ইরানের বিষয়ে ট্রাম্প কার কথায় চলছেন?

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও। ছবি: রয়টার্স
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও। ছবি: রয়টার্স

ইরানের বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চালান কে? কার কথায় তিনি চলছেন? এ প্রশ্ন এখন অনেকের মনেই ঘুরপাক খাচ্ছে। খনি হাতড়ে আকরিক খুঁজে পাওয়ার মতো যে উত্তর পাওয়া গেছে, সেখানে রয়েছে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর নাম।

হোয়াইট হাউসের অভ্যন্তরীণ ও ট্রাম্প প্রশাসনের কয়েকটি সূত্র বার্তা সংস্থা সিএনএনকে বলছে, ইরাকের রাজধানী বাগদাদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যুক্তরাষ্ট্রের রকেট হামলায় ইরানি জেনারেল কাশেম সোলাইমানিকে হত্যায় প্রভাবিত করেছিলেন পম্পেও।

এ ঘটনার মধ্য দিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনে সবচেয়ে প্রভাবশালী জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে নিজেকে জাহির করলেন তিনি।

পম্পেও অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী কর্মকর্তা হিসেবে অনেক আগে থেকেই চিহ্নিত হয়ে আছেন। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদে পম্পেওর আগ্রহ দেখে ট্রাম্পই তাঁকে এ পদের জন্য বেছে নেন।

ওয়াশিংটন এক্সামিনারের তথ্য অনুযায়ী, কোনো বিষয়ে নিজ মন্ত্রিসভার বা প্রশাসনের কেউ প্রকাশ্যে ট্রাম্পের সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করলে তা একদমই তাঁর অপছন্দ। বিষয়টি খুব ভালোভাবে জানেন পম্পেও। বেশির ভাগ প্রশ্নে ট্রাম্প ও পম্পেও অভিন্ন মত পোষণ করে আসছেন। তিনি ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ আস্থাভাজন ও ‘পরীক্ষিত’ জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার ভূমিকা নিয়েছেন।

কয়েকটি সূত্র সিএনএনকে বলেছে, পম্পেওর পথের কাঁটা হয়ে ছিলেন জেনারেল কাশেম সোলাইমানি। তাঁকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরাতে পারলে পম্পেওর মুশকিল আসান। তাই গত এক দশক থেকেই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সোলাইমানিকে সরানোর ছক আঁকছিলেন শীর্ষ মার্কিন এ কূটনীতিক।

অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে, ইরানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনাটি ট্রাম্পের সামনে আনেন পম্পেও নিজে। তিনিই এর হোতা।

পম্পেওর ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্র বলছে, নিজের ক্যারিয়ারজুড়েই পম্পেও মনে করে আসছেন মধ্যপ্রাচ্যে সমস্যার মূল কারণ ইরান ও সোলাইমানি। ওই অঞ্চলে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য সোলাইমানির বিরুদ্ধে ছায়া কমান্ডার হিসেবে কাজ করার অভিযোগও তোলেন তিনি।

৫ জানুয়ারি পম্পেও টুইটে বলেন, ‘আমরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে খারাপ মানুষটিকে সরিয়ে দিয়েছি। আমরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ ওই দিনই এবিসি নিউজকে পম্পেও বলেন, ‘সোলাইমানিকে হত্যা করাটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ এই ব্যক্তিটি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আঠার মতো লেগে ছিল। মার্কিনদের জীবনে ঝুঁকি তৈরি করছিল।’

পম্পেও আরও বলেন, ‘এটা ব্যক্তিগত কোনো বিষয় নয়। তিনি সন্ত্রাসী ও মাস্টারমাইন্ড ছিলেন।’

অবশ্য পম্পেও যতই ব্যক্তিগত শত্রুতা না থাকার কথা বলুন না কেন, তিনি আসলে সোলাইমানির ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। ২০১৬ সালে তিনি ইরানের ভিসা নিয়ে সোলাইমানির সঙ্গে দেখা করার কথাও ভেবেছিলেন। তবে তিনি ভিসা পাননি। পম্পেও মনে করেন, শত শত মার্কিনি সেনার রক্ত ছিল সোলাইমানির হাতে।

মার্কিন কর্মকর্তারা মনে করেন, ইরাকযুদ্ধের সময় সোলাইমানির ইউনিট মার্কিন সেনাদের বিরুদ্ধে বোমা হামলা চালিয়েছিল। ইরানের পক্ষ থেকে এসব দাবি অস্বীকার করা হলেও পেন্টাগন মনে করে, শত শত মার্কিনকে হত্যার পেছনে সোলাইমানির হাত ছিল।

আইআরজিসি নামে পরিচিত ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের একজন কমান্ডার ছিলেন সোলাইমানি। তবে অলিখিতভাবে তাঁর পদমর্যাদা দেশটির যেকোনো সামরিক কর্মকর্তার ওপরে। রেভল্যুশনারি গার্ডের ‘কুদস ফোর্স’ তাঁর নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হতো। ২১-২২ বছর হলো বাহিনীটি গড়ে তুলছিলেন তিনি। অপ্রচলিত যুদ্ধের জন্য তৈরি একটা বৃহৎ ‘স্পেশাল অপারেশান ইউনিট’ বলা যায় একে; যার প্রধান কর্মক্ষেত্র এখন ইরানের বাইরে। দেশটির বৈশ্বিক উত্থানে বর্শার ফলকে পরিণত হয়েছেন কুদস ফোর্সের সদস্যরা, যাঁদের ব্যবহার করে মধ্যপ্রাচ্যে ইতিমধ্যে সামরিক ভারসাম্যে পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলেছিলেন হাজি কাশেম নামে পরিচিত সোলাইমানি।

এই সোলাইমানিকে নিয়ে পম্পেও এতটাই দুশ্চিন্তায় ছিলেন যে সম্প্রতি বন্ধুমহলে ঘোষণা দিয়েছিলেন, সোলাইমানিকে না সরানো পর্যন্ত অবসরে যাবেন না।

সোলাইমানিকে হত্যার পর এখন ট্রাম্প প্রশাসনে তাঁর আধিপত্য বাড়ানোর কাজে বেশি মনোযোগী হয়েছেন বলেই মনে করা হচ্ছে। তিনি এ কাজে এতটাই মনোযোগী যে, এবার কানসাস থেকে সিনেটর হওয়ার লড়াইয়ে নামতেও চাচ্ছেন না।

পম্পেওর ঘনিষ্ঠজনেরা বলছেন, ট্রাম্প প্রশাসনকে পথ দেখাচ্ছেন পম্পেও। বিশেষ করে ইরানের ঘটনায় প্রেসিডেন্টের নীতিমালায় পম্পেও ভূমিকা রাখছেন বেশি। প্রেসিডেন্টের নীতিমালার পক্ষে সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠ তাঁর।

সাবেক রিপাবলিকান জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেছেন, পম্পেও এতটাই প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন যে, তিনিই এখন স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান।

পম্পেওর এ উত্থানের বিষয়টি রিপাবলিকান জাতীয় নিরাপত্তা বলয়ে উদ্বেগ তৈরি করেছে। সমালোচকেরা বলছেন, ইরানের ঘটনার পর গত নয় বছরের মধ্যে সবচেয়ে বাজে ব্রিফিং দিয়েছেন পম্পেও ও মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এসপার।

এ ঘটনায় মার্কিন আইনপ্রণেতারা সুস্পষ্টভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক পার্টির আইনপ্রণেতারা নিজ নিজ দলীয় অবস্থান থেকে এ হত্যাকাণ্ডের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। মার্কিন বাহিনীর এমন অভিযান নিয়ে স্পষ্ট ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসিও। এ সম্পর্কিত এক বিবৃতিতে পেলোসি বলেন, ‘মার্কিন কংগ্রেসের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই পদক্ষেপটি নেওয়া হয়েছে। নিজেদের জনগণ ও জাতীয় স্বার্থই মার্কিন নেতাদের সবচেয়ে অগ্রাধিকারের বিষয়। আমাদের সেনা, কূটনীতিকসহ অন্যদের জীবন ঝুঁকিতে পড়তে পারে—এমন কোনো উসকানিমূলক ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ পদক্ষেপ আমরা নিতে পারি না। আজকের হামলা ভয়াবহ সংঘাতের উসকানি হিসেবে কাজ করার ঝুঁকি রয়েছে।’