মিয়ানমার আদেশ মানবে?

অং সান সু চি। রয়টার্স ফাইল ছবি
অং সান সু চি। রয়টার্স ফাইল ছবি

জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা রুখতে ঐতিহাসিক আদেশ দিয়েছেন গত বৃহস্পতিবার। আদেশে মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে রক্ষায় বিশেষ পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে মিয়ানমার সরকারকে। একইসঙ্গে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেই বিষয়ে অগ্রগতিমূলক প্রতিবেদন চার মাসের মধ্যে আইসিজেতে জমা দিতে বলা হয়েছে। তবে সবার মনে একটি প্রশ্ন বড় করে দেখা দিয়েছে, ওই আদেশ যদি মিয়ানমার না মানে, তাহলে দেশটির জন্য কী হবে?

২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নৃশংস অভিযান চালায় সেনাবাহিনী। ওই অভিযানের মুখে প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয় ৭ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা। ওই অভিযানে হাজার হাজার মানুষ মারা যায়। গ্রামের পর গ্রামের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। রোহিঙ্গা মা–বোনদের ধর্ষণ করা হয়। মিয়ানমার সেনাদের এই অভিযানকে ‘জাতিগত নির্মূল’ অভিযান হিসেবে অভিহিত করেছে জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধানী দল।

এই ঘটনায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ করে গত নভেম্বরে আইসিজেতে মামলা করে আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া। সেই মামলার অন্তর্বর্তী আদেশ দেন জাতিসংঘের ওই আদালত।

আইসিজের আদেশের বিষয়ে গ্লোবাল অ্যাকাউন্টিবিলিটি ইনিশিয়েটিভ অব দ্য ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টের আইনি উপদেষ্টা ও সমন্বয়কারী কিংসলে অ্যাবোট বলেন, ‘গণহত্যা সনদমতে রোহিঙ্গাদের রক্ষায় মিয়ানমারকে বাধ্য করার জন্য বৃহস্পতিবারের আদেশ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আদেশ মানতে মিয়ানমার আইনগতভাবে বাধ্য। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত সর্বোচ্চ আদালতের তৈরি করা আন্তর্জাতিক আইনের বাধ্যবাধকতা মানতে এই আদেশ দেশটির ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করবে।’

আইসিজের আদেশের পরপরই মিয়ানমারের অং সান সু চির সরকার জানায়, দেশে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে কোনো গণহত্যা হয়নি। এর আগেও একই দাবি করে দেশটি। এখন প্রশ্ন, মিয়ানমার আইসিজের আদেশ মানবে কি না? তবে আইসিজের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ যেহেতু প্রত্যাখ্যান করেছে মিয়ানমার, সেহেতু আদেশটি না মানার আশঙ্কাই বেশি।

এই বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ ও এশিয়ান জাস্টিস কোয়ালিশন সেক্রেটারির প্রধান প্রিয়া পিল্লাই বলেছেন, মিয়ানমার আদেশ মানবে কি মানবে না, সেই বিষয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতির বড় প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে। তাই এই বিষয়টি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ বা সাধারণ পরিষদে উঠতে পারে। এটা না মানা তাদের স্বার্থের কোনো বিষয় নয়। এটা আদালতের সর্বসম্মতিক্রমের সিদ্ধান্ত।

রোহিঙ্গাদের রক্ষায় কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেই বিষয়ে প্রথমে চার মাসের মধ্যে মিয়ানমারকে প্রথম প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। ছয় মাস পর আবার প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। এই আদেশের কারণে মিয়ানমার পুরো বছরই চাপে থাকবে। এই চাপ আসতে পারে মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলো থেকেও। সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনস অব অ্যাসোসিয়েশনের (আসিয়ান) সদস্যগুলো থেকে চাপ আসতে পারে। সংস্থাটির সদস্য মিয়ানমারও।

আইসিজের আদেশের পর আসিয়ানের সদস্য মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ মালয়েশিয়া এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘এই আদেশ সঠিক পদক্ষেপ’। এই আদেশকে রাখাইনে থাকা অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। আইসিজে ওই আদেশের আগে মিয়ানমারে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষ দূত ইয়াংহি লি বলেছেন, গণহত্যার জন্য মিয়ানমারকে বিচার করার দাবি জানাবেন তিনি।

রাখাইন রাজ্যের মানবাধিকার অবস্থা নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা আরাকান প্রজেক্ট নামের একটি সংগঠনের পরিচালক ক্রিস লেওয়া বলেন, এই ঘটনায় মিয়ানমার সরকার কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

কিংসলে অ্যাবোট বলেন, ‘আদালতের আদেশ কেবল রাষ্ট্রীয় বাধ্যবাধকতা নির্ধারণের বিষয়টি নিশ্চিতের কথা বলা হলেও গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনতে একই সঙ্গে ফৌজদারি তদন্ত ও বিচারের বিষয়টি এখনো অবশ্যই রয়েছে। রোহিঙ্গা নিপীড়নের ঘটনার তদন্ত ও বিচার করতে মিয়ানমারকে যেহেতু খুব বেশি আগ্রহী হিসেবে দেখা যায়নি, তাই আন্তর্জাতিক জবাবদিহিমূলক প্রচেষ্টার জন্য এটা (আদেশ) খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের বিশ্লেষণ।