জার্মানিতে বর্ণবাদী আস্ফালন বাড়ছে

জার্মানিতে বুধবার দুটি সিসা বার লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। এতে অন্তত আটজন নিহত হন। ছবি: এএফপি
জার্মানিতে বুধবার দুটি সিসা বার লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। এতে অন্তত আটজন নিহত হন। ছবি: এএফপি

আবারও জার্মানিতে বর্ণবাদীদের হাতে অভিবাসীদের রক্ত ঝরল। বুধবার স্থানীয় সময় রাত ১০টার দিকে ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে হ্যানাও শহরে দুটি সিসা বারে গুলি চালায় এক বন্দুকধারী। এতে অন্তত আটজন নিহত ও সন্তানসম্ভবা এক নারীসহ পাঁচজন মারাত্মক আহত হন। গুলির পরপরই হামলাকারী দ্রুত গাড়িতে করে পালিয়ে যায়।

পরে ত্রিশটি গাড়িতে করে পুলিশ হামলাকারীর সন্ধানে অভিযান শুরু করে। ঘটনাস্থল থেকে থেকে দুই কিলোমিটার দূরে একটি বাড়ি ঘেরাও করে পুলিশ। পরে সেখান থেকে দুটি মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ৪৬ বছর বয়স্ক আততায়ী নিজে আত্মহত্যা করার আগে তাঁর ৭২ বছর বয়স্ক মা কেও হত্যা করে বলে মনে করা হচ্ছে।

জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা ম্যার্কেল এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ করে বলেছেন, ‘আজ আমাদের দেশের জন্য অত্যন্ত দুঃখের দিন। যারা জার্মানিকে বিভক্ত করতে চাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে আমাদের সমবেত ভাবে লড়তে হবে। বর্ণবাদ একটি বিষ, ঘৃণা।’

জার্মানির রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্ক-ভাল্টার স্টাইনমায়ার হ্যানাও শহরের ঘটনা শুনে হতবাক ও আতঙ্কিত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন। জার্মানির পররাষ্ট্র মন্ত্রী হাইকো মাস দক্ষিণপন্থীদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রতিবেশী দেশ ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি হতাহতদের প্রতি সমবেদনা জানিয় বলেছে ফ্রান্স সব সময় সন্ত্রাসী দমনে জার্মানির পাশে আছে।

পৃথিবীর দেশে দেশে বর্ণবাদী বা উগ্র জাতীয়তাবাদীদের হত্যা হামলা ক্রমশই বাড়ছে, তবে জার্মানির বিষয়টি ভিন্ন। যে দেশে অনটন নেই, শিক্ষা, স্বাস্থ্য চাকরি, গৃহায়ণের সমস্যা নেই, সে দেশে ক্রমশই বর্ণবাদীদের উত্থান আর আস্ফালন বিস্ময়কর।

বেশি দিনের কথা নয়, গত ২৩ জানুয়ারি অশউইৎজ বন্দিশিবির মুক্তির ৭৫ বছর পূর্তির প্রাক্কালে আবারও জার্মানির জনগণকে তাদের কৃতকর্মের দায়বদ্ধতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন জার্মান রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্ক ভাল্টার স্টাইনমায়ার। তিনি জার্মান তথা ইউরোপীয় জনগণকে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া এবং দায়বদ্ধতার কথা বলেছেন। কিন্তু কেন এই দায়বদ্ধতা!

১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধটি শুরু করেছিল, জার্মানির কট্টর বর্ণবাদী নাৎসি নেতা অ্যাডলফ হিটলার। বর্ণবাদী হিটলারের ন্যাশনাল সোশ্যালিস্টিক পার্টির নিজস্ব এস এস গোয়েন্দা বাহিনী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে নির্মম ও ত্রাস হিসেবে পরিচিত পেয়েছিল। এই বাহিনী অন্য বর্ণ, ধর্ম, জাতীয়তা বা ভিন্ন ধারার রাজনীতিকদের ওপর নির্মম অত্যাচার করতেন বা হত্যা করতেন। নাৎসি হিটলারের জার্মানিতে ও দখলকৃত ইউরোপের নানা দেশে অসংখ্য বন্দীশিবির তৈরি করেছিলেন। এদের মধ্যে অশউইৎজ নির্মমভাবে বন্দী হত্যার জন্য কুখ্যাত হয়েছিল। যুদ্ধকালীন ১৯৪০ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত সারা ইউরোপের বিভিন্ন স্থান থেকে যুদ্ধবন্দী ধরে আনা হয় এই অশউইৎজে। তাদের মধ্য প্রায় এগারো লাখ বন্দীকে এই বন্দী শিবিরে পৌঁছানো মাত্র রাসায়নিক গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। বিশ্বজুড়ে এই যুদ্ধে শুধু ইউরোপ মহাদেশেই মারা পড়েছিল ৬ কোটি মানুষ।

জার্মানির ঘটনা থেকে প্রতীয়মান হয়, অর্থনৈতিক সংকট হলেই যে উগ্র লোকরঞ্জনবাদের প্রাদুর্ভাব হবে, তা ঠিক নয়। এই ধারণা এখন বদলে গেছে। অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ম্ভর দেশগুলোতেও এর প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। এখনকার ইউরোপের জাতীয়তাবাদী নেতারা জনপ্রিয়তা পাচ্ছেন সাংস্কৃতিক বৈসাদৃশ্য, জাতিসত্তা, অভিবাসী, সন্ত্রাসবাদ ও ইসলাম ধর্মের ধুয়া তুলে। তবে এর সঙ্গে লোকরঞ্জনবাদের প্রবক্তারা দেশভেদে স্থানীয় ইস্যুগুলোও যুক্ত করছেন। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈশ্বিক বিষয়টি উড়িয়ে দিয়ে প্রগতিবিরোধী এই দলগুলোর দেশ চালানোর অযোগ্য হয়েও জনগণের সংকীর্ণ আবেগ উসকে দেওয়ার চেষ্টা করছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘটনার সঙ্গে, এখনকার নব্য নাৎসিদের হামলার তুলনা করা করা যাবে না বটে, তবে দিনে দিনেই এদের প্রতাপ ও জনপ্রিয়তা বেড়েই চলেছে। আশঙ্কা আর উদ্বেগটা সেখানেই। রক্ষণশীল রাজনীতিক ও নব্য নাৎসিবাদীরা সাবেক পূর্ব জার্মানিতে অভয়ারণ্য গড়ে তুলছে। পশ্চিম দিকেও ক্রমশ তা ছড়িয়ে পড়েছে। ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর জার্মানির জাতীয় নির্বাচনে তৃতীয় সর্বোচ্চ ১৩ শতাংশ ভোট পেয়ে পার্লামেন্টে ৯৪ আসন পেয়েছেন কট্টরবাদী অলটারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ড (এএফডি) দলটি। এটি এখন জার্মানির পার্লামেন্টের প্রধান বিরোধী দল।এদের উসকানিতে জার্মানিতে নব্য নাৎসিরা ক্রমশই তাদের শক্তিমত্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে।

অতীত ক্লেদাক্ত যুদ্ধবিগ্রহের অভিজ্ঞতা পেছনে ফেলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর গত ৭৫ বছরে জার্মানি ইউরোপে বড় দেশ হিসেবে গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি অগ্রগণ্য দেশ হিসেবে পরিচিত হয়েছে। তবে এখন বর্ণবাদীরা জার্মানির মাটিতে যা ঘটাচ্ছে, তা রুখতে জার্মানি তথা ইউরোপের রাজনীতিতে নতুন ভাবনার সময় এসেছে।


*সরাফ আহমেদ, প্রথম আলোর হ্যানোভার (জার্মান) প্রতিনিধি