প্রশান্ত কিশোরের হাত ধরে বিকল্প রাজনীতির খোঁজ এবার বিহারে

প্রশান্ত কিশোর
প্রশান্ত কিশোর

ফাল্গুনের গোড়ায় তৃতীয়বারের মতো মুখ্যমন্ত্রিত্বের শপথ নিয়ে অরবিন্দ কেজরিওয়াল দিল্লির রামলীলা ময়দান থেকে রাজনীতির যে নতুন ধারার কথা শোনালেন, কী আশ্চর্য, দুদিন পর সেই হাওয়া পৌঁছে গেল বিহারে! যাঁর পরামর্শ শিরোধার্য করে কেজরিওয়াল নিজেকে আমূল বদলে ফেলেছেন, সেই ভোট-কুশলী প্রশান্ত কিশোর এবার নিজ রাজ্য বিহারকে বদলানোর বাসনায় ময়দানে নেমেছেন। ঘোষণা করেছেন তাঁর ‘বাত বিহার কি’ কর্মসূচির।

বাত বিহার কি ব্যাপারটা কী, তা বলার আগে কেজরিওয়ালের নতুন ব্র্যান্ডের রাজনীতির কথাটা আরও একবার জানিয়ে রাখি। এ–ও জানাই, প্রশান্ত কিশোর, যাঁকে রাজনীতির জগৎ ‘পিকে’ নামেই চেনে, কীভাবে কেজরিওয়ালকে বদলে দিলেন।

পিকের বয়স মাত্র ৪৩। অথচ রাজনীতির আঙিনায় খ্যাতি পেয়েছেন ৩৪ বছর বয়সেই। সেই বছর, ২০১১ সালে, তিনি পৌঁছে যান গুজরাটে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দরবারে। পরের বছর বিধানসভার ভোট। তৃতীয়বারের মতো মোদিকে জেতানোর দায়িত্ব পেয়ে সসম্মানে উতরে যান। মোদিও আঁকড়ে ধরে থাকেন পিকেকে। তত দিনে পিকে গড়ে তুলেছেন তাঁর ভোট ম্যানেজমেন্ট সংস্থা ‘সিটিজেনস ফর অ্যাকাউন্টেবল গভর্ন্যান্স’ (সিএজি)। একটা বছর আঠার মতো লেগে থাকার ফল মিলল ২০১৪ সালে। প্রধানমন্ত্রী হলেন নরেন্দ্র মোদি।

সেই থেকে পিকের উত্থান মসৃণ। সিএজির খোলনলচে পাল্টে ‘ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল অ্যাকশন কমিটি’ (আই প্যাক) গড়ে ২০১৫ সালে নিতীশ কুমারকে তিনি তৃতীয়বারের মতো বিহারের মুখ্যমন্ত্রী করেন। পরের বছর সাড়া দেন পাঞ্জাবে কংগ্রেসের নেতা অমরিন্দর সিংকে ডাকে। সাফল্য সেখানেও। ২০১৯ সালে অন্ধ্র প্রদেশে তাঁকে ডেকে নেন ওয়াইএসআর কংগ্রেস নেতা জগনমোহন রেড্ডি। পাশাপাশি ডাক পশ্চিমবঙ্গের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ও দিল্লির অরবিন্দ কেজরিওয়ালের। সাফল্যের এই ফুলঝুরির মধ্যে একমাত্র ব্যর্থতা ২০১৭ সালের উত্তর প্রদেশে। কংগ্রেসকে তিনি উতরাতে পারেননি। কেন পারেননি, তা–ও সবার জানা। পিকের দাবি, তাঁর পরামর্শ মেনে নেয়নি গান্ধী পরিবার।

কেজরিওয়াল আজ রাজনীতির যে নতুন দিগন্তের কথা শোনাচ্ছেন, তার বীজও পিকের পুঁতে দেওয়া। পাঁচ বছরের প্রথম তিন বছর তিনি পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করে গেছেন কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে। ধরনায় বসেছেন বহুবার। উপরাজ্যপালের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছেন। দিল্লি পুলিশকে শত্রু বানিয়ে ফেলেছেন। পিকের পরামর্শে নিজেকে হঠাৎই বিলকুল বদলে ফেললেন কেজরিওয়াল। নজর দিলেন যাবতীয় নাগরিক পরিষেবার দিকে। বিজেপির উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদকে চ্যালেঞ্জ জানানোর রাস্তায় ভুলেও পা দিলেন না। মানসিকভাবে পাশে দাঁড়ালেও শাহিনবাগের আন্দোলনকারীদের কাছে যাননি। দিল্লির ভোট বিজেপি হিন্দু-মুসলমানে বাঁটোয়ারা করুক, তা চাননি। নির্বাচনকে টেনে এনেছেন স্রেফ উন্নয়নের রাস্তায়। দেখতে চেয়েছেন কাজের নিরিখে।

অতঃপর এখন থেকে কোন ধরনের রাজনীতি তিনি করতে চান, রামলীলা ময়দান থেকে সেই বার্তাই কেজরিওয়াল পৌঁছে দিয়েছেন। পিকের শেখানো কথাই শুনিয়েছেন। বলেছেন, ‘যাঁরা আমায় ভোট দেননি, আমি তাদেরও মুখ্যমন্ত্রী।’ এ কথাও জানিয়েছেন, ‘ভোটের প্রচারে কুকথা মনে রাখিনি। সবাইকে আমি ক্ষমা করে দিয়েছি।’ শপথ–মঞ্চকে বিজেপিবিরোধী ঐক্যের বিজ্ঞাপন করে তোলেননি। আমন্ত্রণ জানাননি ভিন রাজ্যের কোনো মুখ্যমন্ত্রীকেও। আমন্ত্রিত ছিলেন শুধু নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ। স্পষ্ট বুঝিয়েছেন, সংঘাত নয়, সহযোগিতার পথেই তিনি হাঁটতে চান।

এতজন রাজনীতিককে যিনি তরিয়েছেন, রাজনীতির বাইরে থাকা তাঁর পক্ষে কঠিনই। পিকেও তাই নিতীশের হাত ধরে সংযুক্ত জনতা দলে ঢোকেন ২০১৮ সালে। দুই বছরের মধ্যে দল থেকে বেরিয়েও তাঁকে যেতে হলো। এখন স্বপ্ন দেখছেন নিজেকে ‘বিহার-নরেশ’ করে তোলার। বাত বিহার কির জন্মও সেই কারণে।

প্রথার বাইরে বেরিয়ে প্রথাগত রাজনীতি করার যে পরামর্শ তিনি কেজরিওয়ালকে দিয়েছেন, সেই হাওয়া বিহারে বইয়ে দিতে পিকে পা ফেললেন। আগামীকাল শুক্রবার আত্মপ্রকাশ করবে বাত বিহার কি কর্মসূচির। তিনি বলেছেন, ‘রাজ্যে দরকার ভালো মুখিয়ার। বিহারে আমি ১০ হাজার ভালো মুখিয়া তৈরি করতে চাই। এই মুহূর্তে তাঁর লক্ষ্য রাজ্যের ৮০০ পঞ্চায়েত। নজরে রাজ্যের যুব সম্প্রদায়। তাঁর দাবি, এখনই প্রায় তিন লাখ মানুষ তাঁর পাশে রয়েছে। ২০ মার্চের মধ্যে সেই সংখ্যাটা তিনি ১০ লাখে নিয়ে যেতে চান।

প্রধানমন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রী তৈরির কারিগর যিনি, নিজেকে সেই পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন তিনি দেখতেই পারেন। পিকেও সেই স্বপ্ন দেখছেন। সে কথা তিনি গোপনও করেননি। রাজ্যে একটা শক্তপোক্ত, কার্যকর, জনমুখী রাজনৈতিক দল গড়ে তোলা তাঁর লক্ষ্য। সেই দল যা ভিন্ন ধরনের রাজনীতি করবে। বিকল্প রাজনীতির সংস্কৃতি তৈরি করবে। উন্নয়নের কথা বলবে। সবাইকে একজোট করে এগোবে। মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে ২২ নম্বর রাজ্যে আটকে থাকা বিহারকে তিনি প্রথম সাতের মধ্যে নিয়ে আসতে চান। লক্ষ্য তাঁর স্থির। সফল হবেন কি না, তা ভবিষ্যৎ বলবে।

‘বাত বিহার কি’র ওপর ভর দিয়ে আপাতত তৈরি করছেন এক মঞ্চ। রাজনৈতিক দল গড়ার কথা পরে ভাববেন বলেছেন। সেই মঞ্চে আসার দরজা তিনি হাট করে খুলে রাখছেন সবার জন্য। নিতীশ কুমার বা সুশীল মোদিরাও স্বাগতম।