইরানের সঙ্গে আরও বেশি ঘনিষ্ঠ হবেন।

সোলাইমানিকে হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ইরানি কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ বাড়ছে। গতকালও দেশজুড়ে বিক্ষোভ থেকে প্রতিশোধের দাবি ওঠে। সিএনএন জানায়, গতকাল সোলাইমানির পরিবারের সদস্যদের সহমর্মিতা জানাতে তাঁর বাসভবনে যান ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি। এ সময় সোলাইমানির মেয়ে তাঁর বাবার হত্যার প্রতিশোধ দাবি করেন। জবাবে রুহানি বলেন, ‘এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেবে সবাই।’

বিবিসির মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সম্পাদক জেরেমি বোয়েন লিখেছেন, জেনারেল সোলাইমানি ছিলেন ইরানের কৌশলগত পরিকল্পনার অন্যতম মাথা। তিনি হত্যার শিকার হলে প্রতিশোধ কীভাবে নিতে হবে, সেই পরিকল্পনা হয়তো তিনি নিজেই করে গেছেন।