ভারতের কলেজে মাসিক নিয়ে ছাত্রীদের চরম হেনস্তা

শ্রী সাহাজানন্দ গার্লস ইনস্টিটিউটে (এসএসজিআই) সমবেত হয়েছেন মেয়েরা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
শ্রী সাহাজানন্দ গার্লস ইনস্টিটিউটে (এসএসজিআই) সমবেত হয়েছেন মেয়েরা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

ভারতে নারীদের মাসিক নিয়ে অযাচিত আচরণ আবারও খবরের শিরোনামে উঠে এল। এর আগে কেরালার শবরীমালা মন্দিরে ঋতুমতী নারীদের ঢোকা নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড ঘটার পর এবার মাসিক নিয়ে এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আবাসিক ছাত্রীদের হেনস্তার অভিযোগ উঠেছে।

ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের রাজ্য গুজরাটের একটি কলেজের আবাসিক ছাত্রীদের মাসিক হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত হতে ছাত্রীদের পরিধেয় পায়জামা ও অন্তর্বাস পরীক্ষা করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। নারী শিক্ষকেরা পরীক্ষা করে দেখেন কার মাসিক হয়েছে। হোস্টেলের ৬৮ ছাত্রীকে ক্লাস থেকে টেনে বাথরুমে নিয়ে পরীক্ষা করা হয়।

আজ রোববার বিবিসি অনলাইনের খবরে বলা হয়েছে, গত মঙ্গলবার ভুজ শহরে শ্রী সাহাজানন্দ গার্লস ইনস্টিটিউটে (এসএসজিআই) আন্ডার–গ্র্যাজুয়েট ছাত্রীদের সঙ্গে এ ঘটনা ঘটে। সম্পদশালী ও কট্টরপন্থী হিন্দু গোষ্ঠী স্বামীনারায়ণ সম্প্রদায় ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে।

কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, হোস্টেলের কর্মকর্তারা গত সোমবার কলেজের অধ্যক্ষের কাছে অভিযোগ করেন, প্রতিষ্ঠানে মাসিক চলাকালে নারীদের জন্য আরোপিত বিধিনিষেধ কিছু ছাত্রী ভঙ্গ করছেন।

তাদের নিজস্ব বিধিনিষেধের মধ্যে রয়েছে মাসিকের সময় মেয়েরা মন্দির ও রান্নাঘরে ঢুকতে পারবেন না এবং অন্য কোনো শিক্ষার্থীকে স্পর্শও করতে পারবেন না। খাবারের সময়েও এই মেয়েদের অন্যদের থেকে দূরে বসে খেতে হবে। তাঁদের নিজের থালাবাসন নিজেকেই পরিষ্কার করতে হবে। আর ক্লাসে তাঁদের বসতে হবে একদম পেছনের আসনে।

একজন শিক্ষার্থী বিবিসিকে জানান, মাসিক চলছে—এমন মেয়েদের শনাক্ত করার জন্য একটি নিবন্ধন খাতা রেখেছে হোস্টেল কর্তৃপক্ষ। যাঁদের মাসিক চলছে, তাঁদের ওই খাতায় নাম লিখতে হয়। তবে গত দুই মাস ওই খাতায় কোনো নাম নিবন্ধন হয়নি।

বোঝাই যাচ্ছে, মাসিক হয়েছে জানলে যেভাবে মেয়েদের শনাক্ত করে নানা বিধিনিষেধের মধ্যে ফেলা হয়, সেসব থেকে বাঁচতেই তাঁরা নাম লিখতে যাননি।

এ অবস্থায় গত সোমবার হোস্টেল কর্তৃপক্ষ অধ্যক্ষের কাছে অভিযোগ করে, মাসিক চলাকালেও মেয়েরা রান্নাঘরে ঢুকছেন, মন্দিরের কাছাকাছি যাচ্ছেন এবং অন্য মেয়েদের সঙ্গে মিশছেন।

ছাত্রীরা অভিযোগ করেন, এর পরদিন হোস্টেলে কর্তৃপক্ষ এবং অধ্যক্ষের হয়রানির শিকার হয়েছেন তাঁরা। ঘটনাটিকে তাঁরা ‘বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা’ উল্লেখ করে বলেছেন, ঘটনাটি তাঁদের ‘আতঙ্কগ্রস্ত’ করে তুলেছে এবং এটা ‘মানসিক নির্যাতনের’ শামিল।

একজন ছাত্রীর বাবা বলেছেন, তিনি যখন হোস্টেলে যান, তাঁর মেয়েসহ কয়েকজন ছাত্রী তাঁর কাছে এসে কান্না শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘ওরা কষ্টে আছে’।

ঘটনার এক দিন পর গত বৃহস্পতিবার ছাত্রীদের একটি অংশ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করে। তাদের হয়রানি করার অভিযোগে কলেজ কর্তৃপক্ষের শাস্তি দাবি করে।

কলেজের ট্রাস্টি প্রবীণ পিন্দোরিয়া ঘটনাটিকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ উল্লেখ করে বলেন, ঘটনাটি তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্যায়ের সঙ্গে কারও জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তবে কলেজটি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদিত, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য দর্শনা ঢোলাকিয়া ছাত্রীদেরই দোষারোপ করেছেন। তিনি বলেন, ছাত্রীরা নিয়ম ভঙ্গ করেছেন। ছাত্রীদের কেউ কেউ ক্ষমা চেয়েছেন।

এদিকে ছাত্রীদের অনেকে বলছেন, বিষয়টি নিয়ে হইচই না করতে কর্তৃপক্ষ তাঁদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে।

গত শুক্রবার গুজরাট রাজ্য নারী কমিশন এই ‘লজ্জাজনক চর্চার’ বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে এবং ছাত্রীদের কোনো ভয় ছাড়া তাঁদের যন্ত্রণার কথা সামনে এসে বলার আহ্বান জানিয়েছে।

এ ঘটনায় পুলিশ একটি অভিযোগ লিপিবদ্ধ করেছে।

ভারতে মাসিকের সময় ছাত্রীদের হয়রানির শিকার হওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম নয়।

তিন বছর আগে উত্তর ভারতের একটি আবাসিক স্কুলের বাথরুমের দরজায় রক্ত দেখার পর কার মাসিক হয়েছে জানতে ৭০ জন ছাত্রীকে পায়জামা খুলে পরীক্ষা করেন এক নারী তত্ত্বাবধায়ক।

ভারতজুড়ে মাসিকের সময় নারীর প্রতি এমন বিরূপ আচরণ করা হয়ে থাকে। সেখানে মাসিক নিয়ে ট্যাবু রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। মাসিক চলাকালে নারীকে অপবিত্র মনে করা হয়। তাঁদের সামাজিক ও ধর্মীয় আচার থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা হয়। মন্দির ও মাজারে ঢুকতে দেওয়া হয় না। রান্নাঘরেও ঢুকতে দেওয়া হয় না।

শহরের শিক্ষিত নারীদেরও এই পশ্চাদমুখী ধ্যানধারণার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়। কয়েক বছর ধরে মাসিককে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক জীবতত্ত্বীয় কার্যকারিতার অংশ হিসেবে প্রচার চালানোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এতে সফলতার পথ অনেক দূর।

২০১৮ সালে কেরালার শবরীমালা মন্দিরে সব বয়সী নারীদের প্রবেশে উচ্চ আদালত ঐতিহাসিক রায় দিলেও সেখানে কট্টরপন্থীদের চরম প্রতিরোধের মুখে বিচারকেরা রায়টি পুনর্বিবেচনার সিদ্ধান্ত নেন। বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল, প্রতিরোধ বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারীদের বড় একটি অংশ ছিল নারী। এতেই বোঝা যায়, দেশটিতে মাসিক নিয়ে ছুঁতমার্গ কত গভীরে গাঁথা।