মানুষটা কেমন, তা তো জানাই হলো না

দিল্লিতে সহিংসতায় নিহত মুদাসসির খানের মরদেহ ঘিরে স্বজনেরা। ছবি: রয়টার্স
দিল্লিতে সহিংসতায় নিহত মুদাসসির খানের মরদেহ ঘিরে স্বজনেরা। ছবি: রয়টার্স

ওপরের ছবিটি দিল্লির দাঙ্গায় নিহত মুদাসসির খানের। দিল্লিতে অটোরিকশা চালাতেন। তিনি হয়তো কোনো দিনই ভাবতে পারেননি এভাবে চলে যেতে হবে তাঁকে। ভাবতে পারেননি তাঁর স্বজনেরাও। যেমন ভাবতে পারেননি তাসলিন ফাতিমা, বিয়ের মাত্র ১২ দিনের মাথায় দিল্লির এই ঘটনায় হারিয়েছেন স্বামী আশফাক হুসেনকে। চিনে ওঠার আগেই চির অচেনার দেশে চলে গেছেন আশফাক। হাতের মেহেদির রং ফিকে হওয়ার আগেই জীবনের রং-ই বিবর্ণ হয়ে গেল তাসলিনের।

শুধু মুদাসসির বা ২২ বছরের আশফাক নন, দিল্লির কত পরিবারে কান্নার রোল পড়েছে, তার খবর কে রাখে? কে নেই এই তালিকায়? ২৬ বছরের গোয়েন্দা কর্মকর্তা অঙ্কিত শর্মা থেকে ৪৮ বছরের বীর ভান সিং; ১৭ বছরের আমান থেকে ৮৫ বছরের বৃদ্ধ আকবরি—হিংসার আগুন কাকে পোড়ায়নি।

আগুনে পুড়ছে জীবন। আর এই জীবনের পোড়া গন্ধে স্থির থাকতে পারেননি কবি ও গীতিকার গুলজার। নিজের ফেসবুক পেজে (হিন্দিতে) লিখেছেন তিনি…

সে তার ধর্মকে নিজে বেছে নেয়নি,
ধর্ম তার বাবা মায়ের কাছে পাওয়া।
আমরা তো আমাদের অভিভাবক নির্বাচন করি না।
সে তার দেশও নির্বাচন করেনি বা তার রাষ্ট্র তার মতো করে কাজ করে না।
মাত্র ন’বছর বয়স,
কেন এই নির্মম দাঙ্গা
তাকে মৃত্যুর জন্য বাছল!
(অনুবাদ: আনন্দবাজারের সৌজন্যে)

পৃথিবী কাঁপানো ব্রিটিশ রক ব্যান্ড ‘পিংক ফ্লয়েড’-এর সাবেক সদস্য রজার এক জনসভায় পাঠ করলেন ভারতীয় কবি ও সমাজকর্মী আমির আজিজের কবিতা ‘সব ইয়াদ রাখা যায়েগা’র ইংরেজি তর্জমা। আমির লিখেছেন:

সব মনে রাখা হবে, সব
তোমরা রাত লেখো, আমরা লিখব চাঁদ
তোমরা জেলে ঢোকাও, দেয়াল ভেঙে লিখব আমরা
তোমরা এফআইআর লেখো, আমরা তৈরি লিখতে
তোমরা হত্যা করো আমাদের, প্রেত হয়ে লিখব আমরা
লিখব প্রমাণ তোমাদের হত্যাকাণ্ডের
আদালতে বসে মশকরা লেখো তোমরা
আমরা রাস্তায় দেয়ালে লিখব ইনসাফ
বলব এত জোরে যেন বধিরও শোনে
এমন স্পষ্ট লিখব যেন অন্ধও পড়ে ফেলে
তোমরা কালো পদ্ম লেখো, আমরা লিখব লাল গোলাপ
তোমরা জমিনে অন্যায় লিখে দাও
আসমানে বিপ্লব লেখা হবে
সব মনে রাখা হবে, সব।
(অনুবাদ, জাভেদ হুসেন)

বিয়ের মাত্র ১২ দিনের মাথায় দিল্লির সহিংসতা কেড়ে নিয়েছে আশফাক হুসেনকে (বাঁয়ে)। মেহেদির রং ফিকে হওয়ার আগেই জীবনের রং ফিকে হয়ে গেছে আশফাকের স্ত্রী তাসলিনের (ডানে)
বিয়ের মাত্র ১২ দিনের মাথায় দিল্লির সহিংসতা কেড়ে নিয়েছে আশফাক হুসেনকে (বাঁয়ে)। মেহেদির রং ফিকে হওয়ার আগেই জীবনের রং ফিকে হয়ে গেছে আশফাকের স্ত্রী তাসলিনের (ডানে)

সব মনে রাখা হবে—কে মনে রাখবে? সরকার, রাষ্ট্র, গণমাধ্যম, উদ্বেগাকুল জনতা? কেউ মনে রাখবে না। সময়ের কালো গহ্বরে দিল্লির এই ছোট্ট (?) ঘটনা হারিয়ে যাবে খুব শিগগির, যেভাবে হারিয়ে গেছে তার পূর্বসূরিরা। কিন্তু হারাবে না ২১-এর তাসলিনের জীবন থেকে। জনমভর তিনি হয়তো ভেবেই চলবেন, মানুষটা কেমন, তা তো জানাই হলো না।