ব্রিটিশ রাজপরিবারে তোলপাড়

ছেলে আর্চি জন্মের পরপর প্রিন্স হ্যারি ও মেগান। ছবি: এএফপি
ছেলে আর্চি জন্মের পরপর প্রিন্স হ্যারি ও মেগান। ছবি: এএফপি

রানির অবাধ্য হয়ে রাজকুমার হ্যারি ব্রিটিশ রাজপরিবারে যে সংকট তৈরি করেছেন, তা কার্যত দুই মহাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। মা রাজকুমারী ডায়ানা ব্রিটিশ রাজপরিবারে যে ধরনের টানাপোড়েনের জন্ম দিয়েছিলেন, তাঁর পুত্র সম্ভবত তার চেয়েও বড় সংকটের জন্ম দিয়েছেন। বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন রাজপরিবার আধুনিক ব্রিটেনের বহুজাতিক সংস্কৃতির রূপান্তরের সঙ্গে কতটা তাল মেলাতে পারছে, এটি হচ্ছে সেই পরীক্ষারই একটি স্মারক। নবতিপর রানি এলিজাবেথ তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঝামেলা মিটিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছেন। রানি রাজপ্রাসাদের কর্মকর্তা, যুবরাজ চার্লস, রাজকুমার উইলিয়াম ও হ্যারির ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের আগামী সপ্তাহের মধ্যেই একটা বোঝাপড়ায় পৌঁছানোর নির্দেশ দিয়েছেন।

ব্রিটিশ সিংহাসনে উত্তরাধিকারের ধারায় হ্যারি আছেন ষষ্ঠ অবস্থানে। হ্যারি এবং তাঁর স্ত্রী মেগান, যাঁরা রাজকীয় উপাধি ডিউক এবং ডাচেস অব সাসেক্স নামে পরিচিত, বুধবার রাতে তাঁদের রাজকীয় দায়িত্ব কমিয়ে আনার ঘোষণা যতটা আকস্মিক বলে সংবাদমাধ্যমে প্রচার পেয়েছিল, বিষয়টা ততটা চকিত ছিল না। রাজপরিবার থেকে পদত্যাগের সুযোগ থাকলে তাঁরা হয়তো আগেই তা করতেন। এখন জানা যাচ্ছে, বেশ কিছুদিন ধরেই তাঁরা বিষয়টি নিয়ে যুবরাজ চার্লসের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং আলোচনার জন্য রানির সাক্ষাৎ চেয়েছিলেন। কিন্তু বড়দিনের আগে সেই সাক্ষাৎ না পেয়ে তাঁরা অবকাশ কাটাতে কানাডা চলে যান এবং সেখানে বসেই তাঁদের সিদ্ধান্ত জনসমক্ষে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন।

হ্যারির এই সিদ্ধান্তের পেছনে কারণ কী, তা নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা আছে। এমন কথাও চালু আছে যে বড় ভাই রাজকুমার উইলিয়ামের সঙ্গে সম্প্রতি তাঁর দূরত্ব তৈরি হয়েছে। হ্যারি এবং মেগান আলাদা দাতব্য প্রতিষ্ঠান চালুর উদ্যোগ নেওয়াতেই এই বিরোধের ধারণা কিছুটা বিশ্বাসযোগ্যতা পায়। উইলিয়ামের দাতব্য সংস্থা যুক্তরাজ্যে বিভিন্ন কল্যাণমূলক কাজে অংশ নিয়ে থাকে। হ্যারি যেটি প্রতিষ্ঠা করছেন সেটি কাজ করবে আন্তর্জাতিক পরিসরে, বিশেষ করে আফ্রিকায়, যেমনটি তাঁর মা করতেন।

তবে অনেকের বিশ্বাস, হ্যারির প্রতি যুক্তরাজ্যের ট্যাবলয়েড পত্রিকাগুলোর অব্যাহত হয়রানিমূলক আচরণ তাঁর এই সিদ্ধান্তের কারণ। মেগানের গায়ের রং এবং পরিচিতি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমের একটি বড় অংশের কাছে পছন্দনীয় নয়। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে ডেইলি মেইলসানডে মেইল। এসব পত্রিকার কলামে প্রকাশিত নিবন্ধে সুপ্ত বর্ণবাদিতার ছাপ রয়েছে বলে অভিযোগ। কিছুদিন আগে রাজকুমার হ্যারি ডেইলি মেইল এবং সানডে মেইল–এর বিরুদ্ধে আদালতে মামলাও করেছেন।

আদালতে যা–ই হোক না কেন, চটুল এসব পত্রিকার সঙ্গে বিরোধে হ্যারি যে লাভবান হবেন না, তার আলামত গতকালের ডেইলি মেইল। মেগান হ্যারির সঙ্গে লন্ডনে ফিরে বিবৃতিটি প্রকাশের পরদিনই কানাডায় ছেলে আর্চির কাছে ফিরে যাওয়ার পর শুক্রবার মেইল প্রধান শিরোনামে লিখেছে, কানাডায় পালালেন মেগান। ডেইলি মেইল এবং সান পত্রিকা দুটিতে গতকাল ৯টি ও ১৬টি পাতাজুড়ে শুধু এই একটি প্রসঙ্গ। মূলধারার কাগজগুলোও পিছিয়ে নেই। দুদিন ধরেই প্রথম পাতার একটা বড় অংশজুড়ে আছে হ্যারি-মেগান জুটির খবর।

হ্যারি-মেগান জুটি অবশ্য প্রথাগত সংবাদমাধ্যমকে পাশ কাটিয়ে আধুনিক কালের মাধ্যম সোশ্যাল মিডিয়ায় ভর করে নিজেদের ভাবমূর্তি গড়ার পক্ষপাতী। ইনস্টাগ্রামে মেগানের অনুসারীর সংখ্যা এখনই কোটির ওপরে। এটি তাই গণমাধ্যমের প্রথাগত ধারার পাশাপাশি নতুন মাধ্যমেরও লড়াই।

হ্যারি-মেগান দম্পতি যে রাজকীয় দায়িত্ব কমিয়ে একটা নতুন জীবনধারা শুরুর কথা বলেছেন, প্রশ্ন উঠেছে সেটা কীভাবে সম্ভব? রাজপরিবারের সদস্য হয়ে রাজকীয় নিরাপত্তাসহ অন্যান্য সুবিধা ভোগ করলে তাঁর ও তাঁর পরিবারের জন্য নাগরিকদের করের টাকা কেন ব্যয় করা হবে? আবার, তাঁরা যদি সাধারণ নাগরিকের মতো কোনো বাণিজ্যিক উদ্যোগ গ্রহণ করেন, তাহলে রাজপরিবারের সম্মান ও মর্যাদাকে বাণিজ্যিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহারের অভিযোগ উঠবে। এ বিষয়ে রাজপরিবারের অভিজ্ঞতা একটুও সুখকর নয়। রাজকুমার এন্ড্রুর স্ত্রী কাউন্টেস অব ওয়েসেক্সের বেলায় এমনটি ঘটেছে। হ্যারির বিয়ের আগে তাই মেগানের ফ্যাশন–সম্পর্কিত নিজস্ব ব্লগও বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। তবে গত মার্চে এই দম্পতি নতুন একটি ওয়েবসাইট ট্রেডমার্ক রেজিস্ট্রেশন করানোয় জল্পনা আছে যে তাঁরা কোনো একটি বাণিজ্যিক উদ্যোগের পরিকল্পনা করছেন।

বিবিসির রাজপরিবারবিষয়ক সংবাদদাতা জানিয়েছেন, বর্তমানে হ্যারি-মেগান দম্পতির খরচের ৯৫ শতাংশই আসে তাঁর বাবা যুবরাজ চার্লসের ভূসম্পত্তির আয় থেকে। মাত্র ৫ শতাংশ ছিল রাষ্ট্রীয় তহবিলের বরাদ্দ। রাজকুমার উইলিয়াম এবং হ্যারি তাঁর মায়ের রেখে যাওয়া ১ কোটি ৩০ লাখ পাউন্ডের উত্তরাধিকারী। এ ছাড়া তাঁরা তাঁদের বাবার দাদির রেখে যাওয়া তহবিল থেকেও বড় অঙ্কের সম্পদ পাবেন। মেগান কানাডার টেলিনাটক স্যুইটস–এর প্রতিটি পর্বে অভিনয়ের জন্য ৫০ হাজার ডলার করে পারিশ্রমিক পান। বর্তমানে বন্ধ থাকা নিজস্ব ফ্যাশন লাইন থেকেও তাঁর কিছু বিত্ত গড়ে উঠেছে। তবে এসব সম্পদ সত্ত্বেও রাজপরিবারের পরিচয় বা উপাধি ধারণ করে ব্যক্তিগত ব্যবসায় যুক্ত হওয়ার সুযোগ সম্ভবত তাঁরা পাবেন না।

তাঁদের ভবিষ্যৎ আবাস কোথায় হবে, সেটিও একটি বড় জিজ্ঞাসা। তাঁরা তাঁদের জন্য নির্ধারিত উইন্ডসর প্রাসাদে না থেকে তার পাশে আলাদা একটি ভবনে আবাস গড়েছিলেন, যার জন্য সরকারিভাবে ব্যয় হয়েছে প্রায় ২৫ লাখ পাউন্ড। প্রশ্ন উঠেছে, এত বড় অপচয় কেন করা হলো। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে মেগান তাঁর স্বামীকে নিয়ে কি সে দেশেই পাড়ি জমাবেন? সেই সম্ভাবনাও কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ। কেননা, যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে কারও কোনো উপাধি স্বীকৃত নয় এবং সে কারণে সেখানে নাগরিকত্ব নিতে হলে রাজকুমার হ্যারিকে তাঁর রাজপরিবারের উপাধি পরিত্যাগ করতে হবে। এমনকি মেগান বৈবাহিক সূত্রে যে উপাধি পেয়েছেন, সেটাও তিনি রাখতে পারবেন না। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসনের জন্য আইনি প্রক্রিয়া একটু সময়সাপেক্ষ এবং একেবারে সাদামাটা নয়। তবে কানাডায় অভিবাসন তাঁদের জন্য সহজতর হতে পারে।