দিল্লির ভোটকে হিন্দুস্তান বনাম পাকিস্তান-এ নামিয়ে আনল বিজেপি

দিল্লির লাল কেল্লা। ছবি: এএফপি
দিল্লির লাল কেল্লা। ছবি: এএফপি

দিল্লি বিধানসভার ভোটকেও বিজেপি শেষ পর্যন্ত হিন্দুস্তান বনাম পাকিস্তানের লড়াই করে তুলতে চাইছে। বিজেপির শীর্ষ নেতাদের নিরন্তর প্রচার তারই প্রমাণ।

দিল্লি বিধানসভার ভোট ৮ ফেব্রুয়ারি। গণনা ১১ ফেব্রুয়ারি। রাজ্যের শাসক দল আম আদমি পার্টির মোকাবিলায় বিজেপির শীর্ষ নেতারা প্রচারের তীব্রতা বাড়াচ্ছেন। পুরোদমে আসরে নেমে পড়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। একের পর এক রোড শো ও জনসভায় তাঁর গলায় একটাই সুর। তিনি বলছেন, রাজধানীর মানুষকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাঁরা পাকিস্তানের মদদদার হবেন না ভারতের হাত শক্ত করবেন। তাঁর কথার এই সুর টেনে বিজেপির প্রার্থীরা সরাসরি বলতে শুরু করেছেন, ৮ ফেব্রুয়ারির লড়াইটা হতে চলেছে ভারত বনাম পাকিস্তানের যুদ্ধ।

পাকিস্তানকে সরাসরি টেনে আনার কাজটা শুরু করেছেন অমিত শাহই। বৃহস্পতি ও শুক্রবার রাজধানীতে একাধিক জনসভা ও রোড শোয়ে তিনি কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীকে। শাহ তাঁর ভাষণে বলছেন, ‘আমরা যাই করি না কেন ওঁরা তার বিরোধিতা করেন। ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল, রাম মন্দির তৈরির উদ্যোগ, তিন তালাক অবৈধ করা, নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন—যাই আমরা করছি, ওঁরা বিরোধিতা করছেন।’ শাহর কথায়, ‘রাহুল গান্ধী আজ যা বলছেন পরক্ষণেই তা আওড়াচ্ছেন কেজরিওয়াল এবং পরের দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে শোনা যাচ্ছে সেই এক কথা।’ অমিত শাহর কথায়, ‘এঁদের হাতে দিল্লি কখনো সুরক্ষিত থাকতে পারে না।’

নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের (সিএএ) বিরুদ্ধে রাজধানী দিল্লির শাহিনবাগ এলাকায় গত এক মাসের বেশি শান্তিপূর্ণ অবস্থান বিক্ষোভ চালাচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। প্রায় নিয়ম করে কোনো না কোনো এলাকায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে সিএএ বিরোধী সমাবেশ। বিজেপির প্রার্থী কপিল মিশ্র এই বিক্ষোভ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘দিল্লির জায়গায় জায়গায় মিনি পাকিস্তান গড়ে তোলা হচ্ছে। ৮ ফেব্রুয়ারির ভোট তাই ভারত বনাম পাকিস্তানের লড়াই।’ স্পষ্টত, দিল্লিতেও বিজেপি হিন্দু মেরুকরণের তাসটা খেলছে। নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যে কপিল মিশ্রের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের নির্দেশ দিয়েছে।

দিল্লির শাসক দল আম আদমি পার্টি অবশ্য বিজেপির ওই ফাঁদে পা দিতে নারাজ। বিজেপির এই প্রচারের পাল্টা একটা শব্দও তারা খরচ করছে না। মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল সচেতনভাবে তাঁর দলের প্রচারকে উন্নয়নমুখী করে রেখেছেন। পাঁচ বছরে যা যা তিনি করেছেন, ভোট চাইছেন সেই তালিকা সামনে রেখে। গরিব ও প্রান্তিক মানুষদের সুরাহার জন্য পরিবার পিছু মাসে ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ এবং ২০ হাজার লিটার পানি বিনা পয়সায় দেওয়া হচ্ছে গত তিন বছর ধরে। গত বছরে সরকারি বাসে মহিলাদের বিনা টিকিটে যাতায়াতের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। এবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ছাত্র-ছাত্রীদেরও বিনা টিকিটে যাতায়াতের ব্যবস্থা করবেন। চিকিৎসা পরিষেবা সহজ ও সুলভ করেছেন। পাড়ায় পাড়ায় গরিবদের জন্য খুলেছেন প্রায় পাঁচ শ ‘মহল্লা ক্লিনিক’। প্রতি ক্লিনিকে বিনা পয়সায় বিভিন্ন পরীক্ষা ও ওষুধ বিলির ব্যবস্থা করেছেন। চলতি বছরের মাঝামাঝি চালু হচ্ছে ২ হাজার ৬১৩ শয্যা বিশিষ্ট তিনটি বড় সরকারি হাসপাতাল। রাজ্য সরকারের অধীনে যে ছয়টি হাসপাতাল রয়েছে, সেগুলোয় বাড়ানো হচ্ছে মোট ১ হাজার ৮৭৯ শয্যা। সরকারি অফিসগুলো দালাল মুক্ত করেছেন ‘ঘরে বসে পরিষেবা’ প্রকল্প চালু করে। দিল্লিকে অপরাধমুক্ত করতে লাগানো হচ্ছে অতিরিক্ত দেড় লাখ সিসিটিভি ক্যামেরা। সরকারি বাসে নিয়োগ করা হয়েছে ৫ হাজার মার্শাল। কেজরিওয়ালের দাবি, ‘প্রতিশ্রুতির নিরিখে নয়। আমাদের ভোট দিন কাজের নিরিখে।’ এবারের ভোটে তাঁর স্লোগানও তাই, ‘অচ্ছে বিতে পাঁচ সাল, লাগে রহো কেজরিওয়াল’। অর্থাৎ, পাঁচটা বছর ভালোই কাটল। ক্ষমতায় কেজরিওয়ালই থাকুন।’

লড়াইটা ‘হিন্দুস্তান বনাম পাকিস্তান’ নাকি কেজরিওয়ালের ‘উন্নয়ন-কেন্দ্রিক’হয়, সেটাই দ্রষ্টব্য। বিজেপির ‘জাতীয়তাবাদ’ না আম আদমি পার্টির উন্নয়নের নয়া মডেল কাকে কোল পেতে দেবে রাজধানী? প্রশ্ন সেটাই। পর পর দুটি লোকসভা ভোটে মোদির বিপক্ষে বিরোধীরা কাউকে খাঁড়া করতে পারেনি। দিল্লির ভোটেও বিজেপি কিংবা কংগ্রেস কেউই কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধ-মুখ হিসেবে নিজের দলের মধ্যে কাউকে খুঁজে পায়নি। এই লড়াইয়ের এক দিকে তাই কেজরিওয়াল, অন্য দিকে অমিত শক্তিধর বিজেপি ও হীনবল কংগ্রেস।