করোনার বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব যুদ্ধে ফ্রান্স

নিষ্প্রাণ সঁজে লিজে, প্যারিস। ছবি: লেখক।
নিষ্প্রাণ সঁজে লিজে, প্যারিস। ছবি: লেখক।

এক অদ্ভুত আঁধার নেমে এসেছে পুরো পৃথিবীতে। ইউরোপ মোটামুটি কেঁপে উঠেছে ইতিমধ্যে। নড়েচড়ে বসেছে প্রতিটি দেশের সরকার। জনগণকে নিরাপদ রাখার সম্ভাব্য সব উপায়ের খোঁজ চলছে। ফ্রান্সও এর বাইরে নয়।

মাত্র দুদিনের ব্যবধানে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের দুবার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার ঘটনা বিরল। কিন্তু এ ঘটনা ঘটেছে। ১৪ মার্চের পর ১৬ মার্চ মাত্র কুড়ি মিনিটের বক্তৃতায় ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ চারবার উচ্চারণ করেছেন ‘যুদ্ধ’ শব্দটি। বিভিন্ন টিভি চ্যানেল এবং রেডিওতে তাঁর ভাষণ সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছে সমগ্র দেশে। অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা প্রত্যক্ষ করেছেন এবং তা শুনেছেন ৩ কোটি ৫০ লাখ মানুষ। এ সংখ্যাটা ফ্রান্সের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি।

ফরাসি প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ‘আমরা এখন যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে কঠিন সময়ের মুখোমুখি, কোনো অবস্থাতেই পিছু হটা চলবে না।’ এমন অল্প সময়ের ব্যবধানে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহীর জনসমক্ষে আসা যেমন বিরল, তেমনি বিরল করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট কোভিড-১৯ রোগের মহামারিতে উদ্ভূত এমন অদ্ভুত পরিস্থিতি। করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে ১৪ মার্চ থেকে ফ্রান্স সরকার প্রস্তুতিমূলক সতর্কতাকে তৃতীয় ধাপে উন্নীত করেছে। ফলে সেদিন মধ্যরাত থেকে সব রেস্তোরাঁ, সিনেমা হল, ক্যাফে, পানশালা, নাট্যশালা, জাদুঘর ও ক্লাব অর্থাৎ অনির্দিষ্টকালের জন্য অপ্রয়োজনীয় জনসমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। অত্যাবশ্যকীয় প্রতিষ্ঠানগুলো, যেমন: বাজার, মুদি দোকান, মাছ-মাংসের দোকান, রুটির দোকান, ফার্মেসি, গ্যাস স্টেশন, ব্যাংক, সংবাদপত্র ও সিগারেটের দোকান খোলা থাকবে।

১৬ মার্চ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে অনির্দিষ্টকালের জন্য। ছাত্রছাত্রীসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি নাগরিক সম্পৃক্ত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, তাই করোনার সংক্রমণ রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে ফরাসি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তারা মনে করেন। স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে সম্পৃক্ত পেশাজীবী, ছাত্রছাত্রী, এমনকি যাঁরা ইতিমধ্যে অবসর গ্রহণ করেছেন, তাঁদেরও সরকার আহ্বান করেছে সম্ভাব্য দুর্যোগ মোকাবিলায় এগিয়ে আসার জন্য। হাসপাতালগুলোয় বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। জনসাধারণকে বারবারই অনুরোধ করা হচ্ছে আতঙ্কিত বা উদ্বিগ্ন না হয়ে ঠান্ডা মাথায় নির্দিষ্ট কিছু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য।

এ দেশের মানুষ সচরাচর রাস্তাঘাটে কফ, থুতু ফেলে না। তারপরও একে অন্যের থেকে এক মিটার দূরে থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইতালি, দক্ষিণ কোরিয়ার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে ১৭ মার্চ দুপুর ১২টার পর থেকে দেশের সবাইকে অন্তত দুই সপ্তাহ নিজ নিজ আবাসে থাকতে অনুরোধ নয়, কঠোর আদেশ জারি করেছে ফরাসি কর্তৃপক্ষ। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একান্ত প্রয়োজনে যাদের বাইরে বের হতে হবে, তাদের সে প্রয়োজনের কারণ দেখিয়ে নির্দিষ্ট ফরম পূর্ণ করে বা সাদা কাগজে হাতে লেখা হলফনামা সঙ্গে রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ ফরমে তারিখ লিখতে ভুলে গেলে চলবে না। তা না হলে ৩৮ থেকে ১৩৫ ইউরো পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক লাখ সদস্য সরকারি আদেশ লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য রাস্তায় নেমেছে। ১৭ মার্চ দুপুরের পর যেন সবকিছু থেমে গেছে। অধিকাংশ লোক তাঁদের পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন। অদ্ভুত আঁধার নেমেছে চারদিকে; সব আছে, তবু কোথাও কেউ নেই—এমন একটা থমথমে পরিস্থিতি।

সাধারণ মানুষের কথা মাথায় রেখে তাদের পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস ইত্যাদির বিল পরিশোধে তাগাদা না দেওয়ার কথা বলেছে ফরাসি কর্তৃপক্ষ। সরকার সব পেশাজীবীকে নিয়মিত বেতন, ভাতা দেওয়ার নিশ্চয়তা দিয়েছে। বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান যাতে তাদের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারে, এ জন্য বিভিন্ন সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি ৩০ হাজার কোটি ইউরো ঋণ দেওয়ার ঘোষণা করেছে ফ্রান্সের সরকার।

অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে কৌশলী লড়াই। এ লড়াইতে পরাজিত হওয়া চলবে না। পরাজিত হলে পরাজয় ঘটবে মানবতার। স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্বের দেশ ফ্রান্সে দীর্ঘদিন পর যথেচ্ছ ভ্রমণ, সামাজিকতা, মেলামেশায় খানিকটা স্বাধীনতা খর্ব করা হলেও ফরাসি জাতি এই ক্রান্তিলগ্নে ভেদাভেদ ভুলে প্রস্তুত করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে ঘোষণা করা এ যুদ্ধে অংশ নেবার জন্য।