চীনের 'রহস্যময়' ভাইরাস নিয়ে নানা শঙ্কা

চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান। ছবি: হুবেই প্রদেশের সরকারি ওয়েবসাইটের সৌজন্যে
চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান। ছবি: হুবেই প্রদেশের সরকারি ওয়েবসাইটের সৌজন্যে

চীনের রহস্যময় ভাইরাসে আরও বেশিসংখ্যক মানুষের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। চীনের বাইরে থাইল্যান্ড ও জাপানেও এই ভাইরাসে আক্রান্ত তিনজন রোগীকে শনাক্ত করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে গত ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানে দুজন মারা গেছেন। নতুন এই ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা চীনের দেওয়া তথ্যের চেয়ে অনেক বেশি বলে দাবি করেছেন বিজ্ঞানীরা।

চীন দাবি করেছে, এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে ৪১ জন। তবে ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞদের মতে, এ সংখ্যা ১ হাজার ৭০০-র কাছাকাছি। তাঁরা ভাইরাসটি এক ব্যক্তি থেকে অপর ব্যক্তিতে সংক্রমিত হয়ে নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও করছেন। যদিও চীন বলছে, ভাইরাসটি মানুষ থেকে মানুষ নয়, প্রাণী থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়েছে।

আজ শনিবার বিবিসি অনলাইনের খবরে বলা হয়, রোগ প্রাদুর্ভাববিষয়ক ব্রিটিশ বিজ্ঞানী অধ্যাপক নিল ফেরগুসন নতুন ভাইরাসটি প্রসঙ্গে বিবিসিকে বলেছেন, ‘বাস্তবিকভাবে আমি এক সপ্তাহ আগের চেয়ে এখন আরও বেশি উদ্বিগ্ন।’

ইমপিরিয়াল কলেজ লন্ডনে ভাইরাসটি নিয়ে কাজ করেছে যুক্তরাজ্য সরকার ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শক সংস্থা এমআরসি সেন্টার ফর গ্লোবাল ইনফেকশিয়াস ডিজিজ অ্যানালাইসিস।

চীনের এই ভাইরাস নিয়ে বিমানবন্দরে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে সিঙ্গাপুর, হংকং ও যুক্তরাষ্ট্র। সিঙ্গাপুর ও হংকং চীনের উহান শহর থেকে আসা যাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছে। গতকাল শুক্রবার একই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান তিনটি বিমানবন্দর সান ফ্রানসিসকো, লস অ্যাঞ্জেলেস ও নিউইয়র্কে। ভাইরাসটি উহান শহরকে কেন্দ্র করে ছড়ালেও আরও দুটো দেশে এই ভাইরাসে আক্রান্ত আরও তিনজন রোগী পাওয়া গেছে। এঁদের মধ্যে দুজন থাইল্যান্ডের আর অন্যজন জাপানের।

এ ঘটনা তাঁকে আরও দুশ্চিন্তায় ফেলেছে বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক ফেরগুসন। তিনি বলেন, উহানের ভাইরাসটি অন্য দেশে পাওয়া যাওয়ার অর্থ হচ্ছে, যা দাবি করা হচ্ছে তার চেয়েও আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বেশি হতে পারে।
আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ঠিক কত, তা নির্ণয় করা কঠিন। তবে স্থানীয় জনসংখ্যা ও উড়োজাহাজ উড্ডয়নের ডেটা থেকে আনুমানিক একটি হিসাব বের করা যায় বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

উহান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ১ কোটি ৯০ লাখ মানুষের সেবায় নিয়োজিত। তবে বিমানবন্দরটি থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যাতায়াত করেন দিনে মাত্র ৩ হাজার ৪০০ জন। এ দুটিকে হিসাব করে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ১ হাজার ৭০০-র কাছাকাছি বলে অনুমান করা হচ্ছে। একটি অনলাইনভিত্তিক বিজ্ঞান বিষয়ক জার্নালে এ তথ্য ইতিমধ্যে প্রকাশ করাও হয়েছে।

অধ্যাপক ফেরগুসন বলেন, এখনো আতঙ্কিত হওয়ার মতো অবস্থা না হলেও তিনি এক সপ্তাহ আগের চেয়ে এখন আরও উদ্বিগ্ন।

চীন জানিয়েছে, ভাইরাসটি এক ব্যক্তি থেকে আরেক ব্যক্তিতে ছড়িয়ে পড়ার কোনো প্রমাণ পায়নি তারা। তাদের মতে, ভাইরাসটি এক প্রাণী থেকে অন্য প্রাণীতে সংক্রমণের স্বাভাবিক প্রতিরোধ পার হয়ে এসেছে। আর তা সংক্রমিত হয়েছে সামুদ্রিক খাবার থেকে।

এ ব্যাপারে অধ্যাপক ফেরগুসন বলেছেন, এক ব্যক্তি থেকে আরেক ব্যক্তিতে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও সবার বিবেচনায় রাখা উচিত।

রোগীর কাছ থেকে ভাইরাসটির নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে। পরীক্ষার পর চীন এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে সংক্রমণটি করোনা ভাইরাস। এই ধরনের ভাইরাসগুলো ব্যাপক হারে থাকলেও নতুনটিসহ মাত্র সাতটি মানুষকে সংক্রমিত করে বলে জানা গেছে। করোনা ভাইরাস সাধারণ মানুষকে ঠান্ডাজনিত রোগে ভোগায়। তবে করোনা ভাইরাসের মধ্যে শ্বাসকষ্টজনিত সিভিয়ার অ্যাকুয়েট রেসপিরেটরি সিনড্রোম (সার্স) ভাইরাস মৃত্যুর কারণও ঘটায়।

২০০২ সালে চীনে একবার সার্স ভাইরাসের ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। ওই সময় সার্স-আক্রান্ত ৮ হাজার ৯৮ জনের মধ্যে ৭৭৪ জন মারা যায়। নতুন ভাইরাসের জিনগত বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মানবদেহের জন্য যেকোনো করোনা ভাইরাসের তুলনায় এটি সার্সের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি মেলে। এই ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের মধ্যে কারও কারও নিউমোনিয়া হয় এবং তাদের মধ্যে দুজনের অবস্থা ভয়াবহ আকার ধারণ করে।

চিকিৎসাবিষয়ক দাতব্য গবেষণা সংস্থা ওয়েলকামের পরিচালক ড. জেরেমি ফারার নতুন ভাইরাসটি সম্পর্কে বলেন, এই রোগের প্রাদুর্ভাবের আরও বাকি রয়েছে। এ বিষয়ে তথ্যগত অনিশ্চয়তা ও নানা ফাঁকফোকর থাকলেও এটা স্পষ্ট যে, কোনো একপর্যায়ে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতেও ভাইরাসটি সংক্রমিত হতে পারে। তিনি আরও বলেন, চীনসহ অন্য দেশগুলোতে নতুন ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির খবর শোনা যাচ্ছে। এতে ধারণা করা যাচ্ছে, বিভিন্ন দেশে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা আরও বেশি হবে।

নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জনাথন বল বলেছেন, ব্যাপক হারে গবেষণা ছাড়া এই ভাইরাসে আক্রান্তের হার নির্ণয় করা কঠিন। সেটা না জানা পর্যন্ত আক্রান্তের যে সংখ্যা পাওয়া গেছে, সেটাই গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত। এখন পর্যন্ত এ ভাইরাস প্রাণী থেকে মানুষে ছড়ানোর ৪১টি ঘটনার কথা বলা হচ্ছে। এর বাইরে আরও নানাভাবে সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কাও থাকতে পারে।