বাবা দেশের প্রেসিডেন্ট, তাই মেয়ের পোয়াবারো

অ্যাঙ্গোলার সাবেক প্রেসিডেন্ট এদুয়ার্দো দস সান্তোসের মেয়ে ইসাবেল দস সান্তোসের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। ছবি: রয়টার্স
অ্যাঙ্গোলার সাবেক প্রেসিডেন্ট এদুয়ার্দো দস সান্তোসের মেয়ে ইসাবেল দস সান্তোসের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। ছবি: রয়টার্স

বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ অ্যাঙ্গোলার ইসাবেল দস সান্তোসের শতকোটিপতি (বিলিয়নিয়ার) হওয়ার পথটা একদিক থেকে খুবই সহজ ছিল। কারণ, তাঁর সহায় হয়েছিলেন তাঁর বাবা ও অ্যাঙ্গোলার সাবেক প্রেসিডেন্ট এদুয়ার্দো দস সান্তোস। ফলে দেশের কোষাগার থেকে নিজের কোষাগারে অর্থ স্থানান্তর ইসাবেলের জন্য কঠিন কিছু ছিল না।

অবশ্য যত সহজে বলা হচ্ছে, ততটা সহজও ছিল না। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে নিজের কাছে অর্থ স্থানান্তরের জন্য অনেকগুলো ঘাট ঘুরে আসতে হয়েছে ইসাবেলকে। এ জন্য বহুজাতিক খনি কোম্পানি, বিদেশি কর-স্বর্গ, বিনিয়োগ ও ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন জটিল মডেলের সমন্বয় ঘটাতে হয়েছিল তাঁকে। ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টসের (আইসিআইজে) ফাঁস করা ৭ লাখ ১৫ হাজার নথি অন্তত সে কথাই বলছে। ইসাবেলের ই-মেল, বিভিন্ন চুক্তিসহ নানা ধরনের গুরুত্বপূর্ণ নথি রয়েছে এর মধ্যে।

ইসাবেলের এই ফাঁস হওয়া নথি আরেকটি দরিদ্র দেশের দুঃখজনক বাস্তবতাকে বিশ্ববাসীর সামনে হাজির করেছে। প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ একটি দেশ শুধু দুর্নীতির কারণেই কীভাবে নিঃস্ব হচ্ছে, তারই আরেকটি দলিল হাজির হলো সবার সামনে। বিশেষত রাজনৈতিক নেতা ও তাঁদের পরিবারের দুর্নীতির বৃত্ত কী করে একটি দেশের পায়ে বেড়ি পরিয়ে দেয়, কী করে তার সামনে চলার পথ রুদ্ধ করে দেয়, তারই এক সাক্ষ্য হাজির করলেন প্রেসিডেন্টকন্যা ইসাবেল দস সান্তোস। না, এ কাজে শুধু ইসাবেলকে দুষলে চলবে না। রাষ্ট্রের কোষাগার লুট করতে তাঁকে সবদিক দিয়ে সহায়তা করেছে পশ্চিমা বিভিন্ন কোম্পানি ও পরামর্শক গ্রুপ।

নিউইয়র্ক টাইমস জানাচ্ছে, ইসাবেলকে এ কাজে সহায়তা করা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে বোস্টন কনসালটিং গ্রুপ, ম্যাককিনসে অ্যান্ড কোম্পানি ও পিডব্লিউসির মতো নামজাদা প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বের ৪১টি দেশে ছড়িয়ে থাকা ইসাবেল ও তাঁর স্বামীকে তাঁদের নিয়ন্ত্রিত চার শতাধিক প্রতিষ্ঠান চালাতে সহায়তা দিয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এ প্রতিষ্ঠানগুলো এই দম্পতিকে বিপুল পরিমাণ অর্থ অ্যাঙ্গোলা থেকে পাচারে সহায়তা দিয়েছে। আর এই সহায়তা বিনা মূল্যে করা হয়নি। এ জন্য তারা ইসাবেলের কাছ থেকে ফি বাবদ মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে।

একটি উদাহরণ দেওয়া যাক, ইসাবেল–নিয়ন্ত্রিত একটি ব্যাংক থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে অ্যাঙ্গোলা সরকার একটি সুইস জুয়েলারি কেনে। এই কেনার কাজটিতে পূর্ণ সহায়তা দেয় বোস্টন কনসালটিং গ্রুপ। জুয়েলারি কোম্পানিটিকে আগেই দেউলিয়ার কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন এর তৎকালীন মালিক। মালিকের পরিচয় কি বোঝা যাচ্ছে? হ্যাঁ, ইসাবেল ও তাঁর স্বামী। জুয়েলারি কোম্পানিটি যখন দেউলিয়া হয় হয় দশা, তখনই তাঁরা নিজেদের নিয়ন্ত্রিত ব্যাংক থেকে ঋণ দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি নিজ দেশের সরকারের কাছেই বিক্রি করে দেন। এখন এই প্রতিষ্ঠান কেনা বাবদ অ্যাঙ্গোলা সরকারের ঋণের পরিমাণ ২২৫ মিলিয়ন ডলার। ঠিক একইভাবে অ্যাঙ্গোলার তেল খাত সংস্কারের মাহপরিকল্পনাতেও ভাগ বসিয়েছেন ইসাবেল। এ ক্ষেত্রেও তাঁর হয়ে কাজটি করে দিয়েছে বোস্টন কনসালটিং ও ম্যাককিনসে। সরকারি তহবিল থেকে কোটি কোটি ডলার গিয়ে ঢুকেছে ইসাবেলের তহবিলে। ফি বাবদ ওই দুই পরামর্শক প্রতিষ্ঠান অবশ্য নিজেদের পাওনা বুঝে নিয়েছে নিশ্চিতভাবেই।

অ্যাঙ্গোলার মতো দেশ এ ধরনের ঘটনার জন্য উর্বর ক্ষেত্র। প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ যেকোনো দুর্বল ও দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের বাস্তবতাই অ্যাঙ্গোলার মতো। অ্যাঙ্গোলায় রয়েছে জ্বালানি তেল, হীরার মতো প্রাকৃতিক সম্পদ। রয়েছে ঔপনিবেশিক শাসন, সংঘাত, অস্থিরতার মতো ইতিহাস। আর রয়েছে দুর্নীতির এক ভয়াবহ বাস্তবতা। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের করা দুর্নীতির তালিকায় বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে অ্যাঙ্গোলা বরাবরই সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের ক্ষুদ্র তালিকায় স্থান করে নেয়। আর এই পথ ধরেই ইসাবেল ও তাঁর স্বামী ২০০ কোটি ডলারের বেশি অর্থের মালিক হয়েছেন। যদিও ২৪ জানুয়ারি টুইটারে দেওয়া এক পোস্টে ইসাবেল নিজেকে ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসার’ শিকার বলে দাবি করেছেন। আর নিজেকে ‘শুদ্ধ’ বলে দাবি করার কাজটি তো তিনি অনেক আগেই করে রেখেছেন।

দরিদ্র ও দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর এমন বাস্তবতার কথা তো নতুন নয়। অ্যাঙ্গোলার ঘটনা এতে শুধু একটি সংযোজন মাত্র। বিশ্বের নানা প্রান্তের দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশের দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন দেশগুলোকে ভেতর থেকে কীভাবে খেয়ে ফেলে, তার একটি চিত্র কেবল অ্যাঙ্গোলার মধ্য দিয়ে সামনে এসেছে। আফ্রিকা, এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা ঘুরলে এমন বহু দেশের নাম উঠে আসবে, উঠে আসবে এমন বহু ইসাবেলের নাম, যাদের রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটতে সর্বাত্মক সহযোগিতা করছে প্রশাসনের শীর্ষে বসে থাকা লোকগুলো। আর এই ব্যক্তি সম্পদ লুটের অংশ হয়ে ওই দেশগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয় বোস্টন কনসালটিং গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো।

বোস্টন কনসালটিং গ্রুপ, ম্যাককিনসে অ্যান্ড কোম্পানির মতো বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থা দরিদ্র দেশগুলো থেকে সম্পদ সরিয়ে নিতে সহায়তা করছে। ছবি: রয়টার্স
বোস্টন কনসালটিং গ্রুপ, ম্যাককিনসে অ্যান্ড কোম্পানির মতো বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থা দরিদ্র দেশগুলো থেকে সম্পদ সরিয়ে নিতে সহায়তা করছে। ছবি: রয়টার্স

শুধু বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান কেন, স্বয়ং রাষ্ট্রও এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে। ধনী রাষ্ট্রগুলো হামেশাই বলে যে দরিদ্র দেশগুলোকে দারিদ্র্যের চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে, উন্নয়নশীল দেশগুলোকে উন্নয়নের সুফল পাইয়ে দিতে তারা সম্ভাব্য সবকিছুই করছে। নিজেদের ‘উদার’ ভাবমূর্তি তুলে ধরতে বিভিন্ন দেশে দেওয়া অনুদান, বিনিয়োগ ও উন্নয়ন প্রকল্পে দেওয়া ঋণের ফিরিস্তি তারা তুলে ধরে। সঙ্গে এ–ও বলে যে ঔপনিবেশিক শাসনের সময় বিশ্বের বহু দেশকে তারা শোষণ করলেও এখন তার চেয়ে শতগুণ তারা ফিরিয়ে দিচ্ছে। নিজেদের দান-অনুদানের ফিরিস্তি তুলে ধরে তারা শোষণকে ‘অতীত’ হিসেবে দেখাতে তৎপর থাকে। ‘প্রতিবছর বিভিন্ন দেশকে ১২৫ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়’, উল্লেখ করে তারা নিজেদের ঔদার্য প্রমাণে ব্যস্ত থাকে। যদিও সত্য কিছুটা শুধু নয়, একেবারেই ভিন্ন।

দুই বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) ও নরওয়ের স্কুল অব ইকোনমিকসের অ্যাপ্লায়েড রিসার্চ একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। সেখানে বলা হয়, দরিদ্র ও ধনী দেশগুলোর মধ্য প্রতিবছর যে আর্থিক বিনিময় হয়, তার তথ্য নিশ্চিতভাবে সবাইকে চমকে দেবে। ২০১২ সালের এক হিসাবে দেখা গেছে, বিনিয়োগ, অনুদান, ঋণসহ বিভিন্ন খাতে উন্নয়নশীল দেশগুলো ধনী দেশগুলো থেকে পেয়েছিল ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন (১ লাখ ৩০ হাজার) ডলার। একই বছর ওই দেশগুলো থেকে ধনী দেশগুলোয় বৈধ-অবৈধ পথে প্রবেশ করেছে ৩ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি। আর ১৯৮০ সালের পর থেকে ওই দেশগুলো থেকে ধনী দেশগুলো বিভিন্নভাবে পেয়েছে ১৬ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি। এর মধ্যে অবৈধ পথে যাওয়া অর্থের পরিমাণ শুনলে চোখ কপালে উঠবে যে কারও। এ অর্থের পরিমাণ ১৩ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার। এ অবৈধ অর্থের অধিকাংশ পাচার হয়েছে ও হচ্ছে ভুয়া চালান দেখিয়ে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের মাধ্যমে। শুধু ২০১২ সালেই উন্নয়নশীল দেশগুলো এ ভুয়া চালানের মাধ্যমে ৭০ হাজার কোটি ডলার পাঠিয়েছিল ধনী দেশগুলোতে, যা ওই বছর তাদের গৃহীত মোট অনুদানের অঙ্ককে ছাড়িয়ে যায়। জিএফআই বলছে, উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রতি ১ ডলার অনুদানের বিপরীতে ধনী দেশগুলোকে বৈধ-অবৈধ পথে দিচ্ছে ২৪ ডলার করে।

অর্থাৎ উন্নয়নের সহযোগী হওয়ার এবং উদারতার যে গল্প ধনী দেশগুলো রাষ্ট্র করে, তা শুধু ভুলই নয়, একেবারে ‘ডাহা মিথ্যা’। নাইজেরিয়ার তেলের খনি থেকে ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম বা দক্ষিণ আফ্রিকার সোনার খনি থেকে পশ্চিমাদের হওয়া মুনাফাই এর সাক্ষ্য দেবে। শুধু জ্বালানি বা প্রাকৃতিক সম্পদের খনির খাতগুলো কেন, সব কটি খাতের সঙ্গে যুক্ত বহুজাতিক কোম্পানিই এ কাজটি করে। ভুয়া চালানের যে কথাটি বলা হয়েছে, তা বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর জন্যও সত্য। এ প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু পণ্য–বাণিজ্যের মাধ্যমেই কাজটি করে না, তারা বিভিন্ন সেবার মাধ্যমেও এ অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার কাজটি করে। আর এটি করা হয় দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রশাসনিক দুর্নীতির সুযোগ নিয়ে। সাধারণ মানুষ এর উপস্থিতি টের পায়, কিন্তু সুনির্দিষ্ট হদিস পায় না। তারা শুধু দেখে দারিদ্র্যের এক অনিঃশেষ চক্র, যা হাজারো উন্নয়নের গল্পেও বদলায় না। তারা দেখে, বাজার তাদের থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে, যার পেছনে ছুটতে ছুটতেই তারা ক্লান্ত হয়ে যায়।

এই ক্লান্ত–বিধ্বস্ত মানুষ মাঝেমধ্যে শুনতে পায়, তাদের দেশকে দারিদ্র্যের বৃত্ত থেকে বের করে আনতে কোনো এক ধনী দেশ সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। ধনী-দরিদ্র সব দেশ অর্থ পাচার রোধে নানা ধরনের পদক্ষেপের কথা প্রতিদিন বলে যায়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রসহ বহু ধনী দেশ ব্যাংকসহ স্বীকৃত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থ পাচার রোধে গৃহীত নীতিগুলো মেনে চলতে বাধ্য করলেও পরামর্শক ও আইনি সংস্থাগুলোকে তেমন কোনো বাধ্যবাধকতায় বাঁধে না। টিকে থাকতে সহায়তা করে কর-স্বর্গ খ্যাত গন্তব্যগুলোকে। এটি তাদের জন্য একটি ছাড়পত্র হিসেবে কাজ করে। আর এই ছাড়পত্র ব্যবহার করেই তারা দুর্বল ও দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোকে শোষণের যন্ত্রটি চালাতে থাকে। আর রাষ্ট্রের নিজের চালানো শোষণ তো রয়েছেই, যার একটি বড় অংশই পরিচালিত হয় বহুজাতিক খনি কোম্পানি ও অস্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দ্বারা। বলার অপেক্ষা রাখে না যে শেষোক্ত এ দুই ধরনের প্রতিষ্ঠানই রাষ্ট্রের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় চলে। এ দিয়েই ধনী দেশগুলো আরও ধনী হয়ে ওঠে, ঠিক যেভাবে রাষ্ট্রের ভেতরে ধনীরা হয়ে ওঠে আরও ধনী। মানুষে মানুষে সম্পদবৈষম্য বৃদ্ধির পন্থাতেই বেড়ে চলে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সম্পদের ব্যবধান।