বিধ্বস্ত সিরিয়াকে গড়ছেন এককালের অবরুদ্ধ নারীরাই

দীর্ঘ গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত সিরিয়াকে গড়তে কাজ করছেন দেশটির নারীরা, যাঁরা নিজেরাই একসময় ছিলেন অবরুদ্ধ। ছবি: রয়টার্স
দীর্ঘ গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত সিরিয়াকে গড়তে কাজ করছেন দেশটির নারীরা, যাঁরা নিজেরাই একসময় ছিলেন অবরুদ্ধ। ছবি: রয়টার্স

সিরিয়ার পূর্ব আলেপ্পোর পথেঘাটে নারীদের একসময় কদাচিৎ দেখা মিলত। ঘরে অবরুদ্ধ থাকাই যেন তাদের নিয়তি ছিল। বাইরে বের হতে হলে সঙ্গে নিতে হতো কোনো পুরুষ সঙ্গীকে। শুধু পূর্ব আলেপ্পো কেন, সিরিয়ার বহু অঞ্চলের বাস্তবতাই এমন ছিল। কিন্তু এখন এ চিত্র বদলাতে শুরু করেছে। অবশ্য অনেকটা নিরুপায় হয়েই। দীর্ঘ গৃহযুদ্ধই এ বাস্তবতা বদলে দিয়েছে।

আলেপ্পোকে বলা হয় সিরিয়ার বাণিজ্যিক রাজধানী। এর প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো আগে থেকেই ছিল রক্ষণশীল। এসব অঞ্চলের নারীদের অবরুদ্ধ থাকাই ছিল নিয়তি। কিন্তু গৃহযুদ্ধ এই নিয়তিকে বদলে দিয়েছে। যুদ্ধের কারণে বহু পরিবার পুরুষশূন্য হয়ে পড়ায় এখন নারীদেরই হাল ধরতে হচ্ছে। পূর্ব আলেপ্পোসহ সিরিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের পথে–ঘাটে নারীদের উপস্থিতিই এখন স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। গৃহযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বিধ্বস্ত দেশটিকে নতুন করে গড়া এবং এতে প্রাণসঞ্চারের দুরূহ কাজটি এখন তাঁরাই করছেন। এই নারীদের কেউ শোকাহত, কেউবা আবার আক্ষরিক অর্থেই সর্বহারা। এদের অনেকেই আবার গৃহযুদ্ধের বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার আগে বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে একেবারেই সম্পর্কহীন ছিলেন।

দীর্ঘ আট বছরের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের পর প্রায় পুরো সিরিয়াই এখন দেশটির সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সরকারবিরোধীসহ অন্য সব পক্ষ শুধু কোণঠাসাই নয়, পরাজিতও। কোনো সদস্যকে হারায়নি এমন সাধারণ পরিবারের সংখ্যা খুব কম। এমন বহু পরিবার রয়েছে, যার এতিম শিশুদের দেখভালের দায় পড়েছে বৃদ্ধ দাদির ওপর। আর সঙ্গী হারিয়ে বিধবা হওয়া নারীর সংখ্যা গুনে শেষ করার মতো নয়। আবার এমন বহু নারী রয়েছেন, যাঁরা হয়তো কোনো দিন বিয়ের জন্য কোনো পুরুষকে খুঁজে পাবেন না।

দীর্ঘ গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত সিরিয়াকে গড়তে কাজ করছেন দেশটির নারীরা, যাঁরা নিজেরাই একসময় ছিলেন অবরুদ্ধ। ছবি: রয়টার্স
দীর্ঘ গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত সিরিয়াকে গড়তে কাজ করছেন দেশটির নারীরা, যাঁরা নিজেরাই একসময় ছিলেন অবরুদ্ধ। ছবি: রয়টার্স

সিরিয়ার নারীদের জন্য এই পরিস্থিতি অভিনব। আগে ঘর থেকে একা বের হওয়াই যেখানে তাঁদের জন্য দুরূহ ছিল, এখন সেখানে তাঁরা ঘরের বাইরে কাজে যুক্ত হচ্ছেন। এর মধ্য দিয়ে তাঁরা শুধু নিজ পরিবারের হালই ধরছেন না, দেশকে পথ দেখাচ্ছেন অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার। সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের মতো অগ্রসর অঞ্চলগুলোয় নতুন কিছু না হলেও দেশটির বহু অঞ্চলের জন্য এটি একেবারে অভিনব একটি বিষয়।

জীবনে প্রথমবারের মতো ঘর-বাহির সব সামলাচ্ছেন এমন নারীদের মধ্যে একজন ফাতিমা রাওয়াস। ৩২ বছর বয়সী এ নারীর স্বামী তিন বছর আগে যুদ্ধে মারা যান। বাইরের কাজের অভিজ্ঞতাহীন এ নারী গত বছরের মে মাসে প্রথম নিজের একটি ব্যবসা শুরু করেন; প্রতিষ্ঠা করেন বিউটি সেলুন। এ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে এ নারী নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ‘আগে নারীরা সবকিছুকে ভয় পেত। কিন্তু এখন ভয় পাওয়ার মতো কিছু আর নেই। এক দীর্ঘ ও কঠিন পথ পেরিয়ে এখানে এসেছি আমরা।’

এর আগে পরিবারের বাইরের কোনো পুরুষের সঙ্গে দেখা হয়নি ফাতিমার। মাত্র ১৯ বছর বয়সেই এক আত্মীয়ের সঙ্গে বাগদান হয় তাঁর। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এ ক্ষেত্রে তাঁর কোনো মত নেওয়া হয়নি। মৃদু আপত্তি জানালেও তা গ্রাহ্য হয়নি। তারপর গাঁটছড়া বেঁধে সংসারে মন দেন। বৃত্তবন্দী জীবন নিয়ে প্রশ্ন তোলার কথা কখনো মনে হয়নি। পূর্ব আলেপ্পোয় থিতু হয়ে বেশ ভালোই সময় কাটছিল ফাতিমার। কিন্তু ২০১২ সালে বাড়ির দরজায় এসে উপস্থিত হয় গৃহযুদ্ধ। ২০১৬ সালে বিদ্রোহীদের হটিয়ে পুরো আলেপ্পোর দখল নেয় বাশার আল-আসাদ সরকারের বাহিনী। দীর্ঘ চার বছরের সংঘাতে পূর্ব আলেপ্পো তত দিনে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। আবার বিদ্রোহীরাও পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় হয়নি। পুরো অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে তখনো খণ্ডযুদ্ধ চলছে। এমনই এক সময়ে বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় বন্দী হন ফাতিমার স্বামী। এ অবস্থায় অকূলপাথারে পড়েন ফাতিমা। সন্তানদের জন্য দুধ কিনতে তাঁকে ঘরের চৌকাঠ পেরোতে হয় প্রথমবারের মতো। স্বামীকে মুক্ত করতে গিয়ে সম্ভব সবকিছুই বিক্রি করেন, করেছেন ধার, যুক্ত হন সেলাইয়ের কাজে। মুক্ত হওয়ার পর ফাতিমাকে তাঁর স্বামী বলেছিলেন, ‘আমার মৃত্যু যেন তোমার আগে হয়। কারণ, আমার চেয়ে তোমার মানসিক শক্তি অনেক বেশি।’ তা-ই হয়েছিল। একদিন বোমার শব্দ শুনে বাইরে গিয়ে আর ফিরে আসেননি তিনি। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তাঁর।

ফাতিমার মতো একজন নারীর জন্য এটুকু লড়াই-ই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু তাঁর সন্তানদের সামনে পড়ে ছিল গোটা জীবন, যার জন্য তাঁকে আরও লড়ে যেতে হতো। ঠিক তা-ই করছেন ফাতিমা। বিউটিফিকেশনের ওপর কোর্স করে রেড ক্রিসেন্টের দেওয়া ঋণের অর্থে গড়ে তুলেছেন নিজের একটি প্রতিষ্ঠান। নিজের শক্তির খোঁজটি এখন তিনি পুরোদস্তুর পেয়ে গেছেন। নিউইয়র্ক টাইমসকে তিনি বলেন, ‘যখন আপনি উপার্জন করবেন, তখন কারও কাছে আপনার কিছু চাওয়ার প্রয়োজন নেই। সন্তানেরা না থাকলে হয়তো আমার ভেতরের এই শক্তির সঙ্গে কখনো আমার পরিচয়ই হতো না। তখন নিজের জন্য হয়তো অন্য কারও ওপর আমি নির্ভর করতাম। অন্যের ওপর নির্ভরশীল নারীর দুর্বলতার সুযোগটাই সবাই নেয়।’

ফাতিমার মতো এমন নারী এখন সিরিয়ার আনাচকানাচে। নিজের একটি সংসার গঠনের স্বপ্ন নিয়ে ঘোরা নারীর সংখ্যাও কম নয়। এ বিষয়ে সিরিয়ার লাতাকিয়ার বাসিন্দা ৩৪ বছর বয়সী নারী লেকা আল-শায়েখ নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ‘সিরিয়ায় কোনো পুরুষ নেই। সঙ্গী বাছাইয়ে এখন আর আগের মতো বাছবিচারের সুযোগ নেই। আমার অনেক বন্ধুই এখনো আগের মতো প্রত্যাশা নিয়ে আছে। কিন্তু তা তো হওয়ার নয়। সঙ্গী না পেয়ে অনেকেই হতাশ হয়ে পড়ছে। অনেকে সঙ্গী খুঁজতে ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের শরণ নিচ্ছে। কিন্তু তাতেও হতাশ হতে হচ্ছে। কারণ, যুবকদের অধিকাংশই প্রাণ দিয়েছে। বিবাহযোগ্য যুবকদের যারা জীবিত, তাদের জীবন সৈনিকের, যা এক স্থায়ী শঙ্কার কারণ।

সিরিয়া-তুরস্ক সীমান্তের কাছেই গড়ে উঠেছে জিনওয়ার নামের গ্রাম, যাকে এককথায় নারীদের রাজ্য বলা যায়। ছবি: জিনওয়ার ডট ওআরজি
সিরিয়া-তুরস্ক সীমান্তের কাছেই গড়ে উঠেছে জিনওয়ার নামের গ্রাম, যাকে এককথায় নারীদের রাজ্য বলা যায়। ছবি: জিনওয়ার ডট ওআরজি

গত বছরের মে মাসে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের প্রতিবেদনে উঠে আসে সিরিয়ার এক গ্রামের কথা, যার সবকিছুই পরিচালিত হয় নারীদের দ্বারা। সেই গ্রামের নাম জিনওয়ার, যার অর্থ ‘নারীর রাজ্য’। আক্ষরিক অর্থেই এটি নারীদের রাজ্য। গৃহযুদ্ধের আগেও সেখানে কোনো গ্রাম ছিল না। তাহলে রাতারাতি একটি গ্রাম কোথা থেকে এল? যুদ্ধে নির্যাতনের শিকার হয়ে, সব হারিয়ে আসা নারীরা একজোট হয়ে এ গ্রাম গড়ে তুলেছেন। এতে মূল ভূমিকা পালন করেন কুর্দি নারীরা। সারা সিরিয়ায় যখন জাতিতে জাতিতে, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে যুদ্ধ চলছে, তখন তার ভেতরেই তুরস্ক সীমান্তের কাছে গড়ে উঠেছে ‘জিনওয়া’ নামের এ বহুজাতিক গ্রাম, যেখানে কুর্দিদের সঙ্গেই থাকেন ইয়াজিদি নারীরা, থাকেন আলাউইতরা, আরবরা, এমনকি বিদেশিরাও। সেখানে দিনের বেলাতেই শুধু পুরুষদের প্রবেশাধিকার রয়েছে। রাতে এখনো গ্রামটি পাহারা দেন নারীরা। এর অবকাঠামো থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক—সব কার্যক্রম পরিচালিত হয় নারীদের দ্বারা। পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক দারুণ সতর্কবার্তা উচ্চারণ করা এ গ্রাম যেকোনো পক্ষের দ্বারাই আক্রান্ত হতে পারে, সে তুরস্ক কিংবা আইএস, কিংবা সিরিয়া সরকার যে-ই হোক না কেন।

যেকোনো যুদ্ধই সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কগুলোয় পরিবর্তন আনে। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ বলতে হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিশ্বের বহু অঞ্চলের জনমিতি যেমন বদলে দিয়েছে, তেমনি বদলে দিয়েছে সেখানকার সমাজে বিদ্যমান সম্পর্কগুলোকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরই নারী অগ্রগতি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে দৃষ্টিগোচর হয়েছে। কারণ, ওই বিধ্বস্ত সময়ে সমাজকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য নারী ছাড়া আর কেউ ছিল না। পুরুষাধিপত্য তাই তার কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। সিরিয়ার নারীদের ক্ষেত্রেও আট বছরের বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধ এ বাস্তবতা নিয়ে হাজির হয়েছে। সিরিয়ার নারী অধিকার সংস্থাগুলো এই বাস্তবতাকে একটি সুযোগ হিসেবে দেখছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে ব্রিটিশ সংবাদপত্র দ্য গার্ডিয়ানে।

যুদ্ধ সিরিয়ার নারীদের জন্য যেমন যন্ত্রণা নিয়ে এসেছিল, তেমনি এক সম্ভাবনাও নিয়ে এসেছে। দীর্ঘ এ যুদ্ধ চলাকালেও সিরিয়া মূলত চলেছে তার নারীদের ওপর ভর করেই। কিন্তু এ সত্য তখন রাষ্ট্র ও নারী উভয়ের কেউই স্পষ্টভাবে টের পায়নি। এখন যুদ্ধ-পরবর্তী সিরিয়ার অর্থনীতি ও সমাজকে এগিয়ে নেওয়ার কাজটিও করছেন নারীরাই। চরম রক্ষণশীল ও পুরুষতান্ত্রিক একটি সমাজ ভেঙে একটি তুলনামূলক সাম্যের সিরিয়া গড়া আদৌ কতটা সম্ভব হবে, তার অনেকটাই নির্ভর করছে এখন এই নারীদের ওপর।