ইরাকের কী হবে?

মার্কিন সেনারা থাকেন—ইরাকের এমন দুটি সেনাঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। ছবি: এএফপি
মার্কিন সেনারা থাকেন—ইরাকের এমন দুটি সেনাঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। ছবি: এএফপি

ইরাকের মাটিতে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালানোর পর থামার ঘোষণা দিয়েছে ইরান। ওয়াশিংটনও সাময়িকভাবে নিজেদের গুটিয়ে এনেছে। তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, আপাতত উভয় পক্ষ গুটিয়ে থাকলেও ইরাকের সমস্যা এখনই সমাধান হচ্ছে না।

ওয়াশিংটনভিত্তিক মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তা রান্ডা স্লিম বলেন, ইরাক সংঘর্ষের এলাকা হিসেবে থেকেই যাবে।

ইরানের শীর্ষ জেনারেলকে বিমান হামলায় হত্যার প্রতিবাদে গতকাল বুধবার ইরান মার্কিন সেনাঘাঁটি লক্ষ্য করে ২২টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে।

হামলার কিছুক্ষণ আগেই ইরাককে সতর্ক করে দিয়েছিল ইরান। হামলার পর ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ বলেন, যুদ্ধ বা উত্তেজনা আর বাড়াতে চাইছে না ইরান। ইরাকে দুটি মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা করে কাশেম সোলাইমানি হত্যার পাল্টা জবাব দেওয়া হয়ে গেছে।

মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কয়েক ঘণ্টা পর এক টুইটে জাভেদ জারিফ লেখেন, ‘আমাদের জনগণ ও জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের ওপর যে ঘাঁটি থেকে কাপুরুষোচিত সশস্ত্র হামলা করা হয়েছে, জাতিসংঘ সনদের ৫১ অনুচ্ছেদ অনুসারে আত্মরক্ষায় ইরান সেখানে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে এর (ঘটনার) সমাপ্তি টেনেছে। আমরা যুদ্ধ বা উত্তেজনা বাড়াতে চাই না, তবে যেকোনো আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিজেকে রক্ষা করব।’

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ হামলার প্রতিক্রিয়ায় স্থানীয় সময় বুধবার সকালে হোয়াইট হাউস থেকে টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে বলেন, ইরাকে মার্কিন ঘাঁটিতে হামলার পর ইরান গুটিয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। দেশটির ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুঁশিয়ারিও দেন তিনি।

ট্রাম্প তাঁর ভাষণে বলেন, ইরান সম্ভবত গুটিয়ে গেছে। অবশ্য এটা সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের জন্য ভালো এবং এটি বিশ্বের জন্য খুব ভালো কিছু। ট্রাম্প দাবি করেন, ২০১৩ সালে অকার্যকর পারমাণবিক চুক্তি সইয়ের পর ইরানের যুদ্ধবিগ্রহ মনোভাব বেড়েছিল।

যুদ্ধ বা উত্তেজনা কমাতে দুই পক্ষের ইচ্ছার বিষয়ে এতে ইঙ্গিত মিললেও বিশ্লেষকেদের চোখে এটি ইরাককে বাঁচানোর পক্ষে যথেষ্ট হবে না।

এরই মধ্যে ইরাকের রাজধানী বাগদাদের সংরক্ষিত গ্রিন জোনে দুটি রকেট হামলা হয়েছে। স্থানীয় সময় বুধবার গভীর রাতে কঠোর নিরাপত্তায় সুরক্ষিত এই গ্রিন জোনে রকেট হামলা চালানো হয়। বাগদাদের কেন্দ্রে অবস্থিত গ্রিন জোনে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, পার্লামেন্ট এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও বেশ কয়েকটি প্রভাবশালী দেশের দূতাবাস রয়েছে।

বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, বুধবার মধ্যরাতে বিকট শব্দে দুটি রকেট হামলা চালানো হয়। ইরাকে দুটি মার্কিন বিমানঘাঁটিতে ইরানের হামলা চালানোর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই বাগদাদে এই রকেট হামলা হলো।


ইরাকের সামরিক সূত্রের বরাত দিয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুটি কাতিউশা রকেট দিয়ে গ্রিন জোনের ভেতরে হামলা চালানো হয়েছে। এতে হতাহতের ঘটনা ঘটেনি বলে জানিয়েছে ইরাকের সামরিক বাহিনী।

নিউ আমেরিকা ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা এরিকা গ্যাস্টন বলেছেন, উভয় পক্ষই ইরাকে এতটা সংগঠিত হয়েছে, যা পরস্পরকে আঘাত হানার জন্য প্রতীকী অঞ্চল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মার্কিন সেনা ও বাগদাদের দূতাবাসে সম্প্রতি কয়েক ডজন রকেট হামলা চালানো হয়। এতে একজন ইরাকি সেনা ও মার্কিন কন্ট্রাক্টর নিহত হন। এ হামলার দায় কেউ স্বীকার করেনি। তবে যুক্তরাষ্ট্র তেহরানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হাশেদ আল-শাবির মিলিশিয়া নেটওয়ার্ককে দায়ী করে।

বাগদাদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বাইরে গত শুক্রবার মার্কিন বিমান হামলায় কাশেম সোলাইমানির সঙ্গে ইরাকি আধা সামরিক হাশেদ আল-শাবি বাহিনীর প্রধান আবু মাহদি আল মুহান্দিসও নিহত হন।

গ্যাস্টন বলেন, ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের হামলা ও পাল্টা হামলার মধ্যে হাশেদ চুপচাপ বসে থাকবে না। বর্শার ঠিক অগ্রভাগেই রয়েছে হাশেদ। এখানে ঠিক নিখুঁত কমান্ড ও কন্ট্রোল নেই। তারা মার্কিন বাহিনীর ওপর প্রতিশোধ নিতে চাইবে।

ইরানের আক্রমণে উদ্বুদ্ধ হয়ে হাশেদ গত বুধবার বলেছে, মুহান্দিস হত্যার প্রতিশোধ নিতে তারা নিজস্ব পদক্ষেপ নেবে। হাশদের শীর্ষ সদস্য কায়েস আল-খাজালি বলেছেন, এটা তাঁদের অঙ্গীকার।

এর কয়েক ঘণ্টা পরই ইরাকের রাজধানী বাগদাদের সংরক্ষিত গ্রিন জোনে দুটি রকেট হামলা হয়েছে।

ইরাক থেকে মার্কিন সেনা হটাতে ‘প্রতিরোধ জোটের অধীনে একত্র হচ্ছিল হাশদের একটি অংশ।

বিশ্লেষক স্লিম বলেন, এখন হাশদের সঙ্গে আলোচনাকারী না থাকায় রক্তপাত আরও বাড়ার দুশ্চিন্তা তৈরি হবে। লেবাননে ইরানের মিত্র হিজবুল্লাহ প্রায়ই ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। তবে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে আনার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু ইরাকের মাটিতে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কে ভূমিকা রাখবে?

ইরাক ঘিরে তেহরান ও ওয়াশিংটনের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই উত্তেজনা চলছে। এ অবস্থায় ইরাক সরকার ভারসাম্য রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইরাকের রাজনীতি ও সামরিক খাতে দুটি দেশেরই ভূমিকা রয়েছে।

গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের সংঘর্ষের পর ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে। ইরাকের রাজনৈতিক সমস্যা আরও বেড়েছে।

লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের অধ্যাপক টোবি ডজ বলেন, ‘এখন ভারসাম্য পুরোপুরি অসম্ভব। বাগদাদ ইরানের ক্যাম্প হয়ে উঠবে। ওয়াশিংটনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখা ইরাকের প্রেসিডেন্ট বাহরাম সালেহ তাঁর প্রভাব কমা দেখতে শুরু করবেন।

টোবি বলেন, আগের রাতে যদি ইরানের পাল্টা হামলা দেখে থাকেন, তবে ইরানপন্থী দলগুলোর রাজনৈতিক একীকরণ এবং আধিপত্যবাদ আজ দেখতে পাবেন।

হাশদের রাজনৈতিক শাখা ফাতাহ ব্লক ইরাক থেকে বিদেশি সেনা তাড়াতে মার্কিনবিরোধী মনোভাবকে নিজের পক্ষে টেনে নিয়েছে।

ইরাকে ৫ হাজার ২০০ মার্কিন সেনা ছাড়াও যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, কানাডাসহ কয়েকটি দেশের সৈন্য রয়েছে।

গত সপ্তাহে মার্কিন বিমান হামলায় ইরাকি জনগণের আক্রোশের চেয়ে ইরানের হামলায় তাদের প্রতিক্রিয়া ততটা জোরালো নয়।

ইরাক বিশেষজ্ঞ রামজি মার্দিনি বলেন, মার্কিনদের সরাসরি নিন্দা করেছে বাগদাদ কিন্তু ইরানের ক্ষেত্রে তা ঘটেনি।

এখন কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আমেরিকার সঙ্গে ইরাকের সম্পর্ক বাঁচাতে এবং কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করার নেপথ্যে ব্যস্ত থাকতে পারেন, যদিও তা এখন নাজুক। তবে মার্দিনি সতর্ক করে বলেন, যদি সংকট আরও বাড়ে, বাগদাদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের জায়গা কমে যাবে। তারা যেকোনো একটি পক্ষকে বেছে নিতে বাধ্য হবে। পক্ষটি মার্কিন হবে না। তথ্যসূত্র: রয়টার্স, এএফপি, বিবিসি ও সিএনএন।