দিল্লিতে মানুষের প্রাণ রক্ষায় জীবন বাজি পুলিশ কর্মকর্তার

উত্তর প্রদেশের পুলিশ সুপার নীরাজ জাদাউন। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
উত্তর প্রদেশের পুলিশ সুপার নীরাজ জাদাউন। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

কিছু মানুষের উন্মত্তায় যখন প্রাণ বিষিয়ে ওঠে, আশা ডুবে যেতে বসে, তখন কারও কারও আবির্ভাব ঘটে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য। নীরাজ জাদাউন তেমনই এক মানুষ, যিনি মানুষের প্রাণ বাঁচাতে নিজের জীবন বাজি রেখেছিলেন। পুলিশ হিসেবে দায়িত্ব শুরুর আগে যে শপথ নিয়েছিলেন, সেই শপথবাক্যের প্রতিটি শব্দের প্রতি সুবিচার করে ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষের মন জয় করেছেন তিনি।

ভারতের দিল্লিতে ধর্মীয় সহিংসতার সময় জনসাধারণের জীবন-সম্পদ রক্ষা করে এখন বীর হিসেবে আখ্যায়িত হচ্ছেন উত্তর প্রদেশের পুলিশ সুপার নীরাজ জাদাউন। তাঁকে নিয়ে চলছে জয়ধ্বনি। তাঁকে ডাকা হচ্ছে ‘হিরো কপ’ (বীর পুলিশ) নামে।

নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনকে (সিএএ) কেন্দ্র করে গত রোববার থেকে ছড়িয়ে পড়া এই সহিংসতায় ৩৯ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ২০০ জনের বেশি।

বিবিসি অনলাইনের খবরে বলা হয়েছে, ঘটনাটি বর্ণনা করতে গিয়ে নীরাজ বিবিসিকে বলেছেন, গত মঙ্গলবার তিনি সীমান্তে একটি তল্লাশিচৌকিতে টহল দিচ্ছিলেন। তাঁর অবস্থান থেকে মাত্র ২০০ মিটার দূরে দিল্লির কারাওয়ালনগর থেকে গুলিবর্ষণের শব্দ শুনতে পান তিনি।

ভারতে রাষ্ট্রীয় সীমান্ত ছেড়ে আসতে হলে কর্তৃপক্ষের বিশদ অনুমতি লাগে।

দুর্বৃত্তদের প্রতিহত করতে সীমান্ত এলাকা থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নেন নীরাজ জাদাউন। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
দুর্বৃত্তদের প্রতিহত করতে সীমান্ত এলাকা থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নেন নীরাজ জাদাউন। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

নীরাজ বলেন, ‘আমি সীমান্ত ছেড়ে আসাকেই বেছে নিলাম। বিপদের কথা জেনেও আমি একাই সেখানে যেতে চাইলাম। এটা আমার এখতিয়ারবহির্ভূত ছিল। ওই ১৫ সেকেন্ড ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর সময়। কৃতজ্ঞতা যে আমার দল আমাকে অনুসরণ করেছে। আমি ঘটনাটি পরে অবহিত করার পর আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও আমাকে সমর্থন দিয়েছেন।’

নীরাজ বলেন, ‘ব্যাপারটি খুবই বিপজ্জনক ছিল। কারণ, আমরা সংখ্যায় কম ছিলাম। আর দাঙ্গাকারীরা সশস্ত্র ছিল। প্রথমে আমরা তাদের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করি। কিন্তু তা ব্যর্থ হলে আমরা তাদের বলি, পুলিশ গুলি চালাবে। তারা শুরুতে পিছু হটলেও সেকেন্ডের মধ্যে আমাদের দিকে পাথর ছোড়া শুরু করে এবং আমরা গুলিরও শব্দ পাই।’

এই পরিস্থিতির মধ্যেও নীরাজ জাদাউন এবং তাঁর দল অবস্থান নেয়। দাঙ্গাকারীরা সম্পূর্ণ সরে না যাওয়া পর্যন্ত তাঁর দল চাপ অব্যাহত রাখে।

নীরাজ জাদাউনের সিদ্ধান্তকে ‘দুঃসাহসী কর্মকাণ্ড’ বলে আখ্যায়িত করেছেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় হিন্দি ভাষার পত্রিকা ডেইলি আমার উজালার প্রতিবেদক রিচি কুমার। তাঁর ভাষায়, এমন সাহসী কর্মকাণ্ড তিনি কখনো দেখেননি। বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি খুবই বিপজ্জনক ছিল। দাঙ্গাকারীরা পুরোপুরি সশস্ত্র ছিল এবং তারা কারও কথা শুনতে চাইছিল না। আমি তাদের রক্তপিপাসু বলেই উল্লেখ করব। তারা পুলিশের দিকে পাথর ছুড়ে মারছিল। কিন্তু মি. জাদাউন পিছু হটেননি। দাঙ্গাকারীদের গুলি লাগার সমূহ বিপদ ছিল পুলিশ সদস্যদের জন্য।’

বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের পক্ষে-বিপক্ষে প্রথম সহিংসতা দেখা দেয় উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে। পরে সেটা সাম্প্রদায়িকতায় রূপ নেয়। নীরাজ জাদাউন জানান, দাঙ্গাকারীরা অগ্নিসংযোগের প্রস্তুতি নিতে এসেছিল। তিনি বলেন, ওই এলাকায় বাঁশের অনেক দোকান রয়েছে। পুরো এলাকায় আগুন ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারত এবং সেটাই ঘটতে যাচ্ছিল। তাহলে দিল্লিতে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়ত। তবে তাঁকে বীর হিসেবে আখ্যায়িত করা নিয়ে বিব্রত বোধ করছেন নীরাজ। তিনি বলেন, ‘আমি বীর নই। বিপদ থেকে যেকোনো ভারতীয়কে রক্ষার শপথ নিয়েছি আমি। আমি শুধু আমার দায়িত্ব পালন করেছি। কারণ, আমি আমার দায়িত্ব পালনের জায়গায় কাউকে মরতে দিতে চাইনি। আমরা ঘটনাটিতে হস্তক্ষেপ করতে অবস্থান নিই এবং আমরা তা করতে পেরেছি।’

দিল্লির সংঘাত ঘিরে হিন্দু-মুসলিম এক হয়ে কাজ করার মতো বীরত্বের ছোট ছোট আরও ঘটনা ঘটেছে।

দিল্লির সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন ৩৯ জন। ছবি: এএফপি
দিল্লির সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন ৩৯ জন। ছবি: এএফপি

সংঘাতে অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত স্থান অশোকনগরের সুভাস শর্মা জানান মসজিদে একদল দুর্বৃত্তের আগুন লাগিয়ে দেওয়ার ঘটনার পর তিনি কীভাবে আগুন নেভাতে ছুটে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘দুর্বৃত্তদের দলে হাজার হাজার লোক ছিল। আর মসজিদে ছিল মাত্র গুটি কয়েক লোক। আমি যখন দেখলাম আগুন লাগিয়ে দিয়েছে, আমি আমার বাসার পানির পাম্পের সুইচ অন করে পাইপ নিয়ে দৌড়ে গেলাম।’

একই এলাকার মুরতাজা নামের একজন মুসলিম জানান, তিনি সেখান থেকে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রতিবেশীরা তাঁকে পালাতে নিষেধ করেন। তিনি বলেন, ‘তাঁরা আমাকে নিশ্চিত করেন যে তাঁরা কাউকে আমাদের ক্ষতি করতে দেবেন না।’

আরেকটি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা মৌজপুরের বিজয় পার্ক এলাকার প্রতিবেশী দুই হিন্দু-মুসলিমের সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি। তাঁরা দুজন জানিয়েছেন তাঁরা কীভাবে একত্র হয়ে আশপাশের এলাকায় যানবাহন পুড়িয়ে দেওয়া ও জানালার কাচ ভাঙচুর করা দুর্বৃত্তদের তাড়া করে হটিয়ে দিয়েছিলেন।

দুজনের একজন জামালুদ্দিন সাইফি বলেন, ‘পরের দিন আমরা প্রধান সড়ক বন্ধ করে দিই এবং আশপাশের লোকজনকে সমবেত করে বাইরে বসে থাকি।’

হিন্দু-মুসলিম বাসিন্দারা এক হয়ে ‘শান্তি কমিটি’ গঠনের ঘটনাও ঘটেছে। তাঁরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে লোকজনকে বলেছেন গুজবে বিশ্বাস না করতে এবং শিশুদের বাড়ির বাইরে না যেতে দিতে।

যখন ভারতের রাজধানী ঘটনা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে, তখন এসব গল্প হচ্ছে আশা–জাগানিয়া। এসব গল্প বাসিন্দাদের মনে আশা জাগায় যে সবকিছু আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।