দিল্লির ভোট কি মোদির বিপক্ষে?

নরেন্দ্র মোদি, অরবিন্দ কেজরিওয়াল। ছবি: রয়টার্স ও এএফপি
নরেন্দ্র মোদি, অরবিন্দ কেজরিওয়াল। ছবি: রয়টার্স ও এএফপি

ভারতের রাজধানী দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে জিতেছে আম আদমি পার্টি (এএপি)। এবার জিতে টানা তিনবার ক্ষমতায় এল দলটি। কিন্তু ভোটের এই ফলাফল থেকে একটি ভুল ব্যাখ্যা দাঁড়িয়ে যেতে পারে। সেটা হলো, এই ভোট প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে। কিন্তু আসলে তা নয়।

অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দল এএপি জিতেছে তাদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও কার্যকর প্রশাসনিক ব্যবস্থার জন্য। কারণ এএপির কারণে দিল্লির সরকারি বিদ্যালয়গুলোর উন্নতি হয়েছে, হাসপাতালগুলোর উন্নতি হয়েছে। কেজরিওয়ালের সরকার দিল্লিতে কম দামে পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। এসব কারণে মানুষ মোদির বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন।

দুই দশকের বেশি সময় আগে দিল্লিতে ক্ষমতায় ছিল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। এবার নির্বাচনী প্রচারে কেজরিওয়ালের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করে বিজেপি। কিন্তু পরে সেই প্রচারের চিত্র আবার বদলে যায়। মোদির দল বিজেপি মেরুকরণের নীতি গ্রহণ করে। তারা নতুন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ), কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল এবং রাম মন্দির নির্মাণের বিষয়টি প্রচারের মাঠে আনে। এ ছাড়া দলটির নেতারা বিভিন্ন সভায় বিদ্বেষপ্রসূত বক্তব্যও দেন। এসব বক্তব্য পরবর্তী সময়ে সেন্সরও করেছিল নির্বাচন কমিশন।

মোদির দলের নেতাদের ধারণা ছিল, তাঁদের এই কৌশল হয়তো কাজে আসবে। কারণ, বিজেপির এই কট্টরবাদী নীতি এর আগে কাজে এসেছিল। এমন ধরনের প্রচার চালিয়ে সর্বশেষ সাধারণ নির্বাচনে দিল্লির সাতটি আসনই জিতেছিল বিজেপি। এ ছাড়া দিল্লির অর্ধেকের বেশি ভোট পেয়েছিল দলটি। কিন্তু এবার এই কৌশল আর কাজ করল না। তাই প্রশ্ন উঠতে পারে, মেরুকরণের যে রাজনীতি বিজেপি করছে, তার বিরুদ্ধে কি এই ভোট। এই প্রশ্নের উত্তর আরও সূক্ষ্ম। কারণ দেখা যাচ্ছে, মোদি এবং তাঁর নীতিকে যাঁরা সমর্থন করেন, তাঁরাও অন্য একটি দলকে ভোট দিতে পারেন যদি সেই দল তাদের জীবনযাত্রার উন্নয়ন ঘটাতে পারে।

এই নির্বাচনের আগে একটি জরিপ চালিয়ে ছিল সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব ডেভেলপিং সোসাইটিস (সিএসডিএস)। দিল্লির একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রতিষ্ঠান এটি। এই প্রতিষ্ঠানটির জরিপে বলা হয়েছিল, দিল্লির প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ মোদির বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনকে সমর্থন করেন। এ ছাড়া এই আইন বাতিলের দাবিতে যে বিক্ষোভ চলছে, সেই বিক্ষোভও চান না মানুষ। কিন্তু মোদির এই সমর্থকেরাই বলছেন, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁরা অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে চান। সিএসডিএসের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সঞ্জয় কুমার বলেন, দিল্লিতে কেজরিওয়ালের সরকার যে উন্নয়ন করেছে, তারই স্বীকৃতি দিয়েছেন মানুষ। এর সঙ্গে সিএএ কিংবা মোদির বিরুদ্ধে দেশব্যাপী বিক্ষোভের সম্পর্ক নেই।

ভারতে বর্তমান অবস্থার ওপর নজর দিলে দেখা যাবে, সাধারণ নির্বাচন ও বিধানসভার নির্বাচনের ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন ভোটাররা। কারণ দেখা যাচ্ছে, সাধারণ নির্বাচনের ছয় মাসের ব্যবধানে ঝাড়খন্ডের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি হেরেছে এবং ভোট কম পেয়েছে ১৭ শতাংশ। এমন পরাজয় মহারাষ্ট্রেও হয়েছে। এতে এটা আরও পরিষ্কার হয়ে উঠছে, মোদির বিজেপি ও তাদের আগ্রাসী রাজনীতি রাজ্যগুলোতে বাধার মুখে পড়ছে।

এখন আরেকটি প্রশ্ন উঠছে, দিল্লির নির্বাচন কি বিজেপির ভবিষ্যৎকে ক্ষতির মুখে ফেলবে কিংবা ভবিষ্যতের ওপর প্রভাব ফেলতে সক্ষম হবে? এখনো এই বিষয়ে স্পষ্ট করে কোনো কিছু বলা যায় না। কারণ, এখনো কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে অনেকেই বিশ্বাস করেন, বিজেপির জাতীয়তাবাদী প্রচারণা খানিকটা অস্বস্তি তৈরি করেছে, মানুষকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলেছে। অনেকেই বলছেন, অর্থনীতির যে ধস নেমেছে, তা থেকে দৃষ্টি ফেরাতেই এই রাজনীতি করছে দলটি। তবে এটা পরিষ্কার, মোদি এখনো সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা।

আরেকটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে, কেজরিওয়ালের এই বিজয় বিভক্ত ও হতাশ বিরোধী দলকে একটি স্বস্তির জায়গা দিয়েছে। এই বিজয় প্রমাণ করেছে, সুশাসন নিশ্চিত করলে ভোট পাওয়া যায়, ভোটে জেতা যায়।