কে কাকে ঘোল খাওয়ালেন

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন (ডানে) ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান (বাঁয়ে)। মস্কো, রাশিয়া, ৫ মার্চ ২০২০। ছবি: রয়টার্স
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন (ডানে) ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান (বাঁয়ে)। মস্কো, রাশিয়া, ৫ মার্চ ২০২০। ছবি: রয়টার্স

অভিজ্ঞতা খারাপ। পশ্চিমারা ভালো না। প্রয়োজনের সময় পাশে থাকেনি। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান তাই মুখ ঘোরালেন মস্কোর দিকে। ডোনাল্ড ট্রাম্প-এমানুয়েল মাখোঁদের দূরে ঠেলে এরদোয়ান বন্ধুত্ব পাতালেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে।

পুতিন বিশ্বনেতা। বহু রথী-মহারথীর নাকে রশি লাগিয়ে ঘোরানোর অভিজ্ঞতা আছে তাঁর। পুতিনের ওজনের কাছে এরদোয়ান নস্যি। আঞ্চলিক গণ্ডিতে এরদোয়ানের আনাগোনা। তবে ইদানীং স্বপ্ন দেখেন বড় নেতা হওয়ার।

স্বপ্ন দেখতে মানা নেই। তবে আগডুম-বাগডুম স্বপ্ন দেখেও লাভ নেই। এরদোয়ানের ভুলটা এখানেই। বামন হয়ে চাঁদে হাত দেওয়ার স্বপ্ন দেখলে মাশুল তো গুনতেই হয়।

অতি চালাকের গলায় দড়ি বলে একটা কথা আছে। এরদোয়ান নিজেকে খুব চালাক ভেবে ন্যাটো জোটকে অন্ধকারে রেখে হুট করে সিরিয়া যুদ্ধে জড়ালেন। নগদে ধুমধাম কিছু গোলা মেরে ‘মুই কী হনু রে’ ভাব নিতে লাগলেন।

পশ্চিমাদের সঙ্গে এরদোয়ানের সম্পর্ক আরও নড়বড়ে হয়ে যায়। শূন্যতা পূরণে পুতিনের দিকে আরও ঝুঁকে পড়েন এরদোয়ান। কিন্তু পুতিন অন্য ধাতে গড়া। তাঁর লক্ষ্য—হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার। রাশিয়াকে এক নম্বর পরাশক্তি করা। সুতরাং পুতিনের কাছে এই স্বার্থই আগে। পরে আলগা বন্ধুত্ব।

সিরিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করার পর মওকা পেয়ে যান পুতিন। সিরিয়া তো বটেই, পুরো মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নিজ উদ্যোগে কাঁধে তুলে নেন তিনি।

তুরস্কের বাড়াবাড়িতে সিরিয়ায় কিছু সমস্যা হচ্ছিল। প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদকে সামনে রেখে এরদোয়ানকে একটা শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন পুতিন। গত ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে সিরিয়ার একমাত্র বিদ্রোহী–নিয়ন্ত্রিত এলাকা ইদলিবে বাশার আল–আসাদ বাহিনীর বিমান হামলায় তুরস্কের অন্তত ৩৪ সেনা নিহত হন। যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত সিরিয়ার প্রেসিডেন্টের শক্তির উৎস যে রাশিয়া, সে কথা গোপন নয়।

অহংকারে আকাশে উড়তে থাকা এরদোয়ান এক হামলায় এতগুলো সেনা হারিয়ে পুরাই বিমূঢ় হয়ে যান। দেশে তাঁর ভাবমূর্তি সংকটে পড়ে। কী তর্জন-গর্জন! আর এখন কিনা উল্টো তুর্কি সেনাদেরই লাশ গুনতে হচ্ছে।

বাশার আল–আসাদের বাহিনীর ওপর পাল্টা হামলা চালিয়ে তুরস্ক বদলা নেয় ঠিক; কিন্তু আঙ্কারা তো জানে, দামেস্ক একটা ছায়া। তার পেছনে আছে মস্কোর কায়া। তাই উত্তেজনা গড়ায় মস্কো-আঙ্কারায়।

এরদোয়ান খুব ভালো করেই জানেন, পুতিনের সঙ্গে লেগে পারা যাবে না। আবার মুখ রক্ষা করাটাও জরুরি।

ভাব বজায় রেখে এরদোয়ান গেলেন মস্কো। ৫ মার্চ এরদোয়ান ও পুতিন ক্রেমলিনে ম্যারাথন বৈঠক করেন। বৈঠকের শুরুতেই পামপট্টি দিয়ে এরদোয়ানের মন ভোলান পুতিন। এরদোয়ানের কাঁচা ঘায়ে মলম লাগান পুতিন। তুরস্কের সেনাদের প্রাণহানিতে রুশ প্রেসিডেন্টের কণ্ঠে দুঃখ-সহানুভূতি। এরদোয়ান ভাবেন, আহা, কত বড় পাওয়া। বৈঠকের ফল—ইদলিবে যুদ্ধবিরতি চুক্তি।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, রাশিয়া-তুরস্কের মধ্যে যে যুদ্ধবিরতি চুক্তিটি হয়েছে, তা অস্থায়ী। এই চুক্তি কত দিন টিকবে, তা নিয়ে আছে অনিশ্চয়তা। কারণ, অতীতেও দুই দেশের মধ্যকার চুক্তি ভেঙে যাওয়ার নজির আছে। তা ছাড়া ইদলিব নিয়ে দুই দেশের মৌলিক মতপার্থক্য এখনো স্পষ্ট।

আপাতত মনে হচ্ছে, পুতিন-এরদোয়ান ‘উইন-উইন’। আদতে রাশিয়া তার স্বার্থ-উদ্দেশ্যে কোনো ছাড় না দিয়ে চুক্তিটি করেছে। ঘোল খেয়ে বাড়ি ফিরেছেন এরদোয়ান। মুখ রক্ষা হয়েছে—মনে মনে এই ভেবে তাঁর স্বস্তি।

আর পুতিন? এরদোয়ানকেও ঠান্ডা করলেন, সিরিয়াও হাতে রাখলেন। সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না।