ভারতে নাগরিকত্ব নিয়ে বিরোধী পালে হাওয়া বাড়ছে

এনআরসি ও সিএএ-র প্রতিবাদে ম্যাঙ্গালোরে প্ল্যাকার্ড হাতে বিক্ষোভকারীরা। ম্যাঙ্গালোরেই পুলিশের গুলিতে দুই বিক্ষোভকারী নিহত হন। ভারত, ১৩ জানুয়ারি। ছবি: এএফপি
এনআরসি ও সিএএ-র প্রতিবাদে ম্যাঙ্গালোরে প্ল্যাকার্ড হাতে বিক্ষোভকারীরা। ম্যাঙ্গালোরেই পুলিশের গুলিতে দুই বিক্ষোভকারী নিহত হন। ভারত, ১৩ জানুয়ারি। ছবি: এএফপি

শাসক দল বিজেপির ‘বিভেদকামী নীতির’ বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে দেশের সংবিধান ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করতে ভারতের বিরোধী দলগুলো জানুয়ারি মাসের তিনটি বিশেষ দিন বিশেষভাবে পালনের সিদ্ধান্ত নিল। কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর ডাকা ওই বৈঠকের শেষে বিরোধী দলের নেতারা এ বিষয়ে এক প্রস্তাবে সম্মত হয়েছেন। ওই তিনটি বিশেষ দিন হলো ২৩ জানুয়ারি, ২৬ জানুয়ারি ও ৩০ জানুয়ারি।

প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ২৩ জানুয়ারি নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর জন্মদিন, যিনি ‘জয় হিন্দ’ স্লোগানের জন্ম দিয়েছেন ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ধারক ছিলেন। ২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবসে সংবিধান রক্ষার শপথ নিতে হবে। ৩০ জানুয়ারি গান্ধীজি নিহত হয়েছিলেন। তাঁকে স্মরণের মধ্য দিয়ে ওই দিন ধর্মনিরপেক্ষতার প্রয়োজনীয়তাকে ছড়িয়ে দেওয়া হবে।

বৈঠকের শুরুতেই দেশের বর্তমান পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে সোনিয়া বলেন, মানুষে মানুষে বিভাজন ঘটিয়ে, ভয় দেখিয়ে, ঘৃণা ছড়িয়ে, সংবিধান লঙ্ঘন ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অপব্যবহারের মাধ্যমে বিজেপি দেশ শাসন করছে। এসব করছে বেহাল অর্থনীতি থেকে মানুষের দৃষ্টি আড়াল করতে। এই প্রবণতার বিরুদ্ধে এক জোট হওয়া জরুরি। বৈঠকের পর রাহুল গান্ধী বলেন, অর্থনীতির হাল এমন যে ছাত্র সমাজ কোনো আশার আলো দেখতে পাচ্ছে না। চাকরি নেই। বেকারত্ব বাড়ছে হু হু করে। প্রধানমন্ত্রীর সাহস থাকলে ছাত্রদের মুখোমুখি হোন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যান। বলুন অর্থনীতি নিয়ে কী তিনি করতে চান। বোঝান কেন দেশের আর্থিক হাল এত খারাপ। তা না করে তিনি বিভাজন সৃষ্টি করে মানুষের দৃষ্টি ঘোরাতে ব্যস্ত।

সংসদ ভবনে সোনিয়ার ডাকা বৈঠকে তাঁর এক পাশে ছিলেন এনসিপি নেতা শরদ পাওয়ার, ডান পাশে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। আর ছিলেন আরজেডি, জেএমএম, বামপন্থীসহ মোট ২০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি। পাওয়ারকে পাশে রাখা সেই অর্থে যথেষ্ট ইঙ্গিতবাহী। যদিও প্রশ্ন উঠেছে জোটসঙ্গী শিবসেনার অনুপস্থিতিকে ঘিরে। প্রত্যাশিতভাবে যাননি তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বহুজন সমাজ নেত্রী মায়াবতী ও সমাজবাদী পার্টি নেতা অখিলেশ সিং যাদবও আসেননি। ডিএমকে নেতা স্ট্যালিনের অনুপস্থিতি ছিল বিস্ময়কর। আম আদমি পার্টির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তাদের এই বৈঠকে আমন্ত্রণই জানানো হয়নি।

এত গরহাজিরা বিরোধী ঐক্য গড়ার ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত কী আকার নেবে তা পরের কথা। আপাতত এটা ক্রমশ স্পষ্ট, নাগরিকত্বের প্রশ্নে শাসক দল বন্ধু হারাচ্ছে। সোনিয়ার ডাকা বৈঠক শুরুর কিছু আগেই বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নিতীশ কুমার রাজ্য বিধানসভায় স্পষ্ট জানিয়ে দেন, সিএএ নিয়ে আরও ভাবনাচিন্তা ও বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। তিনি চান রাজ্যে সিএএ চালু করার আগে খোলামনে সেই বিতর্ক হোক। নিতীশের দল সংসদে নাগরিকত্ব বিলের পক্ষে ভোট দিয়েছিল।

সাতটি রাজ্য পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে সিএএ, এনআরসি ও এনআরবি তারা বলবৎ করবে না। ওই রাজ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে কংগ্রেস শাসিত পাঞ্জাব, রাজস্থান, মধ্য প্রদেশ, ছত্তিশ গড় ও দক্ষিণী রাজ্য পুদুচেরী। এই রাজ্যগুলোর সম্মিলিত জনসংখ্যা ২৬ দশমিক ৩ শতাংশ। মহারাষ্ট্র ও ঝাড়খন্ড সরকারের শরিক কংগ্রেস। এই দুই রাজ্যও বিরোধিতা করলে বিরোধী জনসংখ্যার পরিমাণ দাঁড়াবে ৩৮ দশমিক ৪ শতাংশ। নিতীশ কুমার বিরোধিতার সিদ্ধান্তে অটল থাকলে সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়াবে ৪৭ শতাংশে।

শাসক বিজেপির দুশ্চিন্তা আরও বাড়বে অন্ধ্র প্রদেশ, তেলেঙ্গানা ও ওডিশা মুখ ফেরালে। বিরোধী বলে চিহ্নিত হবে দেশের সাড়ে ৫৭ শতাংশ মানুষ। এই সঙ্গে দিল্লির দেড় শতাংশ যোগ হলে হিসেবটা পৌঁছে যাবে ৫৯ শতাংশে! বাম-শাসিত দক্ষিণের রাজ্য কেরালা ইতিমধ্যে বিধানসভায় প্রস্তাব পাস করে বলেছে, তারা সিএএ, এনআরসি ও এনআরবি বলবৎ করবে না। প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে একই সিদ্ধান্ত নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার।

এই প্রবল জনমত উপেক্ষা করা শাসক বিজেপির পক্ষে সহজ হবে না। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের ওপরেও তা নিঃসন্দেহে চাপ সৃষ্টি করবে। এ বিষয়ে দায়ের করা একাধিক মামলা এখন সুপ্রিম কোর্টে শুনানির অপেক্ষায়।