কেজরিওয়াল না মোদি-অমিত, শনিবারই ফয়সালা

অরবিন্দ কেজরিওয়াল । রয়টার্স ফাইল ছবি
অরবিন্দ কেজরিওয়াল । রয়টার্স ফাইল ছবি

প্রায় দেড় কোটি মানুষ শনিবার ঠিক করবেন, তাঁরা নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহদের বেঁধে দেওয়া জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের সুরে গলা মেলাবেন, নাকি গত পাঁচ বছরের কাজের খতিয়ান দেখে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টির ওপর আরও একবার ভরসা রাখবেন। শনিবারই ঠিক হয়ে যাবে, দিল্লি তো বটেই, ভারতীয় রাজনীতিও অতঃপর কোন খাতে বইবে।

বিধানসভার নির্বাচন নিয়ে এমন খই ফোটা উত্তেজনা আগে কখনো দেখেনি রাজধানীবাসী। অথচ জানুয়ারি মাসের গোড়ায় রামলীলা ময়দানে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের মধ্য দিয়ে রাজ্য বিজেপি ভোটের প্রচারের যে সূচনা করেছিল, পরবর্তী সময়ে তার রং যে এভাবে বদলে যাবে, তার বিন্দুমাত্র ইঙ্গিতও সেদিন ছিল না। সেদিন প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে ছিল উন্নয়ন ও নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্যের কথা। দেশের মতো দিল্লিকেও বদলানোর অঙ্গীকার। ঘরে ঘরে স্বচ্ছ পানীয় জল দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। দেখিয়েছিলেন উন্নততর জীবনযাপনের স্বপ্ন। তত দিনে সংশোধিত নাগরিকত্ব বিল আইনে পরিণত হয়েছে। সিএএ ও এনআরসি প্রত্যাহারের দাবিতে শাহিনবাগে স্থানীয় জনতা উদ্বেগ নিয়ে বসেও পড়েছেন। অথচ প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে তার প্রতিফলন দেখা যায়নি। বরং, ঘোষিত নীতি থেকে বেশ কিছুটা পিছু হেঁটে সেদিন তিনি জানিয়েছিলেন, এনআরসি নিয়ে সরকারে কোনো আলোচনাই হয়নি। ‘বিদেশিদের’ জন্য কোনো রাজ্যে একটাও বন্দিশিবির তৈরি হচ্ছে না!

দিন পনেরোর মধ্যে প্রচারের সেই ঢং যে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যাবে, বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের নেতাদের কণ্ঠ যে এভাবে বিষোদ্‌গার করবে, দিল্লি তো বটেই, গোটা দেশকেও যে তাঁরা দেশপ্রেমিক ও দেশদ্রোহীদের শিবিরে বণ্টন করে দেবেন, তা ঘুণাক্ষরেও কেউ টের পাননি। আজ ক্ষুরধার ভোটের প্রচার শেষে দিল্লিবাসী যখন জিরোচ্ছেন, আগামী পাঁচটা বছর কার হাতে নিজেদের সমর্পণ করবেন ভাবছেন, চূড়ান্ত এক সাসপেন্স তখন এই রাজধানী-রাজ্যকে কুয়াশার মতো ছেয়ে রেখেছে। কেজরিওয়ালের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, সড়ক, পানি, সুরক্ষা, প্রান্তিক মানুষজনের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় সুরাহা এবং সুশাসন প্রাধান্য পাবে, নাকি শাহিনবাগ ও তার মদদদার ‘টুকরে টুকরে গ্যাংকে’ উচিত শিক্ষা দিতে মানুষ ঋজু হয়ে দাঁড়াবে, এই মুহূর্তে সেই মোক্ষম প্রশ্নটাই বড় হয়ে ঝুলে রয়েছে।

এবারের দিল্লি বিধানসভার ভোটের তাৎপর্য এটাই। এই ভোট গুরুত্বপূর্ণ কারণ, ভোটের ফল ঠিক করে দেবে ভারতের রাজনীতি, তা সে কেন্দ্রীয় বা রাজ্যস্তর, যে রকমই হোক, মোদি-শাহর বেঁধে দেওয়া ছকে পা মেলাবে কি না।

তা যদি হয়, অরবিন্দ কেজরিওয়ালের জন্য অবশ্যই তা হৃদয়বিদারক হবে। আন্না হাজারের দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন থেকে জন্ম নেওয়া উচ্চাকাঙ্ক্ষী এই আমলা সরকারি স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে রাজনীতিতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন নতুন কিছু একটা করে দেখাবেন বলে। প্রাথমিক জড়তা ও খামখেয়ালিপনা ছেড়ে, পায়ে-পা লাগিয়ে ঝগড়া করার বদভ্যাস ত্যাগ করে ক্রমেই তিনি নিজেকে শুধরেছেন। নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক আদর্শ তাঁর নেই। কিন্তু মোটামুটি স্বচ্ছ প্রশাসন ও প্রান্তিক মানুষজনের জন্য কিছু একটা করার বাসনা ক্রমেই তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রবল প্রতাপান্বিত বিজেপির বিরোধিতা তিনি করছেন তাঁর স্টাইলে। সেই স্টাইল তাঁকে বিজেপিবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করলেও সচেতনভাবে নিজেকে তিনি কংগ্রেস ও বামদের শিবিরের বন্ধু করে তোলেননি।

এই প্রথমবার তিনি ভোটে লড়ছেন বেশ বুদ্ধি খাটিয়ে। সংখ্যালঘু মুসলমানের ভোট তাঁর দিকে আসবেই তিনি জানেন। একবারের জন্যও তাই তিনি সিএএ-এনআরসিকে তাঁর প্রচারের হাতিয়ার করেননি। ভুলেও মাড়াননি শাহিনবাগের পথ। বিজেপির জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের ন্যারেটিভের মোকাবিলায় অন্যান্য বিরোধী স্রোতে গা না ভাসিয়ে তিনি শোকেস করেছেন তাঁর পাঁচ বছরের সাফল্যের খতিয়ান। জোর গলায় তাই তিনি বলতে পারছেন, ‘গত সত্তর বছরে এই প্রথমবার কোনো সরকার তার কাজের খতিয়ান দেখে ভোট চাইছে। ভারতে এমন ভোট এই প্রথম।’

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। রয়টার্স ফাইল ছবি
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। রয়টার্স ফাইল ছবি

কেজরিওয়ালের এই দাবি কণামাত্র অসত্য নয়। মাসাধিককাল ধরে ভোটের প্রচারে কারও বিরুদ্ধে তিনি গালমন্দ করেননি। একবারও কোনো কুকথা নয়। বিজেপির নেতারা তাঁকে ‘টেররিস্ট’ বলেছেন। প্রত্যুত্তরে জনতাকে তিনি বলেছেন, ‘আপনারা আমাকে সন্ত্রাসবাদী মনে করলে ভোট দেবেন না। ভোট দেওয়ার আগে ভেবে দেখুন, আমি সন্ত্রাসবাদী, নাকি আপনাদের সন্তান।’এই প্রথমবার কোনো জননেতা প্রকাশ্যে সরাসরি বিরোধীদের ভোট চেয়ে আবেদন করলেন। বিজেপি কিংবা কংগ্রেসের সদস্য-সমর্থকদের উদ্দেশে কেজরিওয়াল বলেছেন, ‘আপনাদের দল ছাড়তে বলব না। কিন্তু এবার অন্তত আমাদের ভোট দিন। কারণ, পাঁচ বছরে দিল্লির স্কুল ও হাসপাতালগুলোয় আমরা অনেক কাজ করেছি। হাল বদলে দিয়েছি। আমরা না থাকলে সেগুলো ফের বেহাল হয়ে যাবে।’

কেজরিওয়ালের এই আবেদনের মোকাবিলা যে কঠিনস্য কঠিন, মাঠে নেমে মোদি-শাহর তা বুঝতে দেরি হয়নি। উন্নয়ন ও কাজের নিরিখে লড়াই যে অসম, সেই বোধোদয়েরও বিলম্ব হয়নি। শাহিনবাগকে তাই তাঁরা আঁকড়ে ধরেছেন। চেনা আঙিনায় টেনে আনতে চেয়েছেন নির্বাচনী ন্যারেটিভ। দিল্লি তাঁদের কাছে ক্ষমতার প্রতীক। দেশের শাসকের কাছে দিল্লি অধরা থাকাটা যে নিতান্তই অসম্মানের। অপমানের।

সাত বছর আগে ২০১৩ সালে দিল্লিতে কেজরিওয়ালের উদয় হয়েছিল। টানা ১৫ বছরের কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিতকে হারিয়েছিলেন কেজরিওয়াল। ৭০ আসনের মধ্যে ৩১টি পেয়ে বিজেপি একক গরিষ্ঠ দল হলেও সরকার গঠনে তারা রাজি হয়নি। ২৮টি আসন পেয়েছিল আম আদমি পার্টি। কংগ্রেস পায় ৮টি। শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসের সমর্থনে সরকার গড়েন কেজরিওয়াল। মাত্র ৪৯ দিন স্থায়ী হয়েছিল তাঁর প্রথমবারের সরকারের পরমায়ু।

দ্বিতীয় দফায় তাঁকে আর হোঁচট খেতে হয়নি। ৬৭ আসন জিতে তিনি ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। বিজেপি পেয়েছিল বাকি তিনটি আসন। ইতিহাস রচেছিল কংগ্রেসও। ১০ শতাংশেরও কম ভোট ও শূন্য আসন পেয়ে কংগ্রেসের মুখ লজ্জায় লাল হয়েছিল। সেই ধাক্কা গত পাঁচ বছরে কংগ্রেস সামলে উঠতে পারেনি। এবারও শতাব্দী প্রাচীন এই দল হীনবল। তৃতীয় শক্তি তারাই। সম্ভবত অকিঞ্চিৎকরও।

ভারত-পাকিস্তান, দেশপ্রেম-দেশদ্রোহ, হিন্দু-মুসলমান, ৩৭০ অনুচ্ছেদ অথবা রাম মন্দিরের অমোঘ চক্রে বনবন ঘোরা, নাকি নাগরিক স্বস্তি ও স্বাচ্ছন্দ্যের বিষয়গুলো অঙ্গরাজ্যের শাসকের কাছে মুখ্য হওয়া উচিত, দিল্লিবাসী রাত পোহালে তা স্থির করবেন। সেই সাসপেন্সেই কাটতে চলেছে শুক্রবারের দিন ও রাতটুকু।