দিল্লিতে কেজরিওয়ালের হ্যাটট্রিকের আভাস

দিল্লি বিধানসভার ভোটশেষে বুথফেরত জরিপ আভাস দিচ্ছে, আবারও ক্ষমতায় ফিরছেন আম আদমি পার্টির নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল। ছবি: এএফপি
দিল্লি বিধানসভার ভোটশেষে বুথফেরত জরিপ আভাস দিচ্ছে, আবারও ক্ষমতায় ফিরছেন আম আদমি পার্টির নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল। ছবি: এএফপি


অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নেতৃত্বাধীন আম আদমি পার্টি (এএপি) ভারতের দিল্লিতে তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় বসতে পারে। আজ শনিবার ৭০ আসনের দিল্লি বিধানসভার ভোট গ্রহণ করা হয়। ভোট গ্রহণের পরই শুরু হয় বুথফেরত জরিপ বা এক্সিট পোল। ভোট শেষে যতগুলো বুথফেরত সমীক্ষার ফল জানা গেছে, প্রতিটিই বলেছে, এবারও সরকার গড়ছে আম আদমি পার্টি।

জরিপ অনুযায়ী ৭০ আসনবিশিষ্ট বিধানসভায় আম আদমি পার্টি সবচেয়ে কম হলে ৪০টি আসন পাবে, সবচেয়ে বেশি হলে পাবে ৬১টি। বিজেপি, যারা গত নির্বাচনে মাত্র ৩টি আসন জিতেছিল এবং ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের নিরিখে ৫৯টি বিধানসভায় এগিয়ে ছিল, তারা এবারের বুথ ফেরত সমীক্ষায় ১০ থেকে ২৬টি আসন পেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। কংগ্রেসের ঝুলিতে খুব বেশি হলে এবার ১ থেকে ৩টি আসন আসতে পারে বলে কোনো কোনো সমীক্ষা মনে করছে।

এর অর্থ, সমর্থন কমলেও আম আদমি পার্টি তৃতীয়বারের মতো দিল্লির ভাগ্য নিয়ন্ত্রক হতে চলেছে। এবং সেই নিরিখে কেজরিওয়াল ছুঁয়ে ফেলবেন কংগ্রেসের শীলা দীক্ষিতের তিনবার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার রেকর্ড। সমীক্ষা অনুযায়ী, দিল্লির ৭০ বিধানসভা কেন্দ্রে ছয় মাস আগেও যাঁরা প্রধানমন্ত্রী পদে নরেন্দ্র মোদিকে বেছে নিয়েছিলেন, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁরাই ভরসা রেখেছেন অরবিন্দ কেজরিওয়ালের ওপর। এবং তার একমাত্র কারণ নাগরিক পরিষেবা।

পাঁচ বছর আগের বিধানসভা নির্বাচনে ভোটের হার ছিল ৬৭ শতাংশেরও বেশি। সেই বিপুল সমর্থন ভরিয়ে দিয়েছিল আম আদমি পার্টির ঝুলি। ৭০টির মধ্যে ৬৭ আসন জিতে সরকার গড়েছিলেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। কিন্তু আজ সকাল থেকেই ভোটের হার ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক কম। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত আগেরবারের তুলনায় ভোটের ফারাক দাঁড়ায় ২০ শতাংশের মতো। শেষ পর্যন্ত ভোটের হার কত দাঁড়াবে, দিনভর তা নিয়েই চলল জল্পনা। ভোট গণনা ও ফল জানা যাবে আগামী মঙ্গলবার।

অথচ এক পক্ষকাল আগেও মনে করা হচ্ছিল দিল্লির ভোট হবে ‘ওয়ান ওয়ে’ ট্রাফিকের মতো। কেজরিওয়ালের প্রতিপক্ষ বলে কারও অস্তিত্বই তখন পর্যন্ত ছিল না। কিন্তু বিজেপির মহা ‘স্ট্র্যাটেজিস্ট’ অমিত শাহ শাহিনবাগ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে প্রচারের অভিমুখ ঘুরিয়ে দিতেই লড়াইটা জমে গেল। যে লড়াই আম আদমি পার্টি তার পাঁচ বছরের কাজের নিরিখে লড়তে নেমেছিল, যেখানে বিজলি, সড়ক, পানি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুরক্ষা ছিল প্রধান, সেটাই ক্রমে ক্রমে হয়ে দাঁড়াল হিন্দুস্তান-পাকিস্তানে, হিন্দু-মুসলমানে, দেশপ্রেম-দেশদ্রোহে, হিন্দু জাতীয়তাবাদ বনাম ভোট ব্যাংকের রাজনীতির। কেজরিওয়ালের উন্নয়নকেন্দ্রিক ভোটের আহ্বানের পাল্টা বিজেপি তুলে ধরল শাহিনবাগের টুকরে টুকরে গ্যাংয়ের দেশদ্রোহিতার প্রশ্নকে। রাতারাতি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেল নির্বাচনের ন্যারেটিভ।

‘ড্যান্স অব ডেমোক্রেসির’ জন্য প্রকৃতি ছিল সহায়ক। মাঘ মাসের শেষ সপ্তাহে দিল্লির শীত ছিল সহনীয়। সামান্য কুয়াশাচ্ছন্ন শনিবাসরীয় সকাল নয়টা বাজতে না বাজতেই ঝকঝকে হয়ে উঠল। অথচ দেখা গেল প্রথম দুই ঘণ্টায় ভোট প্রদানের হার ৩ শতাংশও ছাড়াল না। দুপুর ১২টায় ভোট পড়ল ২০ শতাংশের মতো। একটার সময় ৩২ শতাংশ। বিকেল চারটেয় তা উঠল ৪১ শতাংশে। পাঁচটায় তা বেড়ে হয় প্রায় ৫৩ শতাংশ। ভোটের এই শম্বুক গতি শুরু করে দেয় জল্পনা। ভোট দানে দিল্লিবাসীর এই অনাগ্রহের ব্যাখ্যা কী হতে পারে, কে হাসবে কে কাঁদবে, সেই নিয়ে চলল আলোচনা। যদিও রাতে জানা যায়, এবারেও প্রদত্ত ভোটের হার শেষ পর্যন্ত গতবারের কাছাকাছিই পৌঁছাচ্ছে।

আজ ভোট পর্বেও বিতর্কের অন্ত ছিল না। মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল ভোট দেওয়ার পর এক টুইটে নারীদের উদ্দেশে বলেন, কাদের ভোট দেওয়া উচিত তা নিয়ে বাড়ির পুরুষদের সঙ্গে আলোচনা করুন। এই পরামর্শের কথা শুনেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি পাল্টা টুইট করেন। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে তাঁর প্রশ্ন, ‘আপনি কি নারীদের যোগ্য মনে করেন না?’ উত্তর দেন কেজরিওয়ালও। বলেন, ‘দিল্লির নারীরা ঠিক করে ফেলেছেন কাকে তাঁরা ভোট দেবেন।’

নির্বাচনী প্রচার শেষ হওয়া সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনের স্পষ্ট নির্দেশ থাকলেও বিজেপি নেতারা আজ ভোটের দিনেও রীতিমতো প্রচার চালিয়ে গেছেন সামাজিক মাধ্যমে। অথচ নির্বাচন কমিশন ছিল নির্বাক! মৌন!

প্রচারের বড় নমুনা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। শনিবার দিল্লিবাসীর উদ্দেশে এক টুইটে তিনি বলেন, নির্মল হাওয়া-বাতাস, স্বচ্ছ পানীয় জল এবং প্রত্যেক গরিব পরিবারের জন্য নিজস্ব বাড়ির ব্যবস্থা করে দিল্লিকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর রাজধানী হিসেবে গড়ে তুলতে পারে একমাত্র সেই সরকার, যা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও যার ইচ্ছাশক্তি প্রবল। অমিত শাহ এর পর লেখেন, দিল্লিবাসীর কাছে আবেদন, আপনারা মিথ্যা ও ভোটব্যাংকের রাজনীতি থেকে দিল্লিকে মুক্ত করুন।

প্রতিপক্ষ আম আদমি পার্টি ও কংগ্রেসকে বিজেপি শাহিনবাগের মদদদার বলে চিহ্নিত করেছে। তাদের কাছে শাহিনবাগ ও দেশদ্রোহ সমার্থক। ১৫ দিন ধরে এই প্রচার দিল্লি নির্বাচনকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। ভোটের দিন সেই প্রচারে আরও বাতাস দিতে বিজেপি কিন্তু দ্বিধা করেনি। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ সিং দিল্লির ভোটারদের উদ্দেশে টুইট করে বলেন, ‘শাহিনবাগের সমর্থকেরা কেজরিওয়ালের সমর্থনে ভোটে নেমেছেন। দিল্লিবাসীর কাছে আমার আবেদন, শাহিনবাগকে রুখতে, দিল্লিকে ইসলামিক স্টেট হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে বেরিয়ে আসুন। বিজেপিকে ভোট দিন।’

বিজেপি এত দিন বলে এসেছে, শাহিনবাগের আন্দোলনকে জিইয়ে রেখেছে আম আদমি পার্টি ও কংগ্রেস। ভোট মিটে গেলে আন্দোলনও উঠে যাবে। শাহিনবাগের নারীরা সেই প্রচারকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করলেন। শনিবার আন্দোলনকারী নারীরা দফায় দফায় ভোট দিয়ে ফের ফিরে যান আন্দোলন মঞ্চে। একবারের জন্যও তাঁরা মঞ্চ খালি রাখেননি। তাঁরা জানান, আন্দোলন সিএএ প্রত্যাহার ও এনআরসির বিরুদ্ধে। দাবি না মানা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।

দিল্লির মোট ভোটারের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। মোট ২ হাজার ৭০০ ভোটকেন্দ্রে বুথের সংখ্যা ১৩ হাজার। শাহিনবাগ, জামিয়া মিলিয়া, সিলমপুরের মতো মুসলমান অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় নিরাপত্তা ছিল নিশ্ছিদ্র। ১৯ হাজার দিল্লি পুলিশ, ১৯০ কোম্পানি আধা সামরিক বাহিনী এবং ১৩ হাজার হোমগার্ডের ওপর দায়িত্ব ছিল নির্বিঘ্নে নির্বাচন উতরে দেওয়া। সুখের কথা, প্রায় নির্বিবাদেই কেটে গেছে দিল্লি বিধানসভার তিক্ততম ও সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ ভোট।

তৃতীয়বারের মতো মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়াল হবেন, নাকি বিজেপি একুশ বছর পর ফিরে পাবে হারানো মসনদ, বুথফেরত ভোট শেষেও সেই জল্পনা কিছুটা হলেও জেগে রইল। কারণ, চূড়ান্ত ফল জানা যাবে মঙ্গলবার এবং বুথফেরত সমীক্ষা বহু সময় ভুল প্রতিপন্ন হয়েছে। সেই সঙ্গে অনুচ্চারিত থাকল বিজেপি কোনোভাবে সফল হলে কে হবেন মুখ্যমন্ত্রী সেই প্রশ্নও।