দিল্লি এখন থমথমে

দিল্লিতে ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) ও জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) নিয়ে সংঘর্ষের পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। ছবি: রয়টার্স
দিল্লিতে ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) ও জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) নিয়ে সংঘর্ষের পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। ছবি: রয়টার্স

ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) ও জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) দেশজুড়ে যে অশান্তির জন্ম দিয়েছে, এতে দিল্লিতে মৃত মানুষের সংখ্যা বেড়ে ২৭–এ পৌঁছেছে। আহত দুই শতাধিক। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মানুষই রয়েছেন।

নিহত হয়েছেন পুলিশ কর্মী, গোয়েন্দা বিভাগের লোকও। এখন থমথমে হয়ে রয়েছে উত্তর-পূর্ব দিল্লির বিস্তীর্ণ এলাকা। বন্ধ বাজার, দোকানপাট। রাস্তায় লোকজনের দেখা নেই বললেই চলে।

ভারতের নিউজ ১৮-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজধানী কার্যত দখল নিয়েছে পুলিশ ও আধা সেনা। গত রোববার থেকে শুরু অশান্তিতে সিএএ–বিরোধী ও সমর্থনকারীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। গতকাল বুধবার থেকে অশান্তি কিছুটা কমেছে। কিন্তু আতঙ্ক কাটেনি রাজধানীবাসীর। কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের পর থেকে কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে এসেছে উত্তর-পূর্ব দিল্লির পরিস্থিতি।

ওই এলাকায় গতকাল এক কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। সংঘর্ষপ্রবণ চার এলাকায় কারফিউ জারি করা হয়েছে। দাঙ্গাকারী লোকজনকে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ এসেছে।

গতকাল দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল বলেন, স্থানীয় লোকজন নয়, দিল্লিতে সহিংসতা ছড়িয়েছে বহিরাগত লোকজন। তিনি বলে, ‘দিল্লির মানুষ সহিংসতা-বিদ্বেষ চায় না। দিল্লির হিন্দু-মুসলিম লোকজন শান্তির পক্ষে।’

একই সঙ্গে দিল্লি হিংসায় মৃত পুলিশ কর্মী রতন লালের পরিবারকে এক কোটি টাকা সরকারি সাহায্য ও পরিবারের একজনকে সরকারি চাকরির কথাও ঘোষণা করেন তিনি।

এদিকে বিদ্বেষ ও উসকানিমূলক মন্তব্য করা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দিল্লি পুলিশকে এফআইআর করতে বলেছেন দিল্লি হাইকোর্ট। অনুরাগ ঠাকুর, কপিল মিশ্রসহ চারজন বিজেপি নেতার মন্তব্যের পর এই পর্যবেক্ষণ আদালতের। এদিন আদালত কক্ষেই কপিল মিশ্রের মন্তব্যের ভিডিও চালানো হয়। বিচারপতি এস মুরলিধর বলেন, আদালত আরেকটা ১৯৮৪ হিংসার ঘটনা হতে দিতে দেবেন না। ভিডিওটি দেখে এবং ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দিল্লি পুলিশ কমিশনার অমূল্য পট্টনায়েককে আজ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে।

উপদ্রুত এলাকায় আধা সামরিক বাহিনীর টহল চলছে। সজাগ রাখা হয়েছে সেনাবাহিনীকেও। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নির্দেশে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল রাস্তায় নামেন। গতকাল বিকেল থেকে তিনি ঘুরতে থাকেন উপদ্রুত এলাকায়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দিনভর দফায় দফায় বৈঠক করেছেন। তবু আশঙ্কা কাটছে না, পরিস্থিতি থমথমে। ৭২ ঘণ্টার রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা, দিল্লি পুলিশের নীরব ও নিষ্ক্রিয় উপস্থিতি ১৯৮৪ সালের পর দিল্লি এই প্রথম দেখল। ৩৬ বছর আগে, ১৯৮৪ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নিহত হওয়ার পর দিল্লিতে তিন দিনের দাঙ্গায় শিখ সম্প্রদায়ের সাড়ে তিন হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।

দাঙ্গার সূত্রপাত গত সোমবার। সেদিনই ভারত সফর শুরু করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর দুই দিন আগে উত্তর-পূর্ব দিল্লির জাফরাবাদ এলাকায় সিএএ-এনআরসির বিরুদ্ধে স্থানীয় লোকজন পথ অবরোধ করেন। এর প্রতিবাদে সাবেক বিধায়ক কপিল মিশ্র পুলিশের উপস্থিতিতে জানান, ট্রাম্পের যাওয়া পর্যন্ত তাঁরা অপেক্ষা করবেন। এর মধ্যে পুলিশ অবরোধ না তুললে সেই দায়িত্ব তাঁরাই হাতে তুলে নেবেন। ওই হুমকির কয়েক ঘণ্টার মধ্যে শুরু হয় অশান্তি। সোমবারেই মৃত্যু হয় চারজনের। মঙ্গলবার ট্রাম্প দিল্লি থাকাকালে নিহত মানুষের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে ১৩-তে পৌঁছায়। রাতভর অশান্তি চলে উত্তর-পূর্ব দিল্লির জাফরাবাদ, সিলামপুর, মৌজপুর, ভজনপুরা, গোকুলপুরীসহ বিস্তীর্ণ এলাকায়। অথচ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ নির্বাক আর দিল্লি পুলিশ নীরব দর্শক।

এ পরিস্থিতিতে সরব হন কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী। কাল বুধবার সংবাদ সম্মেলন ডেকে তিনি এই অরাজকতার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে দায়ী করেন। পদত্যাগ দাবি করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর। তিনি বলেন, পরিকল্পনা করে এই দাঙ্গা ঘটানো হয়েছে। চক্রান্তের চরিত্র দেশবাসী ভোটের সময় দেখেছে। মানুষ দেখেছে, কীভাবে বিজেপির নেতাদের ভাষণ হিংসায় উসকানি দিয়েছে। ভয়ের আবহ সৃষ্টি করেছে।

সোনিয়ার সংবাদ সম্মেলনের পরপরই নড়েচড়ে বসে বিজেপি। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর বলেন, সোনিয়ার মন্তব্য দুর্ভাগ্যজনক। এ পরিস্থিতিতে শান্তি রক্ষায় সচেষ্ট না হয়ে তিনি নোংরা রাজনীতি করছেন।

দিল্লির বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ায় পুরো শহর এখন থমথমে। ছবি: রয়টার্স
দিল্লির বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ায় পুরো শহর এখন থমথমে। ছবি: রয়টার্স

সোনিয়ার সংবাদ সম্মেলনের পর প্রধানমন্ত্রীও প্রথম মুখ খোলেন। টুইট করে তিনি বলেন, ‘শান্তি ও সম্প্রীতি ভারতীয় সংস্কৃতির মূল কথা। দিল্লির ভাইবোনেদের কাছে অনুরোধ, শান্তি, সম্প্রীতি ও সৌভ্রাতৃত্ব বজায় রাখুন। দ্রুত শান্তি ও স্বাভাবিকতা ফিরে আসা জরুরি।’

তিন দিনের এই দাঙ্গায় সবচেয়ে বেশি সমালোচিত দিল্লি পুলিশ। এই কদিনে একবারের জন্যও পুলিশ কমিশনারকে কোথাও দেখা যায়নি। দিল্লি পুলিশ সরাসরি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন। তবু দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। সেনা নামানোর জন্য তাঁকে চিঠি লিখেছেন। উপরাজ্যপালের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। দলীয় কর্মী ও বিধায়কদের শান্তি প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কংগ্রেসের পক্ষেও গতকাল শান্তির জন্য পদযাত্রা করা হয়।

তিন দিনের দাঙ্গায় প্রাণহানি ও আহত মানুষের সংখ্যা জানাজানি হলেও সম্পত্তি নষ্টের পরিমাণ কত, তার কোনো হিসাব কারও কাছে নেই। রাজনৈতিক নেতাদের জ্বালাময়ী ভাষণ এই দাঙ্গার জন্য কতটা দায়ী, সেই প্রশ্নও উঠছে। সিএএ-এনআরসিবিরোধীদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দেওয়ার অপরাধে নেতাদের বিরুদ্ধে পুলিশ কেন নিজে থেকে মামলা দায়ের করছে না, দিল্লি হাইকোর্ট কাল সেই প্রশ্ন তোলেন। বিচারপতি এস মুরলীধর ও তালবন্ত সিংয়ের বেঞ্চ সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতাকে নির্দেশ দেন, তিনি যেন দিল্লির পুলিশ কমিশনারকে তিন বিজেপি নেতার বিরুদ্ধে এফআইআর দাখিল করার পরামর্শ দেন।

দিল্লির ভোটের সময় বিজেপি নেতা ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর এবং সাংসদ পরভেশ শর্মা আপত্তিজনক ভাষণ দিয়েছিলেন। অনুরাগ দেশবিরোধীদের গুলি করার ইন্ধন জুগিয়েছিলেন, পরভেশ শাহিনবাগের আন্দোলনকারীদের ‘ধর্ষণকারী’ বলে অভিহিত করেছিলেন। সোমবার বিজেপির আরেক নেতা কপিল মিশ্র সরাসরি হুমকি দিয়ে বলেন, ট্রাম্প চলে গেলে অবরোধ তোলার জন্য পুলিশের ওপর তাঁরা নির্ভর করবেন না। কপিল মিশ্রর হুমকির ভিডিও ক্লিপিং আদালত কক্ষে সলিসিটর জেনারেলকে দেখানোর নির্দেশ দেন বিচারপতিরা। দিল্লি পুলিশের ভূমিকায় তাঁরা বিস্ময় প্রকাশ করেন।