ইরাকে মার্কিন সেনাদের লক্ষ্য করে আবার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা

গত মঙ্গলবার রাতে ইরাকে মার্কিন সেনাদের লক্ষ্য করে এক দফা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। ছবি: এএফপি
গত মঙ্গলবার রাতে ইরাকে মার্কিন সেনাদের লক্ষ্য করে এক দফা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। ছবি: এএফপি

ড্রোন হামলায় মেজর জেনারেল কাশেম সোলাইমানিকে হত্যার চরম প্রতিশোধ নিতে কথামতো গত মঙ্গলবার রাতে (স্থানীয় সময়) ইরাকে মার্কিন সেনাদের লক্ষ্য করে দুটি সামরিক ঘাঁটিতে এক দফা ক্ষেপণাস্ত্রের হামলা চালিয়েছে ইরান। এর পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তেহরানের বিরুদ্ধে কঠোর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। এ হুঁশিয়ারির মধ্যেই ইরাকে আবার মার্কিন সেনাদের লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে এর দায় কেউ স্বীকার না করলেও এক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় এর বিচার চেয়েছে ওয়াশিংটন।

এদিকে ইউক্রেনের যাত্রীবাহী বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ১৭৬ আরোহীর সবাই নিহত হওয়ার ঘটনায় গতকাল সোমবারও ইরানে সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন বহু মানুষ। রাজধানী তেহরান ছাড়াও অন্যান্য শহরে অনুষ্ঠিত এই বিক্ষোভে ইরানের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে স্লোগান দেন অংশগ্রহণকারীরা। আগের দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে।

সামরিক ঘাঁটিতে মঙ্গলবারের হামলার কয়েক ঘণ্টা পরই তেহরানে ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ইউক্রেনের উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনার জের ধরে ইরানে আয়াতুল্লাহ খামেনির পদত্যাগের দাবিতে যে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে, তা গতকাল তৃতীয় দিনের মতো অব্যাহত ছিল। ইরান সরকারের দাবি, মানবিক ভুলেই ঘটেছে উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার এমন ঘটনা।

বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে বলা হয়, পাল্টাপাল্টি হামলা–হুমকিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে চলা উত্তেজনার মধ্যে ইরাকের রাজধানী বাগদাদের উত্তরে একটি ইরাকি বিমানঘাঁটিতে গত রোববার নতুন করে ওই ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়। এতে কোনো মার্কিন সেনা হতাহত না হলেও আহত হয়েছেন ইরাকি চার কর্মকর্তা। যুক্তরাষ্ট্র হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। এর আগে মঙ্গলবার রাতে ইরাকের আইন আল-আসাদ ও এরবিলে ইরাকি সামরিক ঘাঁটিতে ইরানের ২২টি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কোনো ইরাকি সেনা হতাহত হননি। তবে হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত ৮০ জন ‘সন্ত্রাসী’ নিহত হওয়ার দাবি করেছিল ইরান।

ইরাকি কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে দেশটির বার্তা সংস্থা আইএনএ বলেছে, রোববার বাগদাদ থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে আল–বালাদ বিমানঘাঁটিতে ছোট ধরনের ৮টি কাতিউশা ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছে। এর কয়েকটি আঘাত হেনেছে বিমানঘাঁটির একটি রেস্তোরাঁয়। অন্যগুলো আঘাত হানে উড়োজাহাজের রানওয়ে ও বিমানঘাঁটির ফটকে। হামলায় ইরাকের দুই কর্মকর্তা ও দুই পাইলট আহত হন।

এই হামলার দায় কেউ স্বীকার করেনি। এর আগে এ রকম হামলার জন্য ইরান–সমর্থিত ইরাকি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে দায়ী করে যুক্তরাষ্ট্র।

ওই ঘটনায় ইরাকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক জোট বলেছে, হামলার সময় বিমানঘাঁটিতে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সেনাসদস্য ছিলেন না। যুদ্ধবিমান এফ–১৬ রক্ষণাবেক্ষণ ও কারিগরি সুবিধা দিতে বিমানঘাঁটিতে কিছু মার্কিন প্রশিক্ষক ও সামরিক উপদেষ্টা থাকেন। সামরিক সূত্রগুলো বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনী ও চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের একটি ছোট দল এ ঘাঁটিতে অবস্থান করছেন। ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে যাওয়ার পর তাঁদের প্রায় সবাইকে এখান থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

নতুন করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার নিন্দা জানিয়ে রোববার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও টুইট করেন, ‘ইরাকি বিমানঘাঁটিতে আবার হামলার খবরে আমরা ক্ষুব্ধ। ইরাকি সরকারের অনুগত নয়, এমন গোষ্ঠীগুলোর পক্ষ থেকে অব্যাহতভাবে ইরাকের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের ঘটনা শেষ হওয়া উচিত। এই ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনতে ইরাকের সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই।’

ইতিমধ্যে ইরান–সমর্থক লেবাননের শিয়া রাজনৈতিক দল হিজবুল্লাহ বলেছে, মার্কিন বাহিনী থাকা ইরাকের সামরিক ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মধ্যে দিয়ে সোলাইমানি হত্যার জবাব শুরু হয়েছে। দলটির নেতা হাসান নাসরুল্লাহ বলেন, ‘মার্কিনদের আমাদের অঞ্চল থেকে তাদের সামরিক ঘাঁটি, সেনা, কর্মকর্তা ও যুদ্ধজাহাজ গুটিয়ে নিতে হবে।’

ইরানে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ চলছে

ইউক্রেনের যাত্রীবাহী বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ১৭৬ আরোহীর সবাই নিহত হওয়ার ঘটনায় গতকালও ইরানে সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন বহু মানুষ। রাজধানী তেহরান ছাড়াও অন্যান্য শহরে অনুষ্ঠিত এ বিক্ষোভে ইরানের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে স্লোগান দেন অংশগ্রহণকারীরা।

বিক্ষোভ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কিছু ভিডিওতে গুলির শব্দ শোনা গেছে। বিক্ষোভকারীদের ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের লাঠিপেটা করতে ও সড়কে রক্তের দাগ দেখা গেছে। তবে রয়টার্সের খবরে বলা হয়, ইরানের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যমে গতকাল দেশটির পুলিশপ্রধান এক বিবৃতিতে বলেন, বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশ কোনো গুলি ছোড়েনি। তা ছাড়া বিক্ষোভকারীদের ব্যাপারে পুলিশকে সংযম প্রদর্শন করতে বলা হয়েছে।

প্রাথমিকভাবে ওই উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার পেছনে নিজের দায় অস্বীকার করলেও চাপের মুখে ইরান স্বীকার করেছে, ক্ষেপণাস্ত্রের ‘অনিচ্ছাকৃত’ আঘাতে এ ঘটনা ঘটেছে। উড়োজাহাজটিতে অনেক ইরানি ছাড়াও কানাডা, ইউক্রেন, যুক্তরাজ্য, আফগানিস্তান ও সুইডেনের নাগরিক ছিলেন।

বিক্ষোভ নিয়ে ট্রাম্পের হুঁশিয়ারি

ইরানে চলমান সরকারবিরোধী বিক্ষোভ নিয়ে রোববার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তেহরানকে হুঁশিয়ার করে এক টুইটে বলেন, ‘ইরানের নেতাদের বলছি, বিক্ষোভকারীদের হত্যা করবেন না। গোটা বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ঘটনা দেখছে।’

‘ন্যায়বিচার’ চান ট্রুডো

কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেছেন, ইরানে উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে অনেকে নিহত হওয়ার ঘটনায় তিনি ন্যায়বিচার চান। আর তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি এ বিষয়ে সরব থাকবেন। ওই উড়োজাহাজ ধ্বংসের ঘটনায় নিহত হন ৫৭ কানাডীয় নাগরিক। রোববার আলবার্টার এডমনটনে নিহত এই ব্যক্তিদের স্মরণে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এই বিচার দাবি করেন ট্রুডো। 

অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো ওই ঘটনায় ইরানের কাছ থেকে জবাব আদায়েরও অঙ্গীকার করেন। ট্রুডো বলেন, ‘এ মর্মান্তিক ঘটনা কখনোই ঘটার ছিল না। আমি আপনাদের নিশ্চয়তা দিতে চাই, এই ব্যতিক্রমী কঠিন সময়ে আপনাদের ওপর আমার পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। ঘটনার জবাব না পাওয়া পর্যন্ত আমরা ক্ষান্ত হব না।’