চীন বলছে অগ্রগতি হয়েছে, বাস্তবতা ভিন্ন

রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে দীর্ঘদিন যাবৎ আলোচনা চললেও এখনো এই সংকটের সমাধান হয়নি। ছবি: রয়টার্স
রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে দীর্ঘদিন যাবৎ আলোচনা চললেও এখনো এই সংকটের সমাধান হয়নি। ছবি: রয়টার্স

বছর দু-এক আগে রোহিঙ্গা মুসলিমদের জন্য থাকার জন্য মিয়ানমারে কিছু তাঁবু পাঠিয়েছিল চীন। তাঁবুগুলো যেভাবে পাঠানো হয়েছিল, ঠিক সেভাবেই ফাঁকা অবস্থায় পড়ে আছে রাখাইনের মংডু শহরে। ফাঁকা এই তাঁবুগুলো যেন একটি প্রতীকী অর্থও বহন করছে। যাদের জন্য এগুলো পাঠানো হলো, সেই রোহিঙ্গারাই যে এখনো নিজ দেশে ফিরতে পারলেন না!

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনের বিদেশ বিষয়ক নীতিমালা অনুযায়ী, বাইরের দুই দেশের কূটনৈতিক বিষয়ে তাঁরা মাথা ঘামায় না। কিন্তু নিজেদের অন্যতম মিত্র ও প্রতিবেশী মিয়ানমারের এই সংকট সমাধানে বেশ কয়েকবার হস্তক্ষেপের চেষ্টা করেছে চীন। অন্তত তিনবার বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছে দেশটি। কিন্তু জাতিসংঘের মতো চীনের হস্তক্ষেপেও খুব একটা কাজ হয়নি। খুব দ্রুত এই সংকটের সমাধান হবে, তেমন সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।

পক্ষগুলোর মধ্যে অনৈক্যের মূল জায়গাটি হলো রাখাইনে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ইস্যু। মিয়ানমার বলছে, রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরার মতো উপযুক্ত পরিবেশ তাঁরা তৈরি করেছে। কিন্তু জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, রাখাইন এখনো রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ নয়। রোহিঙ্গারাও বলছেন, জানমালের নিরাপত্তা, স্বাধীনভাবে চলাফেরার নিশ্চয়তা ও নাগরিকত্ব না পেলে তাঁরা রাখাইনে ফিরবে না।

গত দুই বছরে তিনবার বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছে চীন। বেশ কয়েকবার কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এসে রোহিঙ্গাদের অবস্থাও দেখে গেছেন চীনা প্রতিনিধিরা। এমনকি রোহিঙ্গাদের জন্য আর্থিক সহায়তাও দিয়েছে তারা। কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছু হয়নি।

গত সপ্তাহে দুই দিনের সফরে মিয়ানমার এসেছিলেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। ছবি: রয়টার্স
গত সপ্তাহে দুই দিনের সফরে মিয়ানমার এসেছিলেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। ছবি: রয়টার্স

চীন অবশ্য দাবি করছে, তাদের হস্তক্ষেপ অনেকটাই সফল হয়েছে। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সাম্প্রতিক মিয়ানমার সফরের আগে ১০ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলনে চীনের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী লুয়ো ঝাওহুই বলেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের যাতে দ্রুত নিজভূমে ফেরত পাঠানো যায়, সেটি নিশ্চিত করতে মিয়ানমার, বাংলাদেশ ও চীনের পররাষ্ট্র দপ্তরের মধ্যে তিনটি বৈঠক হয়েছে। আমাদের প্রচেষ্টা সফল হয়েছে।’

তবে বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা, ইয়াঙ্গুনে নিযুক্ত পশ্চিমা কূটনীতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টিই চীনের মূল প্রাধান্যের বিষয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বাংলাদেশি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেছেন, ‘চীন সংকট নিরসনে চেষ্টা চালাচ্ছে। অন্তত তারা যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে চায়। কিন্তু রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে মিয়ানমার সরকারের ওপর তারা কোনো চাপ সৃষ্টি করছে না।’

বিদেশি কূটনীতিকরাও বলছেন, রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয়টি চীনের প্রাধান্যের তালিকায় নেই। ইয়াঙ্গুন ভিত্তিক এক কূটনীতিক বলেছেন, ‘মিয়ানমার ও বাংলাদেশ দুই দেশের সঙ্গেই চীন আলোচনা করেছে। কিন্তু সেখানে যদি জীবনধারণের উপযুক্ত পরিবেশই না থাকে, তাহলে এসব আলোচনার অর্থ কী?’ এ বিষয়ে চীন সরকার অবশ্য রয়টার্সকে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।

সম্প্রতি চীনা প্রেসিডেন্টের মিয়ানমার সফরেও রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার বিষয়ে তেমন কোনো আলোচনা হয়নি। বরং মিয়ানমারে বিপুল চীনা বিনিয়োগ ও রাখাইনে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের ব্যাপারেই বেশি আলোচনা হয়েছে। এ ব্যাপারে ওয়াশিংটনের স্টিমসন সেন্টারের পূর্ব-এশিয়া বিষয়ক সহকারী পরিচালক ইউন সান বলেছেন, ‘চীন মানবতা রক্ষার খাতিরে রোহিঙ্গা সংকটের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে, আমার তা মনে হয় না। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিকই তাদের কাছে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।’