জাপান: সততাই যার মূল শক্তি

জাপানে সততাভিত্তিক একটা সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। ছবি: রয়টার্স
জাপানে সততাভিত্তিক একটা সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। ছবি: রয়টার্স

‘সততা অমূল্য জিনিস। সস্তা লোকের কাছ থেকে এটি আশা করবেন না।’

মার্কিন ধনকুবের ওয়ারেন এডওয়ার্ড বাফেটের কথাটি ধ্রুব সত্য ধরে নিলে জাপানের মানুষই বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু দরের। তাঁরাই বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান ‘বস্তুটি’র লালন করছেন। তা হলো ‘সততা’।

সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় প্রভাব ও জনবান্ধব পুলিশ কর্মকর্তাদের কারণেই জাপানে সততাভিত্তিক একটা সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে। ব্যক্তিজীবন, সমাজজীবন থেকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সেই সততার ছাপ স্পষ্ট। ফলাফল—দেশটিতে একটা সুন্দর ব্যবস্থার বিনির্মাণ।

যে কারও জন্য হাতব্যাগ হারিয়ে যাওয়াটা ভীষণ ঝামেলাকর। এতে মুঠোফোনের পাশাপাশি ট্রাভেল কার্ড, আইডি কার্ড, ব্যাংক কার্ড খোয়া যায়। নিরন্তর ঝামেলার সৃষ্টি হয়। হাতব্যাগটি ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত এই সমস্যার শেষ নেই। বিশ্বে এমন একটি স্থান আছে, যেখানে হারানো জিনিস ফেরত পাওয়ার প্রায় শতভাগ সম্ভাবনা আছে। জায়গাটি আর কোথাও নয়, টোকিও—জাপানের রাজধানী।

শহরটিতে ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষের বাস। এমন জনবহুল নগরে বছরে লাখ লাখ জিনিস হারিয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। যায়ও। কিন্তু তার বড় একটা অংশ ফেরত পান মালিকেরা। বিষয়টি প্রমাণে ২০১৮ সালের একটা পরিসংখ্যান দেখা যাক। সে বছর টোকিওতে ৫ লাখ ৪৫ হাজার হারিয়ে যাওয়া আইডি কার্ড মালিকদের হাতে তুলে দিয়েছে টোকিওর মেট্রোপলিটন পুলিশ। সংখ্যাটা হারিয়ে যাওয়া মোট আইডি কার্ডের ৭৩ শতাংশ।

ঠিক একইভাবে হারিয়ে যাওয়া ১ লাখ ৩০ হাজার মুঠোফোন (৮৩ শতাংশ) এবং ২ লাখ ৪০ হাজার ওয়ালেট (৬৫ শতাংশ) ফেরত পেয়েছেন এগুলোর মালিকেরা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমনও ঘটেছে, হারিয়ে যাওয়ার দিনই প্রিয় বস্তুটি হাতের মুঠোয় পেয়েছেন তাঁরা। চক্ষু চড়কগাছ হলেও তথ্যটি সত্য।

সম্প্রতি সান ফ্রান্সিসকোর একটি ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের এই শহরের এক বাসিন্দার একটি ওয়ালেট খোয়া যায়। তবে কেউ একজন সেটা পেয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেন। নিউইয়র্কের এসইউএনওয়াই পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের মনোবিদ কাজুকো বেহরেনস ঘটনাটির বর্ণনা দিয়ে বলছিলেন, হারিয়ে যাওয়া জিনিস ফেরত পাওয়ার ঘটনা মার্কিন সমাজে প্রায় দুর্লভ। তাই ওয়ালেটটি যিনি পেয়ে পুলিশে দিয়েছিলেন, তিনি রীতিমতো নায়ক বনে গেলেন। স্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলো তাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়া শুরু করল। তাঁকে নিয়ে করা সংবাদের শিরোনাম দেওয়া হয় ‘সৎ মানুষ’।

বেহরেনসের মাতৃভূমি জাপানে এ ধরনের সততার ঘটনা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। বরং অনেকটাই স্বাভাবিক। জাপানি নাগরিকদের জন্য বিষয়টি এমন—আচ্ছা! (হারানো) জিনিসটি অবশ্যই ফেরত দিতে হবে। বরং জাপানি সমাজে কারওর খোয়া যাওয়া জিনিস ফেরত না দেওয়াটাই একটা অস্বাভাবিক ঘটনা।

এভাবে অন্যের হারিয়ে যাওয়া জিনিস ফেরত দেওয়ার মধ্যে লাভের কিছু আছে কি না, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। জিনিসটি ফেরত দেওয়ার বিনিময়ে পুরস্কারস্বরূপ কিছু অর্থপ্রাপ্তি অথবা জিনিসটি নিজের করে পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি—হতে পারে যে কোনোটি। কিন্তু বাস্তবে জাপানে ঘটে উল্টোটা। ২০১৮ সালে যে মুঠোফোনগুলো ফেরত দেওয়া হয়েছে, তার একটিও সন্ধানদাতাকে দেওয়া হয়নি অথবা রাষ্ট্রও গ্রহণ করেনি। হারিয়ে যাওয়া মুঠোফোনের মধ্যে ১৭ শতাংশের মালিককে পাওয়া যায়নি। এই সেটগুলো ধ্বংস করা হয়েছে।

জাপানের ছোট একটি পুলিশ স্টেশন হলো কোবান। অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে এই স্টেশনের চিত্র আলাদা। যে শহরে যত পুলিশ স্টেশন, সেই শহরে তত নিরাপত্তা। টোকিওতে প্রতি ১০০ বর্গকিলোমিটারে যেখানে ৯৭টি পুলিশ স্টেশন, যেখানে লন্ডনে প্রতি ১০০ বর্গকিলোমিটারে মাত্র ১১টি পুলিশ স্টেশন।

কোবানের পুলিশ কর্মকর্তারা খুবই জনবান্ধব। উচ্ছৃঙ্খল কিশোরদের শাসন কিংবা বয়স্ক লোকজনকে রাস্তা পার হতে সাহায্য করেন তাঁরা। কোবানের পুলিশ নিয়ে কিয়োটো সাঙ্গিয়ো বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিষয়ের অধ্যাপক মাসাহিরো তামুরা বলছিলেন, শিশুরা রাস্তায় কোনো পুলিশ দেখলেই অভিবাদন জানায়। আবার পাশেই কোনো বয়স্ক লোক থাকলে পুলিশ কর্মকর্তারা গিয়ে তাঁর খোঁজ নেন।

তামুরা বলেন, জাপানি সমাজে হারিয়ে যাওয়া জিনিস ফেরত দেওয়ার ব্যাপারটি শিশু বয়সেই শেখানো হয়। অন্যের খোয়া যাওয়া জিনিস—তা মাত্র ১০ ইয়েন (৭ পেনি) হলেও পুলিশ স্টেশনে জমা দেওয়ার বিষয়ে শিশুদের উৎসাহিত করা হয় পরিবার থেকেই। একটি শিশু ১০ ইয়েনের একটি মুদ্রা জমা দিলেও পুলিশ কর্মকর্তারা তা আনুষ্ঠানিকভাবে লিখে রাখেন। রিপোর্ট করে মুদ্রাটি কারাগারে জমা রাখা হয়। পরবর্তী সময়ে কেউ হারিয়ে যাওয়া মুদ্রার বিষয়ে দাবি না করলে তা সন্ধানদাতাকে পুরস্কার হিসেবে দিয়ে দেন পুলিশ কর্তারা।

নিউইয়র্ক ও টোকিওর ওপর চালানো একটি গবেষণার চিত্র তুলে ধরা হলো। গবেষকদের ‘হারিয়ে’ ফেলা ৮৮ শতাংশ মুঠোফোন টোকিওর পুলিশের কাছে জমা পড়েছে। কিন্তু নিউইয়র্কের ক্ষেত্রে চিত্রটা প্রায় বিপরীত। মাত্র ৬ শতাংশ মুঠোফোন জমা পড়েছে পুলিশ স্টেশনে। ঠিক একইভাবে ৮০ শতাংশ ‘হারানো’ ওয়ালেট টোকিওতে এবং মাত্র ১০ শতাংশ ওয়ালেট নিউইয়র্কে ফেরত দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য কারণের মধ্যে শহরে পুলিশ স্টেশন বেশি থাকাটাও এর বড় একটা কারণ।

২০১১ সালে জাপানের উত্তর–পূর্বাঞ্চলে সুনামি আঘাত হানে। তখন অসংখ্য লোক গৃহহীন হয়ে পড়ে। তাদের সঙ্গে খাবার, পানি কিছুই ছিল না। কিন্তু এ রকম একটা পরিস্থিতিতেও জাপানিরা আত্মসংযমের পরিচয় দেন। তাঁরা নিজের চেয়ে অন্যের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেন। এটা বুদ্ধ সম্প্রদায়ের ‘গ্যাম্যান’ মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলেই বেহরেনস মনে করেন, যা ধৈর্য বা সহিষ্ণুতার মতো সাযুজ্যপূর্ণ।

অর্থাৎ নিজের আগে অন্যকে নিয়ে ভাবা। সুনামির সময় গণমাধ্যমের অনেক খবরে দেখা গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে খুবই কম। অথচ এ রকম পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশে ঘটে উল্টোটা। তামুরা বলেন, জাপানিদের চরিত্রের সঙ্গে লুটপাটের মতো অপরাধ যায় না।

২০১১ সালের ভূমিকম্পে ফুকুশিমা পারমাণিবক চুল্লিটি বিকল হয়ে যাওয়ার পর উচ্চ বিকিরণের কারণে এলাকাটিতে টানা কয়েক মাস নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। তখন সেখানে চুরির ঘটনা ঘটে। কারণ, ফুকুশিমায় কেউই ছিলেন না। পুলিশ অথবা অপরাধ দেখে ফেলার মতো কেউ না থাকায় চুরির ঘটনা ঘটে। এই পরিস্থিতিকে ‘হিতো নো মি’ (সমাজের চোখ) ধারণার সঙ্গে তুলনা করেছেন তামুরা। এ ক্ষেত্রে পুলিশের উপস্থিতি না থাকলেও ‘হিতো নো মি’র কারণে চুরির মতো ঘটনা ঘটবে না।

মোটা দাগে বললে পূর্ব এশিয়ার মানুষ ‘সামগ্রিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ’। তাঁরা নিজের আগে অন্যকে প্রাধান্য দেন। ফলে তাঁরা এমন আচরণ লালন করেন, যা পুরো গোষ্ঠীর পক্ষে আসে। তবে এই চেতনা বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে কিছুটা অনুপস্থিত বলে মনে করেন বেহরেনস।

একটি গবেষণায় যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানি মায়েদের কাছে সন্তানদের নিয়ে তাঁদের প্রত্যাশার কথা জানতে চাওয়া হয়। জবাবে জাপানি মায়েদের ভাষ্য ছিল, তাঁরা সন্তানের গড়পড়তা বা স্বাভাবিক জীবন চান। কিন্তু মার্কিন মায়েদের মধ্যে এ ধরনের চাওয়া কখনোই দেখা যাবে না। হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের সব মা তাঁর সন্তানকে আন্তর্জাতিক মহাতারকা বানাতে চান না, কিন্তু তাঁরা জাপানি মায়েদের মতো সন্তানকে নিয়ে সাদামাটা প্রত্যাশাও করেন না।

বেহরেনসের মতে, কোনো না কোনোভাবে গোষ্ঠীগতভাবে টিকে থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ওয়ালেট ফেরত দেওয়ার মতো ভালো একটা কিছু করলে আপনার মনে এই চিন্তাটা জাগবে যে ভবিষ্যতে আপনার ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটতে পারে। অর্থাৎ আপনারও কিছু খোয়া গেলে তা ফেরত পাবেন।

বেহরেনস বলেন, ‘এটা আমি মনেপ্রাণেই বিশ্বাস করি। অন্যের জন্য কিছু একটা করতে পারার মতো সৌন্দর্য আমার ভেতরে লুকিয়ে আছে।’ তিনি বলেন, জাপানে কেউ যখন হারানো কিছু পেয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেন, তখন তাঁর মাঝে তা ফিরে পাওয়ার মানসিকতা কাজ করে না। ব্যক্তিটি সমস্যায় থাকলে অথবা জিনিসটি প্রয়োজনীয় হলেও তা করেন না।

নিউইয়র্ক ও টোকিওতে ওয়ালেট চুরির ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মিশিগান ল স্কুলের অধ্যাপক মার্ক ডি. ওয়েস্ট। জাপানের আইন ও আইনি ব্যবস্থা নিয়ে এই বিশেষজ্ঞের মতে, জাপানি সমাজের আইনকানুন ও মূল্যবোধই দেশটির জনগণের মধ্যে সততা প্রতিষ্ঠা করেছে। সম্ভবত এ কারণেই জাপান এত উন্নত। বিবিসি অবলম্বনে