করোনা প্রতিরোধে পশ্চিমবঙ্গ সরকার যে যে পদক্ষেপ নিয়েছে

পশ্চিমবঙ্গের সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে করোনা রোগ চিকিৎসার জন্য আইসোলেশন ওয়ার্ড খোলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি
পশ্চিমবঙ্গের সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে করোনা রোগ চিকিৎসার জন্য আইসোলেশন ওয়ার্ড খোলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি

করোনা আতঙ্কে বিশ্বের সঙ্গে কাঁপছে ভারত। কাঁপছে পশ্চিমবঙ্গ। দিকে দিকে ডাক উঠেছে করোনা প্রতিরোধের। আতঙ্ক নয়, প্রতিরোধ করতে হবে। আর এই ডাকে পথে নেমেছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার; সেই সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারও।

করোনায় ভারতে এখন পর্যন্ত ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে ৩১৫ জন। পশ্চিমবঙ্গে এখন পর্যন্ত ৪ জনের আক্রান্ত হওয়ার খবর মিলেছে। মৃতের ঘটনা নেই। তবু পশ্চিমবঙ্গ সরকার আদাজল খেয়ে নেমেছে এই করোনা প্রতিরোধের জন্য। ডাক দিয়েছে করোনা নিয়ে অযথা আতঙ্কিত না হওয়ার এবং এই রোগ প্রতিরোধের জন্য সর্বাত্মক করোনা প্রতিরোধ আন্দোলনে শামিল হওয়ার।

এদিকে এ প্রতিরোধ আন্দোলনে শামিল হওয়ার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আজ সকাল ৭টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ১৪ ঘণ্টার এক প্রতীকী ‘জনতা কারফিউ’র ডাক দিয়েছেন। শুরুও হয়েছে দেশজুড়ে জনতার কারফিউ। লক্ষ্য একটাই ১৪ ঘণ্টা বন্দী থেকে করোনাভাইরাসের আক্রমণ থেকে কিছু সময়ের জন্য দূরে থাকা।

এদিকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারও এই করোনা প্রতিরোধের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। করোনা যাতে এই রাজ্যে মহামারি রূপ না নেয়, সেই লক্ষ্যে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন হাসপাতাল, ক্লিনিকে এই রোগ চিকিৎসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

পশ্চিমবঙ্গ সরকার ইতিমধ্যে এই রাজ্যের সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে করোনা রোগ চিকিৎসার জন্য আইসোলেশন ওয়ার্ড খোলার নির্দেশ দিয়েছে।

কলকাতায় এই রোগের প্রধান চিকিৎসাকেন্দ্র হলো বেলেঘাটা আইডি হাসপাতাল। সেখানেই মানুষ ছুটছে বেশি। কলকাতার বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আলাদাভাবে খোলা হয়েছে আইসোলেশন ওয়ার্ড।

কলকাতার হাসপাতালগুলোয় খোলা হয়েছে আইসোলেশন ওয়ার্ড। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি
কলকাতার হাসপাতালগুলোয় খোলা হয়েছে আইসোলেশন ওয়ার্ড। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি

কলকাতার অ্যাপোলো হাসপাতালে খোলা হয়েছে ৮ শয্যার আইসোলেশন ওয়ার্ড। এ ছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হাসপাতালে ৫, ফর্টিস হাসপাতালে ৫, আমরি হাসপাতালে ১৭, সিএমআরআইতে ৮, পিয়ারলেসে ৮, মেডিকায় ৭, উডল্যান্ডস’এ ৪, বেলভিউতে ৮ এবং রুবি হাসপাতালে ২টি আইসোলেশন বেড প্রস্তুত রাখা হয়েছে। আর সরকারি প্রতিটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে খোলা হয়েছে আইসোলেশন ওয়ার্ড।

অন্যদিকে কলকাতার বেলেঘাটার আইডি হাসপাতালে থাকা ২০ বেড থেকে বাড়িয়ে সেখানে করা হচ্ছে ১০০ বেডের আইসোলেশন বেড। আর কলকাতার উপশহর রাজারহাটে তৈরি বিশেষ কোয়ারিন্টন কেন্দ্রে ৫০০ শয্যার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া এমআর বাঙ্গুর হাসপাতালে ১২০ বেড, আরজিকর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০, এনআরএস মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৪, সিএমসিতে ২৬, ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৬, সাগরদত্ত মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৭ শয্যার আইসোলেশন বেডের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

রাজ্যের সব হাসপাতালের চিকিৎসক এবং নার্স ও চিকিৎসাকর্মীদের ছুটি বাতিল করে রোগীদের সেবার জন্য আরও বেশি করে যত্নবান হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে রাজ্য সরকার। যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সে সরকারি হোক বা বেসরকারি হোক, কোনো রোগীকে যেন তারা ফিরিয়ে না দেয়। জটিল হলে তারা যেন দ্রুত তা পাঠিয়ে দেয় নামী হাসপাতালে।

পশ্চিমবঙ্গে এখন পর্যন্ত ৪ জন করোনা আক্রান্ত হওয়ার খবর মিলেছে। এরপরই রাজ্য সরকার আদাজল খেয়ে নেমেছে এ ভাইরাস প্রতিরোধের জন্য। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি
পশ্চিমবঙ্গে এখন পর্যন্ত ৪ জন করোনা আক্রান্ত হওয়ার খবর মিলেছে। এরপরই রাজ্য সরকার আদাজল খেয়ে নেমেছে এ ভাইরাস প্রতিরোধের জন্য। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি

পশ্চিমবঙ্গ সরকারও এই করোনা রোগ প্রতিরোধের জন্য শুরু করেছে রাজ্যব্যাপী করোনা প্রতিরোধে নানা প্রচার। শহরে করোনা রোগীর প্রতি কী কর্তব্য ইত্যাদি লেখা নানা প্রচারপত্র বিলি করা হচ্ছে। বড় বড় ব্যানার ও পোস্টার লাগিয়ে জনজনকে করোনা নিয়ে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কী করে এই রোগ প্রতিহত এবং প্রতিরোধ করা যায়, সে কথাও প্রচার করা হচ্ছে। এই প্রচার হচ্ছে রাজ্যের সব হাসপাতাল, ক্লিনিক, হাটবাজার, রাস্তাঘাটসহ কলকাতার সব সংবাদপত্র এবং সংবাদমাধ্যমে। রাজ্যের চিকিৎসকেরাও এই করোনা প্রতিরোধে এগিয়ে এসেছেন। বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকেও তারা চিকিৎসার হাত প্রসারিত করে রোগীদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। করছেন সর্বাত্মক সহযোগিতা।

মমতা বলেছেন, ‘আসুন, আমরা সবাই মিলে করোনা প্রতিরোধ করি। রাজ্য সরকার আপনাদের পাশে থেকে আপনাদের সহযোগিতা করছে। আপনাদের সুখে–দুঃখে আছে।

জনগণকে করোনা প্রতিরোধে আহ্বান জানিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে—
*করোনাভাইরাস নিয়ে অকারণ আতঙ্ক সৃষ্টি করবেন না, বিভ্রান্তি ছড়াবেন না, ভুয়া খবরে কান দেবেন না, গুজব রটাবেন না, রাজ্য সরকার এই ভাইরাস দমনে সদা সচেষ্ট, সরকারকে সহযোগিতা করুন।
* স্বাস্থ্য দপ্তর, পুলিশ রেলওয়ে এবং সিভিল এভিয়েশন কর্মীদের সহযোগিতা করুন
* শিল্পপতিরা শ্রমিক বন্ধুদের কাজে সহযোগিতা করুন, বেসরকারি হাসপাতাল, নার্সিং হোম, ক্লিনিকগুলোকে অনুরোধ, তারা যেন কেউ কোনো রোগীকে চিকিৎসা না করিয়ে ফিরিয়ে দেন। রোগীর পরীক্ষার প্রয়োজন হলে সরকারি হাসপাতালে রেফার করুন
* মন্দির, মসজিদ, গির্জা, গুরুদ্বার ও অন্যান্য ধর্মস্থানে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়ে সেখানে জনসমাগম নিয়ন্ত্রণ করুন, অধিক মাত্রার সমাগম এড়িয়ে চলুন
* পশ্চিমবঙ্গ সরকার ভাইরাস প্রতিহত করার প্রকল্পে ২০০ কোটি রুপির ফান্ড তৈরি করেছে।
* ডাক্তার, নার্স ও সব স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা কর্মী, আশা কর্মী, বিভিন্ন কেন্দ্রীয় বাহিনী, রেলওয়ে ও বিমানকর্মীসহ ১০ লাখ স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা ও সুস্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে মাথাপিছু ৫ লাখ রুপির বিমার বন্দোবস্ত করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার।

কলকাতার মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলোয় খোলা হয়েছে আইসোলেশন ওয়ার্ড। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি
কলকাতার মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলোয় খোলা হয়েছে আইসোলেশন ওয়ার্ড। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি


করোনা প্রতিরোধে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের পরামর্শ—
*ন্যূনতম ১-২ মিটার (৩ থেকে ৬ ফুট) দূরত্ব বজায় রাখুন অপরিচিতদের থেকে,
*ভিড় ও জনসমাগম এড়িয়ে চলুন,
*দোকান বাজারেও ন্যূনতম ব্যবধান রেখে চলুন,
*প্রতি ঘণ্টায় সাবান-জল কিংবা হ্যান্ড সেনিটাইজারে হাত ধুয়ে ফেলুন, হাত পরিষ্কার না করে চোখ-নাক-মুখে হাত দেবেন না, প্রেক্ষাগৃহ, রেস্তোরাঁ, পাব, চিত্তবিনোদন কেন্দ্র এড়িয়ে চলুন,
*বাস-ট্রাম-ট্রেনে ভিড় থাকলে উঠবেন না, টেক্সি ক্যাবে উঠলেও শেয়ারে উঠবেন না, অপরিচিতদের সঙ্গে সামনাসামনি কম দূরত্বে কথা বলবেন না,
*হেয়ার ড্রেসার, বিউটি পারলার, শপিং মল, নাইট ক্লাব, পাব, এড়িয়ে চলুন। বড় পার্টি, নিমন্ত্রণ বাড়িও এড়িয়ে চলুন,
*অসুস্থ বোধ না করলে হাসপাতাল ও ক্লিনিকও এড়িয়ে চলুন।