ভারত সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ শাহিনবাগ

নাগরিকত্ব আইন সংশোধন ও এনআরসির প্রতিবাদে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির শাহিনবাগে টানা দেড় মাস ধরে আন্দোলন চলছে। গত রোববারের বিক্ষোভ।  ছবি: সংগৃহীত
নাগরিকত্ব আইন সংশোধন ও এনআরসির প্রতিবাদে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির শাহিনবাগে টানা দেড় মাস ধরে আন্দোলন চলছে। গত রোববারের বিক্ষোভ। ছবি: সংগৃহীত

দিল্লির শাহিনবাগে এলে চোখের সামনে ভেসে উঠবে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারির ঢাকার শাহবাগ। দাবির ভিন্নতা বাদ দিলে রঙে, রূপে, বর্ণে, চরিত্রে দুই দেশের দুই ‘বাগ’ এক ও একাকার।

শাহবাগ আন্দোলন একটা সময় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশের সরকারের কাছে। কী আশ্চর্য, শাহিনবাগও আজ বিরাট চ্যালেঞ্জ ভারতের সরকারের কাছে! টানা দেড় মাস শাহিনবাগের একদিকের রাস্তা বন্ধ। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বা ‘সিএএ’, যা কিনা এই মুহূর্তে ভারতীয় রাজনীতির প্রধান বিতর্কিত বিষয়, তা প্রত্যাহার ও এনআরসির সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার দাবিতে শাহিনবাগের বিক্ষুব্ধ অথচ শান্তিপূর্ণ সত্যাগ্রহের মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় সরকার নাজেহাল।

এত দিন ধরে সরকার সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। আজ এই মুহূর্তে, রাজধানী দিল্লি যখন নির্বাচনী উত্তেজনায় খইফোটা ফুটছে, শাহিনবাগকে হাতিয়ার করে শাসক বিজেপি তখন ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে। রাজ্যের শাসক দল আম আদমি পার্টিকে শেষ মুহূর্তে তারা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে শাহিনবাগকে ইস্যু করে। আম আদমি পার্টির সম্ভাব্য বিজয় রথ বিজেপি রুখতে পারবে কি না পরের কথা, আপাতত এটুকু বলা যায়, এবারের এই লড়াইয়ে বিজেপির একমাত্র অবলম্বন শাহিনবাগ।

শাসক দলের নেতারা বলতে দ্বিধা করছেন না, আগামী ৮ ফেব্রুয়ারির বিধানসভার ভোট মিটে গেলে হাজার হাজার মানুষের এই প্রতিবাদ বিক্ষোভ তাঁরা তুলে দেবেন। ভালোয় ভালোয় রাস্তা খালি করলে ভালো, নইলে বলপ্রয়োগে পিছু হটবে না পুলিশ।

কারণ, শাসক বিজেপির চোখে শাহিনবাগ আন্দোলন দেশদ্রোহেরই নামান্তর!

কেন দেশদ্রোহ? বিজেপির ব্যাখ্যায়, এই শাহিনবাগ ‘টুকরে টুকরে গ্যাংয়ের’ নিরাপদ আশ্রয়। কেননা, এই সমাবেশ থেকে ‘আজাদির’ স্লোগান উঠছে। এখানে যাঁরা জ্বালাময়ী ভাষণ দিচ্ছেন, তাঁরা দেশকে টুকরো টুকরো করতে চাইছেন। সিএএ ও এনআরসির বিরুদ্ধে দেশের আনাচকানাচে যখন বিক্ষোভ সমাবেশ শুরু হয়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তখনই জানিয়েছিলেন, কারা ক্ষুব্ধ তা তাঁদের পোশাক থেকেই পরিষ্কার। সেই তখন থেকে সিএএ ও এনআরসিকে শাসক দল মুসলমান–বিরোধিতার অনুঘটক করে তুলতে চেয়েছে। আজ তা প্রকট থেকে প্রকটতর। বিজেপির কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর ‘দেশদ্রোহীদের গুলি করে মারার’ হুংকার যেভাবে শুনিয়েছেন (গুলি চলেওছে জামিয়া মিলিয়ার সামনে), ওই দলেরই দিল্লির সাংসদ পরবেশ সিং ভার্মা যে ভাষায় বলেছেন, এখনই সতর্ক না হলে এই শাহিনবাগের লোকজন ‘ঘরে ঘরে ঢুকে মা–বোনদের ধর্ষণ করবে এবং তখন নরেন্দ্র মোদি–অমিত শাহরা বাঁচাতে পারবেন না’, তাতে স্পষ্ট, শাহিনবাগকে হাতিয়ার করে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠের মেরুকরণে সচেষ্ট। তারা নিশ্চিত, একমাত্র এই কৌশলই পারবে দিল্লি বিধানসভার ভোটে আম আদমি পার্টির মোকাবিলা করতে।

>

বিজেপির চোখে শাহিনবাগের আন্দোলন দেশদ্রোহেরই নামান্তর। বিধানসভা ভোটের পর ব্যবস্থা।

অতিদ্রুত বিজেপি তাই তাদের কৌশল বদলে ফেলেছে। নরেন্দ্র মোদির ভাষণ দিয়ে দিল্লির প্রচার শুরু হয়েছিল। রামলীলা ময়দানের সেই জমায়েতে তাঁর হাতিয়ার ছিল দিল্লির বেআইনি কলোনিগুলোর ৪০ লাখ পরিবারের আইনি মর্যাদা দেওয়ার কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত। ওটাই বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে কেজরিওয়ালরা যখন চ্যালেঞ্জ করে জানান, বিজেপির দাবি ও বাস্তবের মধ্যে অমিল কতটা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, উন্নয়ন সম্পর্কিত আম আদমি পার্টির দাবির ‘অসারত্ব’ প্রমাণে ভুল তথ্য দাখিল করে বিজেপি যখন হাস্যাস্পদ হয়ে উঠছে, হাতে যখন আর কোনো অস্ত্র বা ইস্যু নেই, তখনই তারা আঁকড়ে ধরে শাহিনবাগকে।

বিজেপি নেমে এসেছে সেই বহু চেনা ছকে। সেই ছক যা হিন্দু–মুসলমানে বিভক্ত, যা হিন্দুস্তান–পাকিস্তানে বিভাজিত, যা দেশপ্রেম–দেশদ্রোহে মোড়া হিন্দু জাতীয়তাবাদের ধ্বজাধারী! 

আম আদমি পার্টি যে তা বুঝছে না তা নয়। বুঝেছে বলেই মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল অথবা তাঁর ডেপুটি মনীশ সিসোদিয়া কিংবা অন্য কেউ শাহিনবাগের চৌহদ্দি মাড়াচ্ছেন না। তাঁদের প্রচারে সিএএ বা এনআরসি অনুচ্চারিত। অথচ, সংসদে তাঁরা ওই বিলের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলেন। কেজরিওয়ালরা ভোট চাইছেন স্রেফ তাঁদের কাজের নিরিখে। তাঁরা জানেন, বিজেপির চেনা ছকে পা দেওয়ার অর্থ দিল্লিবাসীকে হিন্দু–মুসলমানে ভাগ করে দেওয়া।

ভোটের বাকি আর মাত্রই এক সপ্তাহ। আগে ঠিক ছিল, রামলীলা ময়দানের উদ্বোধনী ভাষণ ছাড়া নরেন্দ্র মোদি চারটি জনসভায় ভাষণ দেবেন। লড়াইটা অসম বুঝে মোদিকে বেশি ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নেয় বিজেপি। এখন তিনি ভাষণ দেবেন মাত্র দুটি স্থানে। মূল দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। কদিন ধরে বিজেপির প্রচার শুধুই শাহিনবাগময়। ওই তল্লাটের মানুষজনকে কীভাবে দৈনিক যানজটের মুখে পড়তে হচ্ছে, কী প্রাণান্তকর পরিস্থিতির মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে এবং এভাবে চললে ‘হিন্দুস্তানের হিন্দুদের কীভাবে একদিন নিজভূমে পরবাসী হতে হবে’, বিজেপি নেতাদের মুখে স্রেফ তারই সাতকাহন!

বুধবার সন্ধ্যায় শাহিনবাগের জমায়েতকে প্রশ্ন করা হয়, সরকার বলছে দেশের কোনো নাগরিক নাগরিকত্বের অধিকার হারাবেন না। সিএএ নাগরিকত্ব কাড়ার জন্য নয়, দেওয়ার জন্য করা। তাহলে কেন এই বিক্ষোভ সমাবেশ? জমায়েতের জবাব, সিএএ ও এনআরসি পৃথক নয়। সিএএ বিদেশি অমুসলমানদের নাগরিকত্ব দেবে, এনআরসি দেশি মুসলমান গরিব নাগরিকদের বিদেশি বলে চিহ্নিত করবে। মারা পড়বে তারাই, যারা গরিব, যারা দুর্বল, প্রাণটুকু ছাড়া যাদের অন্য কিছু সম্বল নেই।

সরকার ও নাগরিকদের একাংশের মধ্যে ‘ট্রাস্ট ডেফিসিট’ বা বিশ্বাসের ঘাটতিই দেশের কোণে কোণে গজিয়ে ওঠা শাহিনবাগগুলোয় বিচ্ছুরিত। দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হয়ে ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’–এর সঙ্গে নরেন্দ্র মোদি ‘সবকা বিশ্বাস’ জুড়ে দিয়েছিলেন। সিএএ ও এনআরসির বিরুদ্ধে শাহিনবাগের আন্দোলন বিশ্বাসের সেই ঘাটতিরই প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।