ভারতের চমকহীন বাজেটে নির্মলার রেকর্ড

টেলিভিশনে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের বাজেট বক্তৃতা শুনছেন এক নারী। মুম্বাই, ভারত, ০২ ফেব্রুয়ারি। ছবি: এএফপি
টেলিভিশনে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের বাজেট বক্তৃতা শুনছেন এক নারী। মুম্বাই, ভারত, ০২ ফেব্রুয়ারি। ছবি: এএফপি

ভারতের বেহাল অর্থনীতির হাল ফেরাতে বাজেট নিয়ে আগ্রহ ছিল কেন্দ্রে। অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন সেই আগ্রহের নিরসনে এমন কিছু চমক দিতে পারলেন না। কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর স্বার্থে পাঁচ বছরে বিভিন্ন প্রকল্পে যে ১০০ লাখ কোটি রুপি লগ্নির ঘোষণা করেছিলেন, নির্মলা তার ওপরেই বাজি ধরতে চেয়েছেন। এর বাইরে আজ শনিবার লোকসভায় পেশ করা তাঁর বাজেট সেই অর্থে ছিল চমকহীন।

তবে নিজের তৈরি রেকর্ড নির্মলা নিজেই ভেঙেছেন। গতবার ২ ঘণ্টা ১৭ মিনিট ধরে বাজেট ভাষণ দিয়ে রেকর্ড করেছিলেন। শনিবার ২ ঘণ্টা ৪১ মিনিট কাবার করে দিলেও তিনি ভাষণ শেষ করতে পারেননি। নিজের রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড তৈরি করেও শ্রান্তি ও ক্লান্তির দরুন শেষ দুই পৃষ্ঠা পাঠ না করে তিনি স্পিকারের অনুমতি নিয়ে বসে পড়েন। অসুস্থ অর্থমন্ত্রীর ভাষণের শেষ ওখানেই। সঙ্গে সঙ্গে উঠে আসে দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে একরাশ প্রশ্ন।

আগের দিন শুক্রবারই প্রকাশিত হয়েছে আগামী অর্থবর্ষের অর্থনৈতিক সমীক্ষা। বিশ্বব্যাপী মন্দার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভারতের অর্থনীতির অধোগমন অব্যাহত রয়েছে। বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার কমতে কমতে তা ৩ শতাংশের কাছাকাছি দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থায় অর্থনৈতিক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, আগামী অর্থবর্ষে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৬ থেকে সাড়ে ৬ শতাংশ হারে হবে। অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে চাহিদা বৃদ্ধি প্রয়োজন। প্রয়োজন সাধারণ মানুষের হাতে টাকার জোগান বাড়ানো। সে জন্য কৃষিক্ষেত্রের দিকে বিশেষ নজর দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা অর্থনীতিবিদেরা বারবার বলে এসেছেন। নির্মলার বাজেটেও তা প্রাধান্য পেয়েছে। বাজেট ভাষণে কৃষি ও কৃষকের স্বার্থে ১৬টি নতুন পরিকল্পনার কথা তিনি ঘোষণা করেছেন। বরাদ্দ করেছেন ২ লাখ ৮৩ হাজার কোটি টাকা। বলেছেন, ২০২২ সালের মধ্যে কৃষি আয় দ্বিগুণ করতে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কৃষক যাতে উৎপাদিত ফসল সহজে বাজারজাত করতে পারেন, কৃষিঋণ যাতে সহজলভ্য হয়, হিমঘরে ফসল সংরক্ষণ করা যায় এবং কোল্ড সাপ্লাই চেন যাতে গড়ে তোলা যায়, সে জন্য বিশেষ নজর দেওয়া হবে। কৃষিজাত পণ্য বাজারজাত করতে কৃষি রেল চালানোর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু উৎপাদন শিল্পের হাল কীভাবে ফিরবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা বাজেট থেকে পাওয়া গেল না।

অর্থনৈতিক সংকটের মারাত্মক প্রতিফলন ঘটেছে কাজের বাজারে। কর্মসংস্থান দিন দিন কমে যাচ্ছে। কীভাবে তা ঠেকানো যাবে, তার কোনো দিশাও নির্মলা সীতারামন দেখাতে পারেননি। বিরোধীরা তাই বলেছেন, দীর্ঘতম বাজেট ভাষণ ও পর্বতের মুষিক প্রসব সমার্থক।

প্রতিবছরেই বাজেটে চাকরিজীবী মধ্যবিত্ত বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে তাকিয়ে থাকে। এবারেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। নির্মলা সীতারামন কর কাঠামোয় বিন্যাস ঘটিয়ে আয়করে সামান্য ছাড় দেওয়ার পাশাপাশি তুলে নিয়েছেন বিভিন্ন ছাড়। পুরোনো কাঠামোর বিন্যাস ছিল ৫ লাখ পর্যন্ত আয়ে ৫ শতাংশ হারে কর। নতুন ব্যবস্থায় তা অপরিবর্তিত। ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা আয়ের ক্ষেত্রে কর ছিল ১০ শতাংশ। ১০ থেকে ২০ লাখ ২০ শতাংশ। ২০ লাখের বেশি আয় হলে আয়কর ৩০ শতাংশ। নতুন বিন্যাসে কর প্রস্তাব হলো, ৫ থেকে সাড়ে ৭ লাখ পর্যন্ত ১০ শতাংশ, সাড়ে ৭ থেকে ১০ লাখ ১৫ শতাংশ। ১০ থেকে সাড়ে ১২ লাখ ২০ শতাংশ। সাড়ে ১২ থেকে ১৫ লাখ ২৫ শতাংশ। ১৫ লাখের বেশি ৩৫ শতাংশ। নতুন এই ব্যবস্থায় কর দিলে পুরোনো ব্যবস্থার করছাড়গুলো নেওয়া যাবে না। সেই সুবিধা নিতে গেলে পুরোনো ব্যবস্থায় কর দিতে হবে। নির্মলার এই ‘সুরাহা’ হলো ডান হাতে দিয়ে বাঁ হাতে কেড়ে নেওয়া।

নির্মলার এই ঘোষণা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা জীবনবিমা করপোরেশনের (এলআইসি) চিন্তা বাড়িয়েছে। এলআইসি পলিসি কিনলে আয়করে ছাড় পাওয়া যেত। নতুন কর বিন্যাসে সেই সুযোগ থাকবে না। পাশাপাশি দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা সংস্থার অংশীদারত্বের একটা অংশ বিক্রি করার প্রস্তাব বাজেটে রাখা হয়েছে। এই দুইয়ের ধাক্কা কীভাবে এলআইসি সামলাবে, সেই প্রশ্ন উঠে গেছে। বিলগ্নীকরণের পথে সরকারের এই হাঁটা শেষ পর্যন্ত মানুষ কীভাবে গ্রহণ করবে, তা আগ্রহ বাড়াচ্ছে।

দেশের বেশ কয়েকটি বেসরকারি সমবায় ব্যাংক সমস্যার মধ্যে রয়েছে। পাঞ্জাব অ্যান্ড মহারাষ্ট্র কো–অপারেটিভ (পিএমসি) ব্যাংক সম্প্রতি লাটে উঠেছে। আমানতকারীদের অর্থ নষ্ট হয়েছে। এত দিন ব্যাংক আমানত বিমার পরিমাণ ছিল এক লাখ টাকা। ব্যাংক লাটে উঠলে ওই টাকা ফেরত পাওয়া যেত। নির্মলা সেই পরিমাণ বাড়িয়ে ৫ লাখ করেছেন।

বাজেট ভালো হলো না খারাপ, অর্থনীতির পক্ষে আশাব্যঞ্জক না হতাশার, শেয়ারবাজারে প্রতিবছরই তার প্রতিফলন ঘটে। নির্মলা সীতারামনের এই দীর্ঘতম বাজেট শেয়ারবাজারকে বিপুল হতাশায় ডুবিয়ে দিয়েছে। সেনসেক্স পড়ে যায় ১ হাজার পয়েন্ট, নিফটি ৩০০ পয়েন্টেরও বেশি। ভাষণ শেষ হওয়ার আগেই অসুস্থ বোধ করা অর্থমন্ত্রীর অসমাপ্ত বাজেট প্রস্তাব অর্থনীতিকে সুস্থ করতে পারবে কি না, সেই প্রশ্নই বড় হয়ে দেখা দিল।