মোদি সরকারের মনোনয়নে সুপ্রিম কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ এবার সংসদে

মোদি ও রঞ্জন গগৈ। ছবি: মোদির টুইটার
মোদি ও রঞ্জন গগৈ। ছবি: মোদির টুইটার

১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যাওয়ার এর চেয়ে ভালো উদাহরণ আর আছে কি না সন্দেহ। মাত্র চার মাস আগে অবসর নেওয়া ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের জীবনে তাই রেকর্ডের ছড়াছড়ি!

তাঁর প্রথম রেকর্ড ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে। সে সময় সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রর বিরুদ্ধে কাজের বিষয়ে নানা অসংগতির প্রশ্ন তুলে যে চারজন বিচারপতি সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন, রঞ্জন গগৈ ছিলেন তাঁদের মধ্যমণি। সুপ্রিম কোর্টের কোনো বিচারপতি প্রকাশ্যে সংবাদ সম্মেলন করছেন, আগে কোনো দিন তা হয়নি। তাও আবার প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে! রেকর্ডই বটে। সেই রেকর্ডে নিজের নাম তুলে রঞ্জন গগৈ প্রধান বিচারপতি হন।

পরের রেকর্ড পরের বছর। প্রধান বিচারপতির অফিসেরই এক নারী কর্মী তাঁর বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির মারাত্মক অভিযোগ আনেন। অভিযোগ শোনামাত্রই গগৈ নিজেকে ‘নির্দোষ’ জাহির করে গোটা বিষয়টি ‘চক্রান্ত’ বলে দাবি করেন। এরপর সুপ্রিম কোর্টের বিধান অস্বীকার করে নিজেই তিন বিচারপতির এক বেঞ্চ গঠন করে তাঁর বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দেন। ফল যা হওয়ার তা–ই হয়েছিল। বেকসুর খালাস হন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ। এর আগে সেই নারীর চাকরিও চলে যায়। যদিও পরে তাঁকে চাকরি ফিরিয়ে দেওয়া হয়। সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে এমন অভিযোগ এবং গোপনে এমন বিচার দুটোই রেকর্ড।

তৃতীয় রেকর্ড টানা শুনানির। অযোধ্যা মামলায়। অযোধ্যার বিতর্কিত জমি নিয়ে টানা শুনানির নির্দেশ তাঁরই দেওয়া। বহু বছরের বিবাদের মীমাংসা তিনিই করেছিলেন মন্দিরের পক্ষে রায় দিয়ে। এত রেকর্ডের ঝলমলে পালক যার পাগড়িতে শোভা পাচ্ছে, তাঁকে রাষ্ট্রপতি মনোনীত সদস্য করে রাজ্যসভার শোভাবর্ধন ঘটানো নরেন্দ্র মোদির সরকার অবশ্য কর্তব্য বলে মনে করেছে। তাই অবসরের চার মাস কাটতে না কাটতেই পুরস্কৃত হলেন অসমের ভূমিপুত্র রঞ্জন গগৈ। এটাও রেকর্ড! অবসরের চার মাসে এমন পুরস্কার কারও ভাগ্যে জোটেনি।

বিজেপির সাবেক নেতা যশোবন্ত সিং মনে করেছিলেন, গগৈ সবিনয়ে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করবেন। সেই ধারণাকে আমল না দিয়ে গগৈ জানিয়েছেন, দিল্লি এসে শপথ গ্রহণের পর যা বলার তা বলবেন। চক্ষুলজ্জার প্রশ্নটি আমলই পায়নি!

ইরফান হাবিব অবশ্য আদৌ বিস্মিত নন। টুইট করে সে কথা জানিয়ে তিনি বলেছেন, ‘অনেক কষ্ট করে এই পুরস্কার তিনি অর্জন করেছেন।’ সুপ্রিম কোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি দুষ্মন্ত দাভে অবশ্য অত হেঁয়ালি করেননি। একেবারে চাঁচাছোলা প্রতিক্রিয়া তাঁর, ‘এটা ন্যক্কারজনক।’ সরকারের সঙ্গে লেনদেনের সরাসরি অভিযোগ এনে দাভে বলেছেন, ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, তাও গেল।’ প্রায় একই কথা গগৈয়ের সাবেক সহকর্মী বিচারপতি মদন লোকুরের। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, সংহতি ও নিরপেক্ষতার বিষয় তুলে তাঁর প্রশ্ন, ‘তাহলে কি গণতন্ত্রের শেষ দুর্গটাও শেষ হয়ে গেল?’

এ কথা ঠিক, বিচারপতিদের পুরস্কৃত করার এটাই প্রথম উদাহরণ নয়। রঞ্জন গগৈ সুপ্রিম কোর্টের দ্বিতীয় প্রধান বিচারপতি, যিনি অবসরের পর রাজ্যসভার সদস্য হচ্ছেন। প্রথমজন রঙ্গনাথ মিশ্র। ১৯৯১ সালে অবসর নেওয়ার সাত বছর পর ১৯৯৮ সালে কংগ্রেসের হয়ে তিনি রাজ্যসভায় এসেছিলেন। তখন কেন্দ্রে ক্ষমতায় কংগ্রেস ছিলও না। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ফতিমা বিবিকে ১৯৯৭ সালে তামিলনাড়ুর রাজ্যপাল করা হয়েছিল। মোদি সরকার ক্ষমতায় এসে সুপ্রিম কোর্টের আরেক সাবেক প্রধান বিচারপতি পি সদাশিবমকে কেরালার রাজ্যপাল করেছিল। কিন্তু রঞ্জন গগৈ সবাইকে টেক্কা দিয়েছেন দ্রুততম পুরস্কার হিসেবে। অথচ তিনিই অবসর গ্রহণের আট মাস আগে বলেছিলেন, অবসর নেওয়ার পর সরকারি পদে নিয়োগ বিচার বিভাগের স্বাধীনতার গায়ে ক্ষত।

প্রধান বিচারপতি হওয়ার আগে থেকেই তাঁর একের পর এক সিদ্ধান্ত বিজেপিকে উৎফুল্ল করেছে। অসমের ভূমিপুত্র তিনি। অসম চুক্তি অনুযায়ী এনআরসি তৈরির নির্দেশ তাঁরই দেওয়া। তাঁরই তত্ত্বাবধানে তাঁরই মেয়াদ পূর্তির আগে সেই নির্দেশ কার্যকরও তিনি করে গেছেন। সেই নির্দেশ পরবর্তী সময়ে দেশের দিকে আগুন জ্বালালেও তিনি নির্বিকার থেকেছেন। বিজেপিও পেয়ে যায় তার রাজনৈতিক হাতিয়ার। অযোধ্যা মামলার নিষ্পত্তিও বিজেপির বড় অস্ত্র। রাফায়েল নিয়ে তাঁরই আমলে আনা মামলা তিনিই খারিজ করেছেন। সরকারকে সিল করা খামে তাদের বক্তব্য পেশ করতে বলেছেন। সেই বক্তব্য পড়েছেন স্রেফ তিনি ও তাঁর বেঞ্চের অন্য বিচারপতিরা। এককথায় খারিজ করে দিয়েছেন রাফায়েল মামলার সব অভিযোগ। না করে দিয়েছেন সিবিআইকে দিয়ে তদন্ত করার দাবি।

২০১৯ সালের ভোটে বিজেপি এই রাফায়েলকেই কংগ্রেসের শক্তিশেল করে তুলেছিল। ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’ স্লোগান সুপ্রিম কোর্টের ঘাড়ে চাপানোর দায়ে রাহুলকে আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্তও করিয়েছিলেন তিনিই। সিবিআইয়ের মহাপরিচালক অলোক ভার্মার অপসারণ তারই অবদান। মাত্র ১৩ মাস প্রধান বিচারপতি থাকাকালে শাসক দলকে যিনি এতভাবে উৎফুল্ল করেছেন, ছয় বছরের জন্য রাজ্যসভায় এনে তাঁকে পুরস্কৃত করার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বিচার বিভাগের ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারে কি না আপাতত তা গবেষণাধীন।

বিরোধীরা মুখ খুলেছেন। কংগ্রেস মুখপাত্র রণদীপ সিং সুরযেওয়ালা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর বার্তা স্পষ্ট। হয় রাজ্যসভা নতুবা রাজ্যপাল। না হলে হয় বদলি নয়তো পদত্যাগ।

মোদির সাবেক সহকর্মী প্রয়াত আইনজীবী অরুণ জেটলি বলেছিলেন, অবসরের আগে সরকারি পদ পাওয়ার ইচ্ছা অবসরের আগে রায়ে প্রভাব ফেলে। তিনি যা বলেছিলেন, রঞ্জন গগৈয়ের কণ্ঠেও তারই প্রতিধ্বনি শোনা গিয়েছিল, যখন তিনি অবসর গ্রহণের পর সরকারি নিযুক্তিকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার গায়ে ‘ক্ষত’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি মনোনীত রাজ্যসভার সদস্য হওয়াকে অবশ্যই তিনি সেই ক্ষত হিসেবে মনে করছেন না। বরং হয়তো গর্বিত বোধ করছেন।

বিচার বিভাগে কোন বার্তা যাচ্ছে ও যাবে পরের কথা। রঞ্জন গগৈয়ের আমলেই সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ খারিজ হয়েছে। তাঁর আমলেই দাখিল হয়েছে কাশ্মীর–সম্পর্কিত একের পর এক মামলা। সাত মাস কেটে গেলেও এখনো সেই শুনানি শুরু হয়নি। শুরু হয়নি সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনকে (সিএএ) চ্যালেঞ্জ জানানো গাদা গাদা মামলার শুনানিও। এখন তো করোনাভাইরাস আতঙ্ক চলছে। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি জানিয়ে দিয়েছেন, নিতান্ত প্রয়োজনীয় মামলা ছাড়া অন্য কিছু তাঁরা শুনবেন না। বোঝাই যাচ্ছে, ৩৭০ অনুচ্ছেদ ও সিএএ জরুরি মামলা নয়।