কেজরিওয়ালের আবারও দিল্লি জয় যে কারণে

আম আদমি প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়াল। ছবি: রয়টার্স
আম আদমি প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়াল। ছবি: রয়টার্স

ভোট গণনার শুরুর দিকে পিছিয়ে ছিলেন দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে কালকাজি আসন থেকে আম আদমির প্রার্থী অতিশি মারলেনা। শেষতক ১১ হাজারের বেশি ভোটে জিতেছেন। জেতার পর ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেল এনডিটিভির লাইভ অনুষ্ঠানে যুক্ত হন অতিশি। রাখঢাক না রেখেই বললেন, ‘শুরুতে বেশ টেনশন হচ্ছিল। তবে আস্থা ছিল, আম আদমি প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সরকার যে কাজ করেছে, তার প্রতিদান মানুষ দেবে। নাগরিক পরিষেবা দিতে আম আদমির সরকার কোনো কসুর করেনি। এ আসলে উন্নয়নের পক্ষে মানুষের রায়।’

দিল্লি ভোটের ফলাফল দেওয়া শেষ হয়নি। তবে ইতিমধ্যে নিশ্চিত হয়ে গেছে, আম আদমি ক্ষমতায় আসছে। ৭০ আসনের এ বিধানসভায় ৬৩ আসনে তাদের বিজয় প্রায় নিশ্চিত। গতবার তিন আসনে জয়ী বিজেপি এবার সাতটি আসন পাওয়ার পথে। ২০১৫ সালের সর্বশেষ বিধানসভায় খাতা খুলতে পারেনি কংগ্রেস। বন্ধ খাতা এবারও বন্ধই রইল।

আজ দিনব্যাপী ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলো লাইভ অনুষ্ঠান করে এ ভোটের ফল প্রকাশ করছে। অনলাইনগুলোর প্রায় পুরো জায়গায় আছে দিল্লি ভোটের ফল আর বিশ্লেষণ। রাজনৈতিক বিশ্লেষক, বিভিন্ন দলের প্রতিনিধি, সাংবাদিকেরা তাঁদের মতামত দিচ্ছেন। এমন এক অনুষ্ঠানে মতামত নেওয়া হলো বিজেপি নেতা বিবেক রেড্ডির। তাঁর কাছে আম আদমির জয়ের কারণ জানতে চাইলে বললেন, ‘প্রথম কারণটি হলো, দিল্লিতে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের মতো কোনো নেতা আমাদের ছিল না। দ্বিতীয় ও মূল কারণটি হলো, বিদ্যুৎ, পানি, শিক্ষার মতো যে নাগরিক পরিষেবাগুলো আম আদমির সরকার দিয়েছে, জনগণ এর ইতিবাচক ফল পেয়েছে। তাই জনরায় তাদের পক্ষে গেছে।’

আম আদমির অতিশি আর বিজেপির বিবেকের রাজনৈতিক দর্শনে মেরুর ভিন্নতা থাকলেও আজ আম আদমির বিজয়ের কারণ হিসেবে দুজন একমত হলেন। উন্নয়নকেই এ বিপুল বিজয়ের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করলেন দুজন।

দিল্লির ভোটকে নিয়ে এত আগ্রহ কেন? দিল্লি তো এক বড় নগর বৈ অন্য কিছু নয়। এত ছোট রাজ্য (বা আধা রাজ্য) বিধানসভা নির্বাচনের ফল নিয়ে এত হইচই হয় না। এবার দিল্লির নির্বাচনের ভোটের প্রচার পুরো নির্বাচনকে ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যায়। আর এর কৃতিত্ব (?) ক্ষমতাসীন বিজেপিকে দিতে হবে। বিজেপির ৭০ জন কেন্দ্রীয় মন্ত্র্রী, ২৭০ সাংসদ, ১১টি রাজ্যের দলীয় মুখ্যমন্ত্রী—ভোট প্রচারে কে ছিল না? আর চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য হিসেবে অধুনা খেতাবপ্রাপ্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর ‘চাণক্য’ অমিত শাহ তো ছিলেনই। বেশি করেই ছিলেন শেষের জন। আর দূষণে আক্রান্ত দিল্লির বাতাসে শাহ এবং তাঁর অনুসারীদের ঘৃণাভরা প্রচার বিষিয়ে দিয়েছে ভোটের আবহ। ভারতের সামগ্রিক রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে এ রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। কয়েক মাস ধরেই ভারতের রাজনীতিতে তাপ ছড়াচ্ছে সংশোধিত নাগরিক আইন (সিএএ) এবং জাতীয় নাগরিক নিবন্ধনের (এনআরসি) বিষয়গুলো। এই দুই রাজনৈতিক উদ্যোগের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। দিল্লির জামিয়া মিলিয়া, জওহরলাল নেহরুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং উত্তর প্রদেশের আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। ভারতের বিজেপি–বিরোধী প্রায় সব দল এই আইনের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান জানিয়ে দেয়। এসব দল এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ বিজেপির এসব উদ্যোগে বিভাজন ও মেরুকরণের এক কৌশল হিসেবেই চিহ্নিত করে। আর এ তপ্ত সময়ে এসে পড়া দিল্লির ভোট। আর স্বভাবতই সেই ভোটের প্রচারে এসে পড়ে সিএএ, কাশ্মীর, এনআরসির মতো বিষয়গুলো। এত সব জাতীয়, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে তিক্ত হয়ে ওঠা নির্বাচনী যুদ্ধে আম আদমি লড়ল কীভাবে? এই মহারণে বিজয়ে আম আদমির কৌশল কী ছিল? মহাপরাক্রমশালী বিজেপি সরকারের সব শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে খোদ রাজধানীতে ঝাড়ু মার্কার বিজয়ের নেপথ্যে কারণ কী ছিল?

দিল্লি ভোটের ফলাফল দেওয়া শেষ হয়নি। তবে ইতিমধ্যে নিশ্চিত হয়ে গেছে, আম আদমি ক্ষমতায় আসছে। দিল্লিতে শুরু হয়ে গেছে সমর্থকদের উল্লাস। ছবি: রয়টার্স
দিল্লি ভোটের ফলাফল দেওয়া শেষ হয়নি। তবে ইতিমধ্যে নিশ্চিত হয়ে গেছে, আম আদমি ক্ষমতায় আসছে। দিল্লিতে শুরু হয়ে গেছে সমর্থকদের উল্লাস। ছবি: রয়টার্স

ভারতের খ্যাতিমান সাংবাদিক নলিনী সিংয়ের মত হলো, ‘আম আদমির বড় কৃতিত্ব হলো তারা বিজেপির ফাঁদে পা দেয়নি। সিএএ বা এনআরসি কিংবা কাশ্মীরের মতো বিষয়গুলো নিয়ে আম আদমিও তপ্ত হোক, বারবার এটাই চেয়েছে। কিন্তু কেজরিওয়াল তাঁর অ্যাজেন্ডায় স্থির থাকতে চেয়েছেন। এবং তা থেকে তিনি সফল হয়েছেন।’

তবে বিজেপির পক্ষ থেকে কম প্রচেষ্টা হয়নি। বিজেপির নেতা পরবিশ বর্মা বা খোদ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুরের মিছিল থেকে স্লোগান উঠেছে, ‘দেশ কি গাদ্দারকো, গোলি মারো শালোকো।’ কেজরিওয়ালকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ তকমা জুড়ে দেওয়া হয়েছে। বিনীত কেজরিওয়াল তাতে ক্ষিপ্ত হননি। তাঁর নির্বাচনী প্রচার দল ঠিক এ সময়েই ‘লাগে রহো কেজরিওয়াল’ নামে নতুন কৌশল জুড়ে দেয়। যেখানে শুধু তাঁর অর্জনের কথা বলা হয়েছে। শিক্ষা, বাসস্থান, বিদ্যুৎ, পানির মতো অপরিহার্য নাগরিক পরিষেবার ক্ষেত্রে কেজরিওয়ালের আম আদমি ভবিষ্যতেও লেগে থাকবে, এই প্রতিশ্রুতিই দেওয়া হয় প্রচারে। আর এটা তো নেহাত ফাঁকা বুলি ছিল না। মানুষ তাদের অভিজ্ঞতায় এর বাস্তবায়ন দেখতে পেয়েছে, তাই তাতে বিশ্বাসও করেছে।

ভারতের মহাহিসাব নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের উপাত্ত বলছে, ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে দিল্লির রাজস্ব আয় ৩১ শতাংশ বেড়েছে। আর এ আয় গেছে স্কুল ও হাসপাতালের উন্নয়নে। যদিও এ সময়ে দিল্লিতে কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দ ৭ শতাংশ কমেছে। দিল্লি ভারতের অন্যতম প্রধান রাজস্ব উদ্বৃত্ত রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

৭০ আসনের বিধানসভায় ৬৩ আসনে আম আদমি পার্টির বিজয় প্রায় নিশ্চিত। দিল্লিতে শুরু হয়ে গেছে সমর্থকদের উল্লাস। ছবি: রয়টার্স
৭০ আসনের বিধানসভায় ৬৩ আসনে আম আদমি পার্টির বিজয় প্রায় নিশ্চিত। দিল্লিতে শুরু হয়ে গেছে সমর্থকদের উল্লাস। ছবি: রয়টার্স

২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ক্ষমতায় এসে আম আদমির সরকার ৪০০ ইউনিটের বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ মওকুফ করে দেয়। গত বছর এ সরকার ঘোষণা দেয়, ২০০ ইউনিটের নিচে ব্যবহারকারীদের আর কোনো চার্জ দিতে হবে না।

আম আদমি সরকারের আরেক স্লোগান ছিল ‘এডুকেশন ফার্স্ট’। এর মাধ্যমে সরকারি স্কুলগুলোর মান উন্নয়নে বিপুল বিনিয়োগ করে এ সরকার। আর্থিক দিক দিয়ে সম্পন্ন পরিবারের সন্তানেরা ফিরে আসতে শুরু করে এসব স্কুলে। ২০১৫ সালে ক্ষমতায় এসেই শিক্ষা ব্যয় ছয় হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছিল আম আদমির সরকার। সর্বশেষ বাজেটে এ বরাদ্দ ১৫ হাজার ১৩৩ কোটি টাকায় নিয়ে গেছে।

এসব সামাজিক পরিষেবাকেই পুঁজি করে এবারও নির্বাচনী লড়াইয়ে নেমেছে কেজরি–বাহিনী। সেখানে জাতপাত–কাশ্মীর–সিএএ নিয়ে তিক্ততা ছিল না। উল্টো দিকে বিজেপির প্রচারের কৌশল ছিল এসব জাতীয় ইস্যুকে ঘিরেই। যখন স্থানীয় নেতারা উচ্চ স্বরে কথা বলেন, তখন কেন্দ্রীয় নেতারা সেটা সামলান। কিন্তু দিল্লিতে উল্টা হয়েছে। স্থানীয় নেতারা যতটা বলেছেন, তার চেয়ে বেশি বলেছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। অমিত শাহের মতো নেতা এর নেতৃত্বে ছিলেন বলা যায়। কিন্তু দিল্লির নাগরিক সমাজ উন্নয়নেই থিতু থেকেছে।

আজ এনডিটিভির টক শোতে বিজেপির কেরালার নেতা বালাশঙ্কর স্বীকার করলেন, ‘এ নির্বাচন শুধু নয়, ভারতের কোনো নির্বাচনেই এখন উগ্রতা ছড়িয়ে কাজ হবে না।’

আম আদমির বিজয়ে আরেকটি কার‌ণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সফল ব্যবহার। নানা প্যারোডি আর স্লোগানে ভরপুর ছিল তাদের প্রচার। প্রতিদিন একটি করে নতুন ভিডিও দিয়েছে অঙ্কিত লালের নেতৃত্বাধীন আম আদমির সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বাহিনী। এ দলে বেশির ভাগই বয়সে নবীন। তাঁদের মধ্যে ২৩ বছর বয়সী অভিজিৎ দীপক অন্যতম। তিনি বলেন, ‘আমরা এটা বুঝতে পেরেছিলাম সামাজিক মাধ্যমের একটা বড় প্রভাব আছে। আর এটা আমরা ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছি।’

আম আদমি প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়াল। ছবি: এএফপি
আম আদমি প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়াল। ছবি: এএফপি

জানুয়ারিতে শাহীনবাগ ইস্যুতে ভোটের হাওয়া পাল্টে যেতে শুরু করে। এ সময়ই দেশদ্রোহী তকমা জোটে কেজরিয়াওয়ালের। কিন্তু এর বিপরীতে কেজরিয়াওয়াল ভোটারের কাছে গেছেন ‘আপকা বেটা’ হিসেবে।
এ নিয়ে আম আদমি ষষ্ঠবারের মতো কোনো নির্বাচনে এল। দুই লোকসভা, এক পৌর করপোরেশন, তিন বিধানসভা। কিন্তু এই প্রথম আম আদমি এক পেশাজীবী নির্বাচনী কুশলীকে কাজে লাগাল। তিনি প্রশান্ত কিশোর। ভারতজুড়ে নির্বাচনী মাস্টার হিসেবে পরিচিত কিশোর ও তাঁর আই–প্যাক এবার কেজরিওয়ালের হয়ে কাজ করে। নরেন্দ্র মোদি, পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী অমরিন্দর সিং এবং শেষতক পশ্চিমবঙ্গের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হয়ে কাজ করেছেন প্রশান্ত। তাঁর সফলতার হারও যথেষ্ট।

তাহলে দিল্লির নির্বাচন কি ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে কোনো বার্তা দিচ্ছে? এ নিয়ে ক্ষমতাসীন বিজেপির সঙ্গে অন্য দলগুলোর মধ্যে ভিন্নতা আছে। বিজেপি এখন বলছে, দিল্লির নির্বাচনটি একটি স্থানীয় নির্বাচন। এতে জাতীয় ইস্যু খুব বেশি বিবেচ্য হবে না, এটাই স্বাভাবিক। আর বিজেপিকে মানুষ তো প্রত্যাখ্যানও করেনি। দলটি আগের বারের চেয়ে ৮ শতাংশ বেশি ভোট পেয়েছে এবার।

বিজেপির এ দাবি গ্রহণ করেও বলা যায়, ক্ষমতাসীন আম আদমির আসন হারিয়েছে চারটি কিন্তু ভোট মাত্র ১ শতাংশ কমেছে। তবে কংগ্রেস একটি আসন না পেলেও তাদের ভোট চার শতাংশের বেশি কমেছে। কংগ্রেসের এই ভোটের মধ্যে মুসলিম ভোট আম আদমির পক্ষে গেছে বলে মনে করেন রাজ্যসভার সাবেক সদস্য মোহাম্মদ আদিব। আজ তিনি টিভি চ্যানেলে প্রকাশ্যেই বললেন, তিনি এর আগেও কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছেন। এবার দিয়েছেন আম আদমিকে। কারণ এনআরসি ও সিএএ নিয়ে উত্তাপে দিল্লিতে এ দলের কোনো কার্যকর ভূমিকা তিনি দেখেননি।

তবে শেষ বিচারে কেজরিওয়ালের দলের দিল্লি জয় হিংসার বিপরীতে ইতিবাচকতার জয়, এমন মত যাঁরা ধারণ করেন, তাঁদের একজন দ্য প্রিন্টের প্রধান সম্পাদক শেখরগুপ্ত। তিনি বলেন, দিল্লির নির্বাচন ঘৃণার প্রচারকে প্রত্যাখ্যান করেছে। জনমানুষের অধিকার নিয়ে ইতিবাচক কাজ করলে যে ভালো ফল মেলে, এটা তারই প্রতিফলন।