জাপানি অর্থনীতিতে চীনের করোনার আতঙ্ক

করোনাভাইরাস। প্রতীকী ছবি
করোনাভাইরাস। প্রতীকী ছবি

চীনে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়ে গেলেও জাপানে এ পর্যন্ত শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা মাত্র ২০। অন্যদিকে, চীনে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ৪২৫ জনের মারা গেলেও জাপানে এখন পর্যন্ত কেউ প্রাণ হারায়নি।

রোগের বিস্তার রোধে জাপানের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ দেশের বিভিন্ন বিমান ও সমুদ্রবন্দরে, বিশেষ করে চীন থেকে আসা যাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা কঠোর করে হয়েছে। দেশের নাগরিকদের প্রতিও বাইরে থেকে ফিরে এসে নিয়মিতভাবে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলার পাশাপাশি জনবহুল জায়গাগুলোয় সার্জিক্যাল মাস্ক ব্যবহার করে চলাফেরা করার মতো সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তবে এসব পদক্ষেপ সত্ত্বেও করোনাভাইরাস পরোক্ষে জাপানের ওপর আঘাত হেনে চলেছে। সেই আঘাত মানবদেহে রোগ সংক্রমিত হওয়ার মতো আঘাত তেমন বেশি না হলেও দেশের অর্থনীতির ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে।

দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক মতপার্থক্য ও ভূখণ্ডগত বিরোধ চলতে থাকা সত্ত্বেও জাপানের অর্থনীতি সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অনেকাংশেই চীনের নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। চীন হচ্ছে জাপানের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। জাপানের অনেক কোম্পানির চীনে কারখানা আছে, যেখানে তৈরি পণ্য কেবল জাপানেই ফিরে আসছে তা নয়, অন্যান্য দেশেও রপ্তানি হচ্ছে। এর বাইরে জাপানের পর্যটন খাতের ৮০ শতাংশের বেশি চীনের ওপর নির্ভরশীল। চীন থেকে আসা পর্যটকের স্রোত সজীব রাখছে জাপানের ভোগ্যপণ্য ও হোটেল ব্যবসা। কিন্তু করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় সব কটি খাত এখন সংকটের মুখে।

চীন সরকার নববর্ষের ছুটিতে দেশের নাগরিকদের গ্রুপ ট্যুরে বিদেশে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করায় গত মাসের শেষ দিক থেকে শুরু করে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত জাপানের হোটেলগুলোয় বুকিং বাতিল করে দেওয়ার হার দাঁড়িয়েছে স্থানবিশেষে ৬০ থেকে ৮০ শতাংশের কাছাকাছি। জাপানের ট্রাভেল এজেন্টদের সমিতি জাটার এক হিসাবে বলা হয়েছে, প্রায় ৪ লাখ চীনা পর্যটক জাপান ভ্রমণের পরিকল্পনা বাতিল করেছেন। এই সিদ্ধান্ত হোটেল ব্যবসার ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে।

চীনে করোনাভাইরাস সংক্রমণে জাপানের হোটেল ব্যবসাই যে কেবল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা নয়, জাপানের বনেদি অনেক ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের বিক্রিও এ কারণে প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে। দেশের প্রধান তিনটি ডিপার্টমেন্ট স্টোর দাইমারু-মাৎসুজাকাইয়া, তাকাশিমায়া এবং মিৎসুকোশি-ইসেতানের প্রায় ৮০ শতাংশ ক্রেতা হচ্ছে চীন থেকে আসা পর্যটক। জাপানের পর্যটন এজেন্সির দেওয়া হিসাব অনুযায়ী ২০১৯ সালে চীনা পর্যটকেরা কেনাকাটায় খরচ করেছিলেন ১ হাজার ৬৪০ কোটি ডলার, যার একটি বড় অংশ ছিল চীনা নববর্ষের ছুটির সময়ের কেনাকাটা।

চীন সরকারের আরোপিত ভ্রমণনিষেধাজ্ঞা ছয় মাস ধরে বহাল থাকলে জাপানের ভোগ্যপণ্য বাজার ও হোটেল ব্যবসার ওপর ক্ষতিকর যে প্রভাব ফেলবে, অর্থের অঙ্কে তার হিসাব ধরা হয়েছে আনুমানিক ২৯ হাজার ৫০০ কোটি ইয়েন। কিছু কিছু গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মতে নেতিবাচক এই ধারা জাপানের প্রবৃদ্ধির হারকে শূন্য দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ কমিয়ে দিতে পারে।

চীনা পর্যটকদের আগমন হ্রাস এবং করোনাভাইরাস নিয়ে দেখা দেওয়া আতঙ্ক জাপানের বিমান পরিবহন খাতেরও ক্ষতি করছে। দেশের প্রধান দুই বিমান কোম্পানি জাপান এয়ারলাইনস ও অল নিপ্পন এয়ারওয়েজ চীনের বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়া বিমানের ফ্লাইটসংখ্যা যথেষ্ট মিয়ে দিয়েছে। জাপান এয়ারলাইনস স্বাভাবিক সময়ে চীনের বিভিন্ন গন্তব্যে সপ্তাহে ৯৮টি ফ্লাইট চালু রেখেছিল। সেই সংখ্যা এখন দাঁড়িয়েছে ৪৩–এ। অল নিপ্পন এয়ারওয়েজও চীনে চলাচল করা বিমানের ফ্লাইটসংখ্যা প্রায় অর্ধেক হ্রাস করেছে। করোনাভাইরাসের বিস্তার শুরু হওয়ার আগে টোকিওর হানেদা বিমানবন্দর থেকে কোম্পানির সপ্তাহে ১৪টি ফ্লাইট বেইজিংয়ে চলাচল করছিল। সেই সংখ্যা এখন সাতে নেমে এনেছে।

জাপানের শিল্প খাতও করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকেনি। বিশেষ করে জাপানের মোটরগাড়ি উৎপাদকেরা চীনের সম্প্রসারিত বাজারের সুযোগ গ্রহণ করতে সারা দেশে বেশ কিছু কারখানা তৈরি করে নেয়। এর অনেকগুলোই এখন নববর্ষের ছুটির পরেও বর্ধিত সময়ের জন্য বন্ধ রাখতে হচ্ছে। অন্যদিকে, জাপানি বিশেষজ্ঞদের অনেকে দেশে ফিরে আসায় চালু কারখানাগুলোয়ও উৎপাদনপ্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে।

অন্যদিকে, জাপানের ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের যেসব কোম্পানি চীনে কারখানা তৈরি করে, সেখানে উৎপাদিত পণ্য জাপানের বাজারে বিক্রি করছে, এদের অনেকেই ঝুঁকি উপেক্ষা করে কারখানা চালু রাখছে। তবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আরও বিস্তৃত হলে এসব প্রতিষ্ঠানকেও উৎপাদনপ্রক্রিয়া সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিতে হতে পারে।

ফলে জাপানে করোনাভাইরাস এখন পর্যন্ত সেভাবে ছড়িয়ে না পড়লেও এর পরোক্ষ প্রভাব থেকে দেশটি মুক্ত থাকতে পারেনি।